আন্তর্জাতিক বিভিন্ন নৌবাহিনী সোমালি জলদস্যুদের নিয়ন্ত্রণে এনেছে বলে ভাবলেও আদতে জলদস্যুতার পুনরুত্থানের সর্বশেষ শিকার হয়েছে বাংলাদেশি জাহাজ এমভি আবদুল্লাহ।
Published : 21 Mar 2024, 09:17 PM
পশ্চিম ভারত মহাসাগরে স্পিড বোটে করে এক ডজনেরও বেশি সোমালি জলদস্যু যখন বাংলাদেশি জাহাজ এমভি আবদুল্লাহকে ধাওয়া করেছিল, নাবিকরা তখন সতর্ক সংকেত পাঠিয়েছিলেন। জরুরি হটলাইনে কলও করেছিলেন।
কিন্তু সময়মতো তাদের কাছে কেউ পৌঁছায়নি। ফলে জলদস্যুরা এমভি আবদুল্লাহয় উঠে পড়ে ফাঁকা গুলি ছোড়ে এবং জাহাজের ক্যাপ্টেন ও সেকেন্ড অফিসারকে জিম্মি করে। জাহাজের প্রধান কর্মকর্তা আতিক উল্লাহ খান জাহাজ মালিকদের কাছে একটি অডিও বার্তায় এমনটিই জানিয়েছিলেন।
জলদস্যুরা নাবিকদের ফোন জব্দ করার আগে একটি বার্তা রেকর্ড করেছিলেন আতিকুল্লাহ। তাতে তিনি বলেছিলেন, “আল্লাহর রহমতে এখন পর্যন্ত কারও কোনও ক্ষতি হয়নি।” এক সপ্তাহ পর এমভি আবদুল্লাহ সোমালিয়া উপকূলে নোঙর করে।
আন্তর্জাতিক বিভিন্ন নৌবাহিনী মনে করেছিল তারা সোমালি জলদস্যুদের নিয়ন্ত্রণে এনেছে। কিন্তু আদতে জলদস্যুতার পুনরুত্থানের সর্বশেষ শিকার হয়েছে বাংলাদেশি জাহাজ আবদুল্লাহ।
লোহিত সাগরসহ আশেপাশের জলপথগুলোতে যখন ইয়েমেনের ইরান-সমর্থিত হুতি বিদ্রোহী গোষ্ঠী বাণিজ্যিক জাহাজে বারবার ড্রোন ও ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালাচ্ছে, তখন সোমালি জলদস্যুদের এমন উপদ্রব শিপিং কোম্পানিগুলোর ঝুঁকি ও খরচ আরও বাড়িয়ে দিচ্ছে।
পাঁচটি শিপিং কোম্পানির প্রতিনিধিদের তথ্যমতে, গতবছর নভেম্বর থেকে এ পর্যন্ত সোমালি জলদস্যুরা ২০টির বেশি জাহাজ ছিনতাইয়ের চেষ্টা চালানোর কারণে সশস্ত্র নিরাপত্তারক্ষী নিয়োগ এবং বীমার খরচ বেড়েছে। একইসঙ্গে মুক্তিপণ দেওয়ার আশঙ্কাও বেড়েছে।
সোমালি জলদস্যুচক্রের দুই সদস্য বার্তাসংস্থা রয়টার্সকে বলেছেন, তারা প্রায় এক দশক ধরে নিষ্ক্রিয় থাকার পর এখন জলদস্যুতায় ফেরার জন্য কয়েকশ নটিক্যাল মাইল উত্তরে হুতি হামলার ফলে সৃষ্ট পরিস্থিতির সুযোগ নিচ্ছেন।
সোমালি জলদস্যুদের অর্থায়ন করেন আলিয়াস ইসমাইল ইসা। তার সঙ্গে কথা হয়েছে রয়টার্সের। ইসা জানান, গত ডিসেম্বরে একটি পণ্যবাহী জাহাজ ছিনতাইয়ের জন্য জলদস্যুদের অর্থায়ন করেছিলেন তিনি।
রয়টার্সকে ইসা বলেন, “‘হুতিদের হামলা সামাল দিতে গিয়ে আন্তর্জাতিক নৌ-বাহিনীগুলো সোমালিয়া উপকূলে টহল কমিয়ে দিয়েছে। আর সেই সুযোগই নিচ্ছে তারা (সোমালি জলদস্যু)।”
ইসা সোমালিয়ার আধা-স্বায়ত্তশাসিত উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় পান্টল্যান্ডের উপকূলীয় অঞ্চল হুল আনোদ থেকে মোবাইলে রয়টার্সের সঙ্গে কথা বলেন। ওই এলাকাতেই ছিনতাই হওয়া জাহাজ এমভি রুয়েনকে কয়েক সপ্তাহ ধরে নোঙর করে রাখা হয়েছিল।
এবারে জলদ্যসুদের উত্থান ২০০৮-২০১৪ সালের মতো গুরুতর না হলেও আঞ্চলিক কর্মকর্তারা এবং শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলোর সোর্সরা এ নিয়ে উদ্বিগ্ন। তাদের ধারণা, সমস্যা আরও সংকটময় পরিস্থিতির দিকে যেতে পারে।
২০০৮ থেকে ২০১৪ সালে সোমালি জলদস্যুদের দাপট বেড়েছিল। পরে বিভিন্ন দেশের নৌ-বাহিনীর সম্মিলিত অভিযানে তারা নিষ্ক্রিয় হয়। এখন সেই জলদস্যুরা আবার মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। যদিও তাদের দাপট এখনও আগের পর্যায়ে পৌঁছায়নি।
সোমালিয়ার প্রেসিডেন্ট হাসান শেখ মোহামুদ গত মাসে রয়টার্সকে বলেছিলেন, “আমরা একে (জলদস্যুদের পুনরুত্থান) অঙ্কুরেই বিনষ্ট না করলে জলদস্যুতা সেই আগের পর্যায়ে চলে যেতে পারে।”
গত সপ্তাহে ভারতীয় নৌবাহিনী মাল্টার পতাকাবাহী জাহাজ এমভি রুয়েনকে জলদস্যুদের কবল থেকে মুক্ত করে। ইউরোপীয় ইউনিয়নের জলদস্যু বিরোধী মিশন ‘ইইউএনএভিএফওআর’ আটলান্টা বলেছে, জলদস্যুরা বাংলাদেশি জাহাজ এমভি আবদুল্লাহয় আক্রমণের জন্য সম্ভবত এমভি রুয়েনকে লঞ্চপ্যাড হিসেবে ব্যবহার করেছিল।
ভারতীয় নৌবাহিনী জানিয়েছে, এমভি রুয়েনে থাকা ৩৫ জন জলদস্যু আত্মসমর্পণ করেছে এবং ১৭ জিম্মিকে উদ্ধার করা হয়েছে। বর্তমানে জাহাজটি আবার সাগরে ফিরেছে।
ইন্টারন্যাশনাল চেম্বার অব কমার্সের অপরাধ বিরোধী শাখার উপ-পরিচালক সাইরাস মোডি বলেছেন, “লোহিত সাগরের পূর্বাঞ্চলে ভারতীয় নৌবাহিনী অন্তত এক ডজন যুদ্ধজাহাজ মোতায়েন করেছে। তাদের এই হস্তক্ষেপ জলদস্যুদের তৎপরতায় ছেদ টানতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। এই হস্তক্ষেপের কারণে লাভ/ঝুঁকির খতিয়ানের নিরীখে জলদস্যুরা আর কোনও ছিনতাই চেষ্টার আগে কয়েকবার চিন্তা করতে বাধ্য হবে বলে আশা করা যায়।”
তবে বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বার্তা সংস্থা রয়টার্সকে বলেছেন, এমভি আবদুল্লাহ উদ্ধারে কোনও ধরনের সামরিক ব্যবস্থা নেওয়ার পক্ষে নয় ঢাকা। সোমালি উপকূলে থাকার সময় জলদস্যুরা যে সুবিধা পায় সেকথা রয়টার্সকে জানিয়েছেন তিনি।
খরচ বাড়ছে:
সোমালিয়ার জলপথে রয়েছে বিশ্বের কয়েকটি ব্যস্ততম জাহাজ চলাচল পথ। প্রতি বছর আনুমানিক ২০ হাজার জাহাজ এপথে চলাচল করে। এসব জাহাজ নিত্যপণ্য থেকে শুরু করে জ্বালানি, পোশাকসহ প্রায় সবধরনের পণ্য পরিবহন করে।
সোমালি জলপথ ধরে লোহিত সাগর এবং সুয়েজ খালের দিকে যায় কিংবা আসে জাহাজগুলো। পথে জাহাজগুলো এডেন উপসাগর পাড়ি দেয়। ইউরোপ এবং এশিয়ার মধ্যে এটিই সবচেয়ে ছোট সামুদ্রিক পথ।
ইন্টারন্যাশনাল মেরিটাইম ব্যুরো জানিয়েছে, সোমালি জলদস্যুদের উৎপাত চরমে পৌঁছেছিল ২০১১ সালে। ওই বছর জলদস্যুরা ২৩৭টি জাহাজে হামলা চালায় এবং শত শত মানুষকে জিম্মি করে।
সেই বছর ওশেনস বিয়ন্ড পাইরেসি মনিটরিং গ্রুপ আনুমানিক হিসাব দিয়ে বলেছিল, জলদস্যুতার কারণে বিশ্ব অর্থনীতির প্রায় ৭০০ কোটি মার্কিন ডলারের ক্ষতি হয়েছে। এর মধ্যে লাখ লাখ ডলার মুক্তিপণও দিতে হয়েছিল জলদস্যুদের।
বর্তমানে জলদস্যুদের হামলা চালানোর হার বেশ কম। জলদস্যুরা ইদানিং টহল কম থাকা এলাকাগুলোতে ছোট জাহাজগুলোকে নিশানা করছে। গত নভেম্বর থেকে তারা অন্তত দুটি পণ্যবাহী জাহাজ ও ১২টি মাছ ধরার জাহাজ জব্দ করতে সফল হয়েছে বলে জানিয়েছে ইউরোপীয় ইউনিয়নের জলদস্যু বিরোধী মিশন ‘ইইউএনএভিএফওআর’।
জলদস্যু বিরোধী এই ইউরোপীয় মিশন সতর্ক করে দিয়ে বলেছে, বর্ষা মৌসুমের শেষদিকে জলদস্যুরা আরও পূর্ব ও দক্ষিণে সরে যেতে পারে। ইইউএনএভিএফওআর চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত এডেন উপসাগর এবং সোমালিয়া উপকূলে জলদস্যুদের পাঁচটি সক্রিয় গ্রুপ চিহ্নিত করেছে।
বর্তমানে জলদস্যুরা বিস্তৃত এমন এক এলাকায় হামলা চালাচ্ছে যেখানে এরই মধ্যে যুদ্ধঝুঁকির জন্য জাহাজগুলোকে বীমার প্রিমিয়াম বাবদ বেশি খরচ করতে হচ্ছে। জলদস্যুদের হুমকির জন্য এডেন উপসাগর ও লোহিত সাগরে চলাচলকারী জাহাজগুলোর বীমার খরচ উল্লেখযোগ্য হারে বেড়ে যাচ্ছে। সাধারণ ৭ দিনের যাত্রার জন্যই গুনতে হচ্ছে হাজার হাজার ডলার, জানিয়েছেন বীমা শিল্প কর্মকর্তারা।
জাহাজগুলোতে বেসরকারি সশস্ত্র রক্ষীদের ক্রমবর্ধমান চাহিদার কারণেও খরচ বেড়ে যাচ্ছে। সমুদ্র নিরাপত্তা সংশ্লিষ্ট কয়েকজন কর্মকর্তা জানান, তিনদিনের জন্য একটি সশস্ত্র রক্ষীদল নিয়োগের খরচ ফেব্রুয়ারি মাসের তুলনায় মার্চে একলাফে প্রায় ৫০ শতাংশ (চার হাজার থেকে ১৫ হাজার মার্কিন ডলার) বেড়েছে।
সশস্ত্র এসব রক্ষী হুতিদের ক্ষেপণাস্ত্র ও ড্রোনের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়তে না পারলেও সোমালি জলদস্যুদের জাহাজ ছিনতাইয়ের বিরুদ্ধে কার্যকর প্রতিরোধ গড়ে তুলতে সক্ষম প্রমাণিত হয়েছে।
ওদিকে, মাল্টার পতাকাবাহী জাহাজ এমভি রুয়েন ছিনতাইয়ের পর জলদস্যুদেরকে কোনও মুক্তিপণ দেওয়া হয়েছিল কি না, তা জানা যায়নি। তবে জলদস্যুদের অর্থায়নকারী ইসা ও এ বিষয়ে সংশ্লিষ্ট আরেক সূত্র রয়টার্সকে জানিয়েছে, রুয়েনকে মুক্তি দেওয়ার জন্য কয়েক লাখ ডলার মুক্তিপণ দেওয়া নিয়ে আলোচনা হয়েছিল।
জাহাজটি পরিচালনাকারী বুলগেরিয়ান কোম্পানি নাভিবুলগারের একজন মুখপাত্র মুক্তিপণ নিয়ে আলোচনার বিষয়ে মন্তব্য করতে রাজি হননি। তিনি কেবল জাহাজটি উদ্ধারের জন্য ভারতীয় নৌ বাহিনীকে কৃতজ্ঞতা জানান।
ওদিকে, এমভি আবদুল্লাহর মালিক এসআর শিপিংয়ের একজন মুখপাত্র বলেছেন, জলদস্যুরা তৃতীয় পক্ষের মাধ্যমে যোগাযোগ করেছিল। কিন্তু কোম্পানিকে কোনও মুক্তিপণের কথা বলা হয়নি।
সমাধান কোন পথে:
নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞরা বলছেন, হুতি ও সোমালি জলদস্যুদের মধ্যে সরাসরি যোগ থাকার প্রমাণ নেই। যদিও জলদস্যুদের অর্থায়নকারী ইসা বলেছেন, সোমালি জলদস্যুরা হুতিদের সাম্প্রতিক হামলায় অনুপ্রাণিত হয়েই দস্যুতায় নেমেছে।
এক দশকেরও বেশি সময় আগে জলদস্যুদের রুখতে শিপিং কোম্পানিগুলো জাহাজে নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করেছিল। নেটো, ইউরোপীয় ইউনিয়ন এবং যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে আন্তর্জাতিক নৌবাহিনী যৌথভাবে জলদস্যু নির্মুল অভিযানে যোগ দিয়েছিল।
১৪টি দেশের ২০ টির মতো যুদ্ধজাহাজ এডেন উপসাগর এবং ভারত মহাসাগরের জাহাজ চলাচল পথগুলোতে টহল দিত। কখনও কখনও ভূমধ্যসাগর এবং লোহিত সাগরেও টহল চলত।
জাতিসংঘের রাজনৈতিক কার্যালয়ের সোমালিয়া শাখার জলদস্যুতা-বিরোধী ইউনিটের সাবেক প্রধান জন স্টিড বলেছেন, “এই পদক্ষেপে বাস্তবিকই জলদস্যুদের আক্রমণ নির্মূল হয়েছিল। ধীরে ধীরে জলদস্যুদের হুমকি কমে গেলে দেশগুলো টহলরত যুদ্ধজাহাজের সংখ্যাও কমিয়ে দেয় এবং পরবর্তীতে জাতীয় কমান্ডে ফিরে যায়।”
‘ইইউএনএভিএফওআর, যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রণালয় এবং ব্রিটিশ নৌবাহিনী বলেছে, তারা সোমালিয়াকে জলদস্যুতা মোকাবেলায় সহায়তা করতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। তবে টহল অতিরিক্ত কমে যাওয়া এবং বাড়তি সংস্থান করার বিষয়ে তারা কোনও প্রশ্নের উত্তর দেয়নি।
স্টিড জানান, আরেকটি বিষয় হল ২০২২ সালে জাতিসংঘের একটি প্রস্তাবে বিদেশি জাহাজগুলোকে সোমালি জলসীমায় টহল দেওয়ার কথা বলা হলেও সেটি ব্যর্থ হয়।
সোমালিয়ার প্রেসিডেন্ট মোহামুদ বলেছিলেন, জলদস্যুদের হুমকি মোকাবেলায় বিদেশি জাহাজ পাঠানো কোনও কার্যকর সমাধান নয়, বরং সাগর ও স্থলপথে সোমালিয়ার আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোর সক্ষমতা বাড়ালে এ হুমকি মোকাবেলা করা সম্ভব।
সোমালিয়া সরকারের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, সেদেশের কোস্ট গার্ডে ৭২০ জন প্রশিক্ষিত সদস্য রয়েছে। তবে তাদের ব্যবহারের জন্য মাত্র চারটি ছোট নৌকা রয়েছে, যার মধ্যে তিনটিই নষ্ট। সচল আছে মাত্র একটি। রাজধানী মোগাদিশু, পান্টল্যান্ড এবং বিচ্ছিন্ন সোমালিল্যান্ড অঞ্চলেও সীমিত অস্ত্রসহ সামুদ্রিক পুলিশ বাহিনী রয়েছে।