ট্রাম্পের নতুন এ পরিকল্পনা দুই-রাষ্ট্র সমাধানের আশায় শেষ পেরেক ঠুকবে, আশঙ্কা অনেকের।
Published : 07 Feb 2025, 02:18 PM
যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডনাল্ড ট্রাম্প কোনো জোরজবরদস্তি ছাড়াই গাজা দখলে নেওয়ার যে খোয়াব দেখছেন, তা বাস্তবায়িত হওয়ার সম্ভাবনা নেই বললেই চলে।
তবে তা সত্ত্বেও এই পরিকল্পনা মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতিতে বড় ধরনের প্রভাব ফেলবে বলেই মনে করছেন বিবিসির আন্তর্জাতিক সম্পাদক জেরেমি বোয়েন।
তার মতে, ট্রাম্প তার পরিকল্পনায় গাজাকে ‘মধ্যপ্রাচ্যের রিভেরাতে’ পরিণত করার আকাঙ্ক্ষা ব্যক্ত করেছেন; চাইছেন সেখানকার ফিলিস্তিনিদের অন্যত্র পুনর্বাসন করতে। কিন্তু এই পরিকল্পনা বাস্তবায়নে যে আরব দেশগুলোর সহযোগিতা প্রয়োজন, তারা ইতোমধ্যেই পরিকল্পনাটি প্রত্যাখ্যান করেছে।
ট্রাম্পের পরিকল্পনা অনুসারে, গাজার বাসিন্দাদের জর্ডান ও মিশরে সরিয়ে নেওয়া হবে, আর এতে আর্থিক সহায়তা দেবে সৌদি আরব।
এরই মধ্যে দেশ তিনটি গাজাবাসীদের সরিয়ে নেওয়ার বিরুদ্ধে দৃঢ় অবস্থান ব্যক্ত করেছে। শুধু তাই-ই নয়, যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েলের অনেক পশ্চিমা মিত্রও এর বিরুদ্ধে।
এদিকে গাজাবাসী ফিলিস্তিনিরাও বলছে, তারা নিজ ভূখণ্ড ছাড়বে না।
হয়তো কেউ কেউ রাজি হবে। ধরা যাক ১০ লাখ ছাড়ল, তাও আরও ১২ লাখ মানুষ গাজায় থেকে যাবে। এর অর্থ, পরিকল্পনা বাস্তবায়নে ট্রাম্পকে বলপ্রয়োগ করতে হবে।
২০০৩ সালে ইরাকে মার্কিন হস্তক্ষেপের কথা মনে থাকলে এ ধরনের যে কোনো পদক্ষেপ যুক্তরাষ্ট্রের ভেতরেই তুমুল অজনপ্রিয়তা পাবে।
বিশ্লেষকরা মনে করছেন, ট্রাম্পের নতুন এ পরিকল্পনা দুই-রাষ্ট্র সমাধানের আশায় শেষ পেরেক ঠুকবে।
এই দুই-রাষ্ট্র নীতিতে ইসরায়েলের পাশাপাশি একটি স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্র গঠনের কথা বলা হয়েছে, যা শতাব্দী পুরনো সংঘাতের স্থায়ী অবসান ঘটাবে বলে আশা।
৯০-এর দশক থেকে মধ্যপ্রাচ্যে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রনীতির মূল অংশও এই দুই-রাষ্ট্র নীতি। কিন্তু বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর সরকার এই সমাধানের বিপক্ষে।
ট্রাম্পের পরিকল্পনা বাস্তবায়িত হলে তা আন্তর্জাতিক আইনও লঙ্ঘন করবে; যুক্তরাষ্ট্র যে ‘নিয়মতান্ত্রিক বিশ্ব ব্যবস্থার’ পক্ষে দৃঢ়, সেই বিশ্বাস ভেঙে পড়বে। ইউক্রেইনের একাংশ নিয়ে রাশিয়া, তাইওয়ান নিয়ে চীনের দাবিও পোক্ত হবে।
বাড়তে পারে মধ্যপ্রাচ্যের অস্থিরতা
হাস্যেজ্জ্বল, আনন্দিত নেতানিয়াহুর চোখের সামনে ট্রাম্প ওয়াশিংটনে যেভাবে বলেছেন, যদি সেভাবে গাজার ভবিষ্যৎ নির্ধারিত না হয় তাহলে এটা নিয়ে দুশ্চিন্তা কেন?
দুশ্চিন্তার কারণ- ট্রাম্পের বক্তব্য যতই উদ্ভট শোনাক না কেন, এর প্রভাব সুদূরপ্রসারী।
মনে রাখা দরকার, তিনি এখন রিয়েলিটি টিভি হোস্ট কিংবা সংবাদে স্থান করে নিতে চাওয়া রাজনীতিক নন, বরং বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী দেশের প্রেসিডেন্ট।
তার এই অদ্ভূত ঘোষণা গাজার ভঙ্গুর যুদ্ধবিরতিকে আরও দুর্বল করে দিতে পারে। যেমনটা মনে করছে ঊর্ধ্বতন এক আরব সূত্র; তারা বিবিসিকে বলেছে, ট্রাম্পের পরিকল্পনা গাজা যুদ্ধবিরতির ‘মৃত্যুঘণ্টা’ হতে পারে।
গাজা ভবিষ্যতে কার হাতে শাসিত হবে তার সুস্পষ্ট উল্লেখ না থাকাকে আগে থেকেই যুদ্ধবিরতি চুক্তির দুর্বল দিক হিসেবে অভিহিত করা হচ্ছিল।
এখন ট্রাম্প আরেকটা নতুন দৃশ্যকল্প নিয়ে হাজির হয়েছেন। যদি এটি বাস্তবায়িত নাও হয়, তাও তা ইসরায়েলি ও ফিলিস্তিনিদের মনে গেঁথে থাকবে।
এটি কট্টর জাতীয়তাবাদী ইহুদিদের স্বপ্ন ও পরিকল্পনাকেও উসকে দেবে, যারা ভূমধ্যসাগর থেকে জর্ডান নদী পর্যন্ত, হয়তো এর বাইরের অংশকেও, তাদের জন্য ঈশ্বর-প্রদত্ত ভূখণ্ড বলে মনে করে।
তাদের নেতারা নেতানিয়াহুর সরকারের অংশীদার, নেতানিয়াহুকে ক্ষমতায়ও রেখেছে তারা। এই নেতারা উচ্ছ্বসিত। তারা চাইছেন গাজা থেকে ফিলিস্তিনিদের উচ্ছেদ করে সেখানে ইহুদি বসতি গড়ে তুলতে প্রয়োজনে দীর্ঘমেয়াদী যুদ্ধ হোক।
ইসরায়েলের অর্থমন্ত্রী বেজালেল স্মট্রিচ যেমন বলছিলেন, ট্রাম্প গাজার ভবিষ্যৎ নিয়ে সমস্ত প্রশ্নের উত্তর দিয়ে দিয়েছেন।
“যারা আমাদের ভূমিতে ভয়াবহ হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে, তারা চিরকালের জন্য নিজেদের ভূমি হারাবে। ঈশ্বরের সাহায্য নিয়ে এখন আমাদের ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার ভাবনাকে চূড়ান্তভাবে কবর দিতে হবে,” বলেছেন ইসরায়েলি এই মন্ত্রী।
মধ্যপন্থি বিরোধী নেতারা অবশ্য তুলনামূলক কম উচ্ছ্বসিত, সম্ভবত তারা ভবিষ্যতের সম্ভাব্য অস্থিরতা নিয়ে উদ্বিগ্ন। তারা এই পরিকল্পনাকে সতর্কতার সঙ্গে স্বাগত জানিয়েছেন।
এদিকে হামাস ও অন্যান্য ফিলিস্তিনি সশস্ত্র সংগঠনেরও মনে হতে পারে, সামরিক উপায়ে বা অন্য কোনো উপায়ে ট্রাম্পের প্রস্তাবের প্রতিক্রিয়া দেখানো দরকার।
অনেক ফিলিস্তিনিরই আশঙ্কা, ইসরায়েলের সঙ্গে সংঘাত তাদেরকে স্থায়ীভাবে বাস্তুচ্যুত করবে, যে কারণে তাদের মনে বারবার ১৯৪৮ সালের 'আল-নাকবা' বিপর্যয়ের কথা ফিরে আসছে।
সেবার সাত লাখেরও বেশি ফিলিস্তিনিকে ইসরায়েলি বাহিনী জোর করে বাস্তুচ্যুত করে। তাদের অধিকাংশই আর কখনোই নিজের দখলকৃত ভূমি ফিরে পাননি। যারা ফিরেছেন, তাদের ভূমিও যখন তখন নিয়ে নেওয়ার আইন করে রেখেছে তেল আবিব।
এবারও, সেই একই ঘটনার পুনরাবৃত্তির আশঙ্কা করা হচ্ছে।
অনেক ফিলিস্তিনি অবশ্য এখনই বিশ্বাস করেন যে গাজা ধ্বংস এবং এর বাসিন্দাদের বিতাড়িত করতেই ইসরায়েল হামাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করছে। ট্রাম্প তাদের বিশ্বাসকে দৃঢ করছেন।
ট্রাম্পের উদ্দেশ্য কী হতে পারে?
ট্রাম্প কিছু বললেই সেটা যে সবসময় সত্য, বা ঘটবেই, তা নয়।
তার গাজা নিয়ে বক্তব্যে যুক্তরাষ্ট্রের দীর্ঘদিনের নীতি নেই, বরং তিনি যেন রিয়েল এস্টেট ব্যবসায় দরকষাকষির প্রথম চাল খেললেন।
বোয়েন বলছেন, সম্ভবত ট্রাম্প ইচ্ছা করেই এই ধোঁয়াশা তৈরি করছেন, আর পেছনে অন্য একটি পরিকল্পনা নিয়ে কাজ করছেন। বলা হচ্ছে, তিনি নোবেল শান্তি পুরস্কারের জন্য মুখিয়ে আছেন।
মধ্যপ্রাচ্যে শান্তি প্রতিষ্ঠায় চেষ্টা করা প্রায় সবাই স্বয়ংক্রিয়ভাবে এই পুরস্কারের দাবিদার হয়ে ওঠেন।
গাজা নিয়ে তার ঘোষণা হজম করতে যখন বিশ্বের কষ্ট হচ্ছে, ঠিক তখনই ট্রাম্প তার সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ট্রুথ সোশ্যালে ইরানের সঙ্গে ‘যাচাইযোগ্য পরমাণু শান্তি চুক্তি করার’ আগ্রহ ব্যক্ত করেছেন।
ইরান বারবারই তার পরমাণু শক্তিধর হয়ে ওঠার আকাঙ্ক্ষার কথা অস্বীকার করে আসছে। তবে হুমকির মাত্রা বিবেচনায় ইরানের এখনই পরমাণু অস্ত্র প্রয়োজন কিনা তা নিয়ে তেহরানে তুমুল আলোচনাও আছে।
অনেকদিন ধরেই নেতানিয়াহু চাইছেন, ইসরায়েলের সহযোগিতায় যুক্তরাষ্ট্র যেন ইরানের পারমাণবিক কেন্দ্রগুলো ধ্বংস করে দেয়। তেহরানের সঙ্গে চুক্তি করা কোনোভাবেই ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রীর পরিকল্পনার অংশ হতে পারে না।
বারাক ওবামা আমলে স্বাক্ষরিত ইরান পরমাণু চুক্তি থেকে যুক্তরাষ্ট্র যেন বেরিয়ে আসে সেজন্য ট্রাম্পের প্রথম মেয়াদে দীর্ঘ ও সফল প্রচেষ্টা চালিয়েছিলেন নেতানিয়াহু।
এখন ট্রাম্প যদি ইরানিদের সঙ্গে কথা বলার আগে গাজা নিয়ে কিম্ভূতকিমাকার কিছু বলে ইসরায়েলি কট্টর-ডানদের খুশি রাখতে চান, তাহলে তাতে তিনি সফল হয়েছেনে।
কিন্তু একই সঙ্গে তিনি বিশ্বের সবচেয়ে টালমাটাল অঞ্চলে নতুন অনিশ্চয়তা সৃষ্টি করেছেন, মধ্যপ্রাচ্যকে ঠেলে দিয়েছেন আরও অস্থিরতার দিকেও।