নির্বাচনে জয়ী দলের প্রধান প্রধানমন্ত্রী হতে না পারায় থাইল্যান্ডে নতুন রাজনৈতিক অনিশ্চয়তার মুখে পড়ল বলে ধারণা পর্যবেক্ষকদের।
Published : 20 Jul 2023, 04:42 PM
থাইল্যান্ডে সাধারণ নির্বাচনে জয়ী মুভ ফরোয়ার্ড পার্টির নেতা পিটা লিমজারোয়েনরাতের প্রধানমন্ত্রী হওয়ার দৌড়ের ইতি ঘটায় তার সমর্থকরা ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছে।
চলতি বছরের মে মাসে হওয়া নির্বাচনে মুভ ফরোয়ার্ড পার্টি বিপুল ভোটে জয়ী হয়। বছরের পর বছর ধরে চলা সামরিক শাসনকে প্রত্যাখ্যান করা ভোটাররা পরিবর্তনের পক্ষে রায় দেয়।
কিন্তু দেশটির সাংবিধানিক আদালত প্রথমে পিটাকে (৪২) নাটকীয়ভাবে পার্লামেন্ট থেকে বরখাস্ত করলে বুধবার আইন পরিষদ ছেড়ে চলে যেতে বাধ্য হন এ সংস্কারবাদী রাজনীতিক। এরপর আইনপ্রণেতারা তাকে প্রধানমন্ত্রী করা হবে কিনা, এ সংক্রান্ত দ্বিতীয় দফার ভোট থামিয়ে দিতে সম্মত হন বলে জানিয়েছে বিবিসি।
নির্বাচনের জয়কে চূড়ান্ত পরিণতি দিতে প্রধানমন্ত্রী হতে পার্লামেন্টের অনুমোদন দরকার ছিল পিটার, কিন্তু গত সপ্তাহে তিনি ওই অনুমোদন পেতে ব্যর্থ হন।
নির্বাচনে জয়ী দলের প্রধান প্রধানমন্ত্রী হতে না পারায় দক্ষিণপূর্ব এশিয়ার এ দেশটি নতুন রাজনৈতিক অনিশ্চয়তার মুখে পড়ল বলে ধারণা পর্যবেক্ষকদের।
দীর্ঘদিন ধরে অকার্যকর একটি মিডিয়া কোম্পানির মালিকানার শেয়ার আছে পিটার, সেই সূত্রে ধরেই পার্লামেন্ট থেকে তাকে বরখাস্ত করা হয়েছে। এখন তাকে পুরোপুরি অযোগ্য ঘোষণা করা হবে কিনা সে সিদ্ধান্ত দেবে সাংবিধানিক আদালত।
“পরবর্তীতে দেখা হওয়ার আগ পর্যন্ত আমি আপনাদের বিদায় বলতে চাই,” পার্লামেন্ট ছেড়ে যাওয়ার আগে মুঠো করা হাত ঊর্ধ্বে তুলে দলের সহকর্মীদের উল্লাসধ্বনির মধ্যে বলেন পিটা।
হার্ভার্ড থেকে ডিগ্রি নেওয়া, একসময়ের প্রযুক্তি কোম্পানির নির্বাহী পিটা রাজপরিবারের অপমান নিষিদ্ধ করে করা কঠোর আইনসহ থাইল্যান্ডের রাজনীতিতে বড় ধরনের সংস্কার আনার প্রতিশ্রুতি দিয়ে ভোটারদের মন জয় করে নিয়েছিলেন।
তার এসব সংস্কার প্রস্তাবই তাকে সামরিক বাহিনীর নিয়োগকৃত সেনেটের অনির্বাচিত সদস্য এবং তাকে রাজতন্ত্রের জন্য হুমকি হিসেবে দেখা রক্ষণশীলদের চক্ষুশূলে পরিণত করেছে।
বুধবার পিটাকে বরখাস্ত এবং তাকে প্রধানমন্ত্রী করা হবে কিনা সে সংক্রান্ত দ্বিতীয় দফার ভোট বাতিল হওয়ার পর পার্লামেন্টের বাইরে মুভ ফরোয়ার্ড পার্টির সমর্থকদের ক্ষোভ, হতাশা প্রকাশ পেয়েছে।
‘এমনটা হলে, নির্বাচনের দরকার কী’- সে প্রশ্নও তুলছে তারা।
“কেন লোকজনকে ভোট দিতে যেতে বলা? কেন আপনি আপনার পরিবার থেকে কাউকে বেছে নিয়ে প্রধানমন্ত্রী করছেন না?” জিজ্ঞাসা একজনের।
“পিটা ভুল করেননি, যা করেছেন ঠিক করেছেন,” বলেছেন আরেক নারী।
পার্লামেন্ট ছেড়ে যেতে বাধ্য হওয়ার আগে পিটা বলেছিলেন, সাংবিধানিক আদালত চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত দেওয়ার আগ পর্যন্ত এমপি হিসেবে কাজ করবেন না তিনি।
“আমি মনে করি, থাইল্যান্ড বদলে গেছে এবং ১৪ মে-র পর এটি আর কখনোই আগের মতো থাকবে না। জনগণ অর্ধেকটা জিতেছে, আরও অর্ধেক বাকি আছে,” নির্বাচনে জয়ের দিনকে স্মরণ করে বলেন মুভ ফরোয়ার্ড পার্টির এ শীর্ষ নেতা।
প্রধানমন্ত্রী হতে তার পার্লামেন্টের দুই কক্ষের ৭৪৯ সদস্যের মধ্যে অন্তত ৩৭৫ জনের সমর্থন লাগতো, গত সপ্তাহে তিনি ৩২৪ জনের সমর্থন জোগাড় করতে পেরেছিলেন।
নিম্নকক্ষের নির্বাচিত এমপিদের মধ্যে তার সুস্পষ্ট সংখ্যাগরিষ্ঠতা থাকলেও তিনি উচ্চকক্ষের সামরিক বাহিনীর নিয়োগকৃত অনির্বাচিত সদস্যদের ভোট পাননি তিনি।
সরকার গড়তে মুভ ফরোয়ার্ড পার্টি, নির্বাচনে দ্বিতীয় স্থানে থাকা পুয়ে থাই পার্টিসহ ৭টি পার্টির সঙ্গে জোট গ ঠন করে।
পুয়ে থাই পার্টি সামরিক বাহিনীর সঙ্গে ঝামেলায় জড়াতে অনাগ্রহী হওয়ায় কয়েক দফায় ক্ষমতায় থাকা এ দলটি থেকে মুখ ফিরিয়ে বহু তরুণ এবার মুভ ফরোয়ার্ডের প্রার্থীকে সমর্থন দিয়েছিল।
নির্বাচনে মুভ ফরোয়ার্ড পার্টির জয়ের পর থেকেই থাইল্যান্ডের বর্তমান ক্ষমতাকাঠামোর সুবিধাভোগীরা পিটার উত্থান আটকে দিতে মরিয়ে হয়ে ওঠে।
তার বিরুদ্ধে সাংবিধানিক আদালতে দুটি অভিযোগ দায়ের করা হয়। এর একটি ওই মিডিয়া কোম্পানির মালিকানার শেয়ার সংক্রান্ত, যে অভিযোগে তাকে পার্লামেন্ট থেকে বরখাস্ত করা হয়েছে।
অন্য অভিযোগটি করা হয়েছে রাজপরিবারকে অপমান নিষিদ্ধ করে থাকা আইন সংশোধনে মুভ ফরোয়ার্ড পার্টির প্রস্তাব নিয়ে। রাজপরিবারের শত শত সমালোচককে জেলখানায় পাঠানো এই আইন সংস্কারকে অনেক রক্ষণশীলই থাইল্যান্ডের সমগ্র রাজনৈতিক ব্যবস্থাকে ‘উচ্ছেদের ষড়যন্ত্র’ হিসেবে দেখছেন।
পিটা আর মুভ ফরোয়ার্ড পার্টিকে নিয়ে এখন যা হচ্ছে, কয়েক বছর আগেও তার কাছাকাছি ঘটনা দেখেছে থাইল্যান্ড। ২০১৯ সালের নির্বাচনের পর দেশটির সাংবিধানিক আদালত নির্বাচনী বিধিবিধান লংঘন করায় মুভ ফরোয়ার্ড যে দলের উত্তরসূরী, সেই ফিউচার ফরোয়ার্ড পার্টিকে বিলুপ্ত ঘোষণা করেছিল।
একই সাংবিধানিক আদালত ২০০৮ সালের পর থেকে দেশটির সাবেক প্রধানমন্ত্রী থাকসিন সিনাওয়াত্রার ঘনিষ্ঠ তিনজনকেও প্রধানমন্ত্রী পদ থেকে বরখাস্ত করেছে। ২০০৬ সালের অভ্যুত্থানে থাকসিন ক্ষমতাচ্যুত হয়েছিলেন।
কিন্তু এবার পিটার বিরুদ্ধে সাংবিধানিক আদালতের রায় থাকসিনের পুয়ে থাই পার্টির জন্য বড় সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচন করে দিচ্ছে বলেই মনে হচ্ছে।
সরকার গড়তে জোট করলেও পুয়ে থাই ও মুভ ফরোয়ার্ড পার্টির মধ্যে সম্পর্ক খুব একটা ভালো নয়। গণতন্ত্রের ‘চ্যাম্পিয়ন’ তকমাটি মুভ ফরোয়ার্ড পুয়ে থাইয়ের কাছ থেকে ছিনিয়ে নেওয়ার কারণেও এমনটা হতে পারে বলে ধারণা পর্যবেক্ষকদের।
তবে সবকিছু ছাপিয়ে সামনে চলে আসছে পিটার ভবিষ্যৎ। পরিস্থিতি এখন যা, তাতে মুভ ফরোয়ার্ড পার্টির এ নেতা শীর্ষ পদ তো দূর, সরকারের কোথাও জায়গা পাবেন কিনা, তা নিয়েই সন্দেহ দেখা দিয়েছে।
আরও খবর:
থাইল্যান্ড: ধীরেসুস্থে এগুতে চান প্রধানমন্ত্রীত্ব প্রত্যাশী পিটা