বলিউড তারকা সালমান খান কৃষ্ণসার হরিণ হত্যা করেছিলেন, এই বিশ্বাসে তার যে কোনো বন্ধুকে শত্রু হিসেবে দেখে ওই গোষ্ঠী।
Published : 13 Oct 2024, 03:46 PM
মহারাষ্ট্রের সাবেক মন্ত্রী বাবা সিদ্দিকীকে হত্যার দায় লরেন্স বিষ্ণোই গ্যাং সোশাল মিডিয়ায় স্বীকার করেছে বলে খবর দিয়েছে ভারতীয় সংবাদমাধ্যম এনডিটিভি।
৬৬ বছর বয়সী জাতীয়তাবাদী কংগ্রেস পার্টির (এনসিপি) এই নেতাকে বৃহস্পতিবার রাতে মুম্বাইয়ের শহরতলি পূর্ব বান্দ্রায় গুলি করে হত্যা করা হয়। ঘটনার সময় তিনি পূর্ব বান্দ্রার বিধায়ক ছেলে জিশান সিদ্দিকীর অফিসের কাছে অবস্থান করছিলেন।
পুলিশের বরাতে এনডিটিভি লিখেছে, ঘটনার সঙ্গে তিন বন্দুকবাজের সম্পৃক্ততা মিলেছে। তাদের মধ্যে হরিয়ানার বাসিন্দা কর্নেইল সিংহ (২৩) আর উত্তরপ্রদেশের ধরমরাজ কাশ্যপ (১৯) ধরা পড়েছেন। উত্তর প্রদেশেরই আরেকজন, শিব কুমার গৌতমের যোগ দেখতে পাচ্ছে পুলিশ, যাকে এখনো গ্রেপ্তার করা সম্ভব হয়নি।
পুলিশের ধারণা, এই তিনজনকে সমন্বয় করছিলেন আরেক ব্যক্তি, তিনিও পালিয়ে গেছেন।
স্থানীয় সময় রাত সাড়ে ৯টার দিকে বাবা সিদ্দিকী ও তার সহযোগীকে লক্ষ্য করে কয়েক রাউন্ড গুলি চালায় হামলাকারীরা। বর্ষীয়ান এই রাজনীতিকের বুকে গুলি লাগে।
এনডিটিভি লিখেছে, ঘটনার কয়েক ঘণ্টা পর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে একটি পোস্টের মাধ্যমে এ হত্যাকাণ্ডের দায় স্বীকার করে কুখ্যাত বিষ্ণোই গ্যাং।
শিবু লঙ্কার নামের একটি ফেইসবুক অ্যাকাউন্টে দেওয়া পোস্টটির বিষয়ে তদন্ত করছে ভারতের কেন্দ্রীয় সংস্থাগুলো। ওই অ্যকাউন্ট বিষ্ণোই গ্যাংয়ের সহযোগী শুভম রামেশ্বর লঙ্কারের হতে পারে বলে তদন্তকারীরা ধারণা করছেন।
বেআইনি অস্ত্র রাখার অভিযোগে শুভমকে চলতি বছরের শুরুতে মহারাষ্ট্রের আকোলা থেকে গ্রেপ্তার করা হয় এবং বিষ্ণোই নেটওয়ার্কের সঙ্গে তার ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ রয়েছে বলে মনে করা হয়। পুলিশি জিজ্ঞাসাবাদে শুভম স্বীকার করেছেন, লরেন্সের ঘনিষ্ঠ ভাই আনমোল বিষ্ণোইয়ের সঙ্গে ভিডিও কলে তার যোগাযোগ হয়ে থাকে।
সিদ্দিকী হত্যার পর তদন্তকারীরা জেনেছেন, দুই বন্দুকবাজ ধরমরাজ কাশ্যপ ও শিবকুমার গৌতম উত্তরপ্রদেশের বাহরাইচের বাসিন্দা। এ দুই প্রতিবেশী অপরাধ জগতে প্রবেশের আগে পুনেতে শ্রমিক হিসাবে কাজ করেছিলেন।
বাহরাইচের পুলিশ সুপার বৃন্দা শুক্লা জানিয়েছেন, ধরমরাজকে গ্রেপ্তার করা সম্ভব হলেও শিব কুমার এখনও পলাতক।
নিজের শহরে দুজনের কারোরই অপরাধের তথ্য নথিবদ্ধ নেই জানিয়ে এনডিটিভি লিখেছে, পাঞ্জাবের একটি কারাগারে থাকার সময় দুজনের মধ্যে বোঝাপড়া তৈরি হয়েছিল। তারা বিষ্ণোই গ্যাংয়ের সঙ্গে জড়িয়ে কুখ্যাতি অর্জন করতে চেয়েছিল বলে সূত্রগুলো ধারণা করছে।
পুলিশ জানিয়েছে, আসামিরা কয়েক মাস ধরে সিদ্দিকীর বাসা ও অফিসে নজরদারি চালাচ্ছিল। হামলার জন্য সন্দেহভাজনদের প্রত্যেককে অগ্রিম ৫০ হাজার টাকা করে দেওয়া হয়েছিল। আর অস্ত্র দেওয়া হয়েছিল হত্যার দিন কয়েক আগে।
গ্রেপ্তার হওয়া দুই সন্দেহভাজন এখন পুলিশ হেফাজতে রয়েছেন এবং বাকিদের ধরতে অভিযান চলছে। বাবা সিদ্দিকী হত্যাকাণ্ডের পর তার ঘনিষ্ঠ বলিউড তারকা সালমান খানের মুম্বাইয়ের বাসায় নিরাপত্তা জোরদার করেছে পুলিশ।
গত ১৪ এপ্রিল রাতে সালমানের বান্দ্রার ওই বাসভবনের বাইরে কয়েক রাউন্ড গুলি ছুড়েছিল বাইকে আসা দুই ব্যক্তি। এই ঘটনায় লরেন্স বিষ্ণোই গ্যাংয়ের সদস্যদের বিরুদ্ধে হত্যার ষড়যন্ত্র ও অন্যান্য গুরুতর অপরাধের অভিযোগ আনা হয়েছে।
অভিযোগপত্র অনুযায়ী, ২৫ লাখ রুপির বিনিময়ে বলিউডের ভাইজানকে হত্যার দায়িত্ব দিয়েছিল বিষ্ণোই গ্যাং। ২০২৩ সালের অগাস্ট থেকে ২০২৪ সালের এপ্রিল পর্যন্ত কয়েক মাস ধরে এই পরিকল্পনা করা হয়েছিল।
দল-মত নির্বিশেষে বাবা সিদ্দিকীর অবস্থান থাকায় তার হত্যাকাণ্ড রাজনৈতিক অঙ্গনে তীব্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেছে। প্রবীণ রাজনীতিকরা এ ঘটনার নিন্দা জানানোর পাশাপাশি মহারাষ্ট্রে ক্রমবর্ধমান সহিংসতার ঘটনায় ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন।
সিদ্দিকীর হত্যার ঘটনায় শোক জানানোর ‘ভাষা হারানোর’ কথা বলেছেন কংগ্রেস সভাপতি মল্লিকার্জুন খাড়গে।
এক্স পোস্টে তিনি বলেছেন, “মহারাষ্ট্রের সাবেক মন্ত্রী বাবা সিদ্দিকীর মর্মান্তিক মৃত্যুর ঘটনায় শোক জানানোর ভাষা আমার জানা নেই। এই শোকের মুহূর্তে আমি তার পরিবার, বন্ধুবান্ধব ও সমর্থকদের প্রতি গভীর সমবেদনা জানাচ্ছি।
“ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে হবে এবং বর্তমান মহারাষ্ট্র সরকারকে অবশ্যই একটি পুঙ্খানুপুঙ্খ ও স্বচ্ছ তদন্তের নির্দেশ দিতে হবে। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব দোষীদের আইনের আওতায় আনতে হবে। জবাবদিহিতা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ।”
লোক সভার বিরোধী দলীয় নেতা রাহুল গান্ধীও একই ধরনের প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছেন। তিনি বলেছেন, “বাবা সিদ্দিকীজির এই করুণ মৃত্যু মর্মান্তিক ও দুঃখজনক। এই কঠিন সময়ে তার পরিবারের প্রতি আমার সমবেদনা রইল।
“মহারাষ্ট্রের আইনশৃঙ্খলা যে সম্পূর্ণ ভেঙে পড়েছে তা এই ভয়ংকর ঘটনার মধ্য দিয়ে প্রকাশ পেয়েছে। সরকারকে অবশ্যই দায়িত্ব নিতে হবে এবং ন্যায়বিচার অবশ্যই নিশ্চিত করতে হবে।”
এই হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় বিজেপি ও বিরোধী দলগুলোর মধ্যে রাজনৈতিক টানাপড়েন শুরু হয়েছে। বিজেপি এই হত্যাকাণ্ড নিয়ে রাজনীতি না করার দাবি জানালেও বিরোধীরা- বিশেষ করে কংগ্রেস দাবি করেছে, মহারাষ্ট্রে আইনশৃঙ্খলা পুরোপুরি ভেঙে পড়েছে।
লরেন্স বিষ্ণোই, বাবা সিদ্দিকী ও সালমান খান
কয়েক ডজন মামলা মাথায় নিয়ে লরেন্স বিষ্ণোই বর্তমানে গুজরাটের একটি কারাগারে বন্দি আছেন, তবে তার দল মুক্তিপণের জন্য ব্যবসায়ীদের ফোন কল দিয়ে সংবাদের শিরোনাম হয়েছে।
১৯৯৮ সালের দুই কৃষ্ণ হরিণ হত্যা মামলা থেকে সালমান রেহাই পেলেও লরেন্স বিষ্ণোইয়ের ‘নিশানার তালিকায়’ তিনি রয়েছে।
কারণ বিষ্ণোই সম্প্রদায়ের মানুষ কৃষ্ণসার বা চিংকার হরিণকে পবিত্র বলে মনে করে, বলতে গেলে তারা পূজা করে।
বিষ্ণোইয়ের ঘনিষ্ঠ সহযোগী রোহিত গোদারা এর আগে দাবি করেছিলেন, সালমান খানের যেকোনো বন্ধুই তাদের চোখে ‘শত্রু’ হিসেবে বিবেচিত।
পুলিশ সূত্রের বরাতে এনডিটিভি লিখেছে, বিষ্ণোই চক্রে ৭০০ জনের বেশি বন্দুকবাজ রয়েছে, যারা ভারতজুড়ে ছোট-বড় অপরাধী হিসেবে কাজ করে। সাম্প্রতিক বেশ কয়েকটি খুনের ঘটনায় বিষ্ণোইয়ের দলের যোগ পেয়েছে পুলিশ, যার মধ্যে র্যাপার সিধু মুসেওয়ালা এবং দিল্লির একটি জিম মালিকের হত্যাকাণ্ড আছে- যিনি আফগান বংশোদ্ভূত ছিলেন।
আনন্দবাজার লিখেছে, গত ফেব্রুয়ারিতেই কংগ্রেসের সঙ্গে পাঁচ দশকের সম্পর্ক ত্যাগ করে অজিত পাওয়ারের জাতীয়তাবাদী কংগ্রেস পার্টিতে (এনসিপি) যোগ দেন বাবা সিদ্দিকী। সত্তরের দশকে কংগ্রেসের ছাত্র সংগঠন থেকে মূল স্রোতের রাজনীতিতে এসেছিলেন সিদ্দিকী।
১৯৯৯ সালে প্রথম বিধানসভা ভোটে জয়ী হয়েছিলেন বান্দ্রা এলাকার এই নেতা। ২০০৯ সাল পর্যন্ত তিন বার ভোটে জিতলেও ২০১৪ এবং ২০১৯ সালের বিধানসভা ভোটে বান্দ্রা পশ্চিম কেন্দ্র থেকে তিনি হেরেছিলেন।
বলিউডের সঙ্গে বাবা সিদ্দিকীর যোগাযোগ নিয়ে মুম্বাইয়ে আলোচনা রয়েছে জানিয়ে আনন্দবাজার লিখেছে, বিভিন্ন সময়ে তার দেওয়া ইফতার পার্টিতে বলিউড তারকাদের দেখা গেছে। ২০১৩ সালে তার পার্টিতেই ‘মানভঞ্জন’ হয় শাহরুখ খান ও সালমন খানের।
দুই খানকে দু’পাশে নিয়ে তোলা তার সেই ছবি স্মরণীয় হয়ে আছে বলে মনে করেন অনেকেই।