সার্স ভাইরাসের তথ্য ফাঁস করা চীনা চিকিৎসকের মৃত্যু

জিয়াং ইয়ানইয়ং নামের এই চিকিৎসকই ২০০৩ সালে বিশ্ববাসীর সামনে সার্স মহামারী নিয়ে চীন কর্তৃপক্ষের রাখঢাকের খবর ফাঁস করেছিলেন।

নিউজ ডেস্কবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 15 March 2023, 06:17 PM
Updated : 15 March 2023, 06:17 PM

মারা গেছেন চীনের শল্য চিকিৎসক জিয়াং ইয়ানইয়ং। সাবেক এই সামরিক চিকিৎসকই ২০০৩ সালে বিশ্ববাসীর সামনে সার্স মহামারী নিয়ে চীন কর্তৃপক্ষের রাখঢাকের খবর ফাঁস করে দিয়েছিলেন।

নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হয়ে গত শনিবার বেইজিংয়ে তার মৃত্যু হয় বলে জানান তার এক পারিবারিক বন্ধু এবং হংকংয়ে চীনা ভাষার একটি সংবাদমাধ্যম।

পরে জিয়াংয়ের পরিবার বুধবার তার মৃত্যুর খবর নিশ্চিত করে বলে জানায় বিবিসি। তার বয়স হয়েছিল ৯১ বছর।

সার্স মহামারী যখন সবে শুরু হয় তখন ডা. জিয়াং একটি চিঠি লিখে প্রাণঘাতী এই ভাইরাস সম্পর্কে সতর্ক করে বলেছিলেন, কীভাবে কর্মকর্তারা গণস্বাস্থ্যের উপর ভয়াবহ এই হুমকিকে অবজ্ঞা করছেন।

সাহস করে সত্য সামনে এনে বহু মানুষের প্রাণরক্ষায় ভূমিকা রাখার জন্য পরে তিনি বিশ্বজুড়ে দারুণ প্রশংসিত হন। যদিও শুরুতে সত্য ফাঁস করার জন্য তাকে গৃহবন্দি হতে হয়েছিল।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্যানুযায়ী, ২০০৩ সালে বিশ্বজুড়ে আট হাজারের বেশি মানুষ সার্স ভাইরাসে আক্রান্ত হয়। মারা গেছে ৭৭৪ জন।

ওই বছর এপ্রিলে বেইজিংয়ের একটি হাসপাতালে কাজ করতেন ডা. জিয়াং। সেসময় তিনি চীনের স্বাস্থ্যমন্ত্রীকে ফুসফুসের নতুন রোগ সার্স ভাইরাস সম্পর্কে জনগণকে তথ্য দিতে গিয়ে হাতেগোণা মাত্র কয়েকজন এ রোগে আক্রান্ত হয়েছেন বলতে শুনে শঙ্কিত হয়ে পড়েছিলেন।

সার্স ভাইরাসে আক্রান্তদের ফুসফুসে মারাত্মক প্রদাহ দেখা দেয়। ২০০৩ সালের এপ্রিল মাসে যখন চীনের স্বাস্থ্যমন্ত্রী অল্প কয়েকজন এই রোগে আক্রান্ত হওয়ার কথা বলেছিলেন, সে সময় শুধুমাত্র সামরিক হাসপাতালের ওয়ার্ড গুলোতেই একশর বেশি এই রোগে আক্র‍ান্ত রোগী ভর্তি ছিল বলে জানিয়েছিলেন এই চিকিৎসক।

এ পরিস্থিতিতে তিনি চীনের রাষ্ট্রীয় সম্প্রচার ‍মাধ্যমে একটি চিঠি পাঠিয়ে সরকারের পক্ষ থেকে দেওয়া তথ্য মিথ্যা বলে জানিয়েছিলেন। কিন্তু চীনের রাষ্ট্রায়ত্ত্ব সংবাদমাধ্যম তার সে চিঠি প্রকাশ না করে বরং অবজ্ঞা ভরে উড়িয়ে দেয়।

পরে বিদেশি সংবাদমাধ্যমে ওই চিঠি ফাঁস হয়ে যায় এবং তারা তার পুরো চিঠি প্রকাশ করে। ডা. জিয়াংয়ের এই উদঘাটনের পর চীন সরকার স্বীকার করতে বাধ্য হয় যে, সার্স ভাইরাস নিয়ে তারা মিথ্যা তথ্য দিয়েছে।

ডব্লিউএইচও তড়িৎ ব্যবস্থা গ্রহণ করে। রাতারাতি কঠোর নিয়ন্ত্রণ বিধি জারি হয়। যা ভাইরাস সংক্রমণের গতি ধীর করতে সহায়তা করে।  

ডা. জিয়াংয়ের সত্য প্রকাশের পর দায়িত্বে অবহেলা ও ভুয়া তথ্য প্রকাশের জন্য ওই সময়ে চীনের স্বাস্থ্যমন্ত্রী এবং বেইজিংয়ের মেয়র বরখাস্ত হন।

নিজের উপর বিপদের ঝুঁকি জেনেও কেনো সত্য প্রকাশের সাহস করেছিলেন, এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘‘আমার মনে হয়েছিল, যা ঘটছে সেটা আমাকে প্র‍কাশ করতেই হবে। শুধু চীনকে রক্ষা করতে নয় বরং পুরো বিশ্বকে রক্ষা করতে।”

পরের বছর আবারও বেইজিং সরকারকে চ্যালেঞ্জের মুখে দাঁড় করান ডা. জিয়াং। তিনি ক্ষমতাসীন চাইনিজ কমিউনিস্ট পার্টিকে (সিসিপি) ১৯৮৯ সালে তিয়ানানমেন স্কয়ারে বিক্ষোভের সময় বিক্ষোভকারীদের উপর দমনপীড়ন করা ‘ভুল ছিল’ বলে স্বীকার করে নেওয়ার আহ্বান জানান।

তিয়ানানমেন স্কয়ারে ওই দমনপীড়নে শতাধিক এমনকি সম্ভবত হাজারের অধিক বেসামরিক নাগরিক নিহত হন।

ওই সময় ডা. জিয়াং বেইজিংয়ে একজন শল্য চিকিৎসক হিসেবে কাজ করতেন। সেই রাতের অভিজ্ঞতা তিনি একটি চিঠিতে লেখেন। চিঠিতে তিনি বর্ণনা করেন, কীভাবে কর্তৃপক্ষ ‘সম্পূর্ণ নিরস্ত্র ছাত্র এবং সাধারণ জনগণকে দমন করতে পাগলের মত ট্যাঙ্ক, মেশিনগান এবং অন্যান্য অস্ত্র ব্যবহার করেছিল’।

তিনি বলেন, ‘‘আমাদের দলকে অবশ্যই তারা যে ভুল করছিল সেটা স্বীকার করে নিতে হবে।”

ডা. জিয়াং ও তার স্ত্রী হুয়া ঝংউইকে পরে আটক করা হয়। কিন্তু বছরের পর বছর ধরে নিজের বক্তব্যে অটল থেকেছেন এই চিকিৎসক।

২০১৯ সালে তিনি চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের কাছে একটি চিঠি লেখেন। চিঠিতে তিনি তিয়ানানমেন স্কয়ারে সরকারি বাহিনীর অভিযানকে ‘অপরাধ’ বলে বর্ণনা করেন।

চীনের পূর্বাঞ্চলের নগরী হাংঝউর একটি ধনী পরিবারের জন্মগ্রহণ করেন ডা. জিয়াং। সাউথ চায়না মর্নিং পোস্ট জানিয়েছে, এই চিকিৎসক তার স্ত্রী, এক ছেলে ও এক মেয়েকে রেখে গেছেন।

সাহস নিয়ে সত্যের পক্ষে অবস্থানের কারণে তিনি সারাজীবন নানা নাগরিক সম্মানে ভূষিত হয়েছেন। জনকল্যাণমূলক কাজের জন্য তিনি ২০০৪ সালে ‘র‌্যামন ম্যাগসেসে অ্যাওয়ার্ড’ পান।

ওই পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠানে তার সম্পর্কে বলা হয়, ‘‘তিনি চীনাদের চুপ থাকার অভ্যাস ভেঙেছেন এবং সার্স সম্পর্কে সত্যকে সামনে নিয়ে আসতে বাধ্য করেছেন।”

কোভিড-১৯ মহামারীর বেলাতেও চীনা কৃর্তপক্ষ ঠিক একই কাজ করেছেন। এবারও উহান শহরের একজন চক্ষু চিকিৎসক ‍তাদের সেই রাখঢাকের চেষ্টা ফাঁস করে সত্যকে সামনে নিয়ে আসেন।

চিকিৎসক লি ওয়েনলিয়াংই ২০১৯ সালের ডিসেম্বরে ‘সার্সয়ের মত একটি ভাইরাস’ উহান শহরে ছড়িয়ে পড়া সম্পর্কে জনগণকে সতর্ক করেন। যে কারণে, ‘গুজব ছড়ানোর’ অভিযোগ নিয়ে পুলিশ তার বাড়িতে হানা পর্যন্ত দেয়।

২০২০ সালের ফেব্রুয়ারিতে কোভিড-১৯ আক্রন্ত হয়ে মারা যান ডা. লি।