যুদ্ধবিরতি কার্যকরে দেরি হচ্ছে তা জানতো না তারা, নিশ্চিন্তে বাড়ির পথে রওনা হয়েছিল। সে যাত্রাই হলো কাল।
Published : 20 Jan 2025, 02:43 PM
হামাস জিম্মিদের নাম সময়মতো দেয়নি এই অজুহাতে যুদ্ধবিরতি কার্যকরে যে পৌনে তিন ঘণ্টা দেরি হয়েছিল সেসময়ও ইসরায়েলি বিমানের হামলা থেমে ছিল না।
সর্বশেষ এ হামলা প্রাণ কেড়ে নিয়েছে গাজার আল-কিদরা পরিবারের তিন সদস্যের, যারা যুদ্ধবিরতি শুরু হয়েছে মনে করে নিশ্চিন্তে বাড়ির পথে রওনা হয়েছিল।
সোয়া এক বছরের দুঃসহ অভিজ্ঞতা ভুলে নতুন শুরুর প্রত্যয়ে সেই যাত্রাই হলো কাল; তাদের হারিয়ে এখন পরিবারের অন্য সদস্যরাও দিশেহারা বলে এক প্রতিবেদনে জানিয়েছে আল জাজিরা।
চুক্তি অনুযায়ী, ইসরায়েল আর হামাসের মধ্যে যুদ্ধবিরতি শুরু হওয়ার কথা রোববার স্থানীয় সময় সকাল সাড়ে ৮টায়। সে অনুযায়ীই প্রস্তুত হয়েছিল আল-কিদরা পরিবার।
তারা ১৫ মাসের ইসরায়েলি হামলা সয়েছে, একাধিকবার বাড়ি ছাড়া হয়েছে, থেকেছে তাঁবুতেও। এ দফার যুদ্ধে যে প্রায় ৪৭ হাজার মানুষের মৃত্যু হয়েছে, তার মধ্যে তাদের আত্মীয় স্বজনরাও আছে।
আল-কিদরারা বোধহয় এই যাত্রায় বেঁচে যাচ্ছে, এমনটাই ভেবেছিল তারা। চেয়েছিল যত দ্রুত সম্ভব বাড়ি ফিরতে।
রোববার সকাল সকাল ৭ সন্তানকে গাধাচালিত গাড়িতে তুলে খান ইউনিসের পূর্ব অংশের দিকে রওনা হয়েছিলেন আহমেদ আল-কিদরা। তার হিসাব অনুযায়ী সেসময়টা ছিল ভ্রমণের জন্য নিরাপদ, বোমাবাজি তো আর হবে না!
কিন্তু পরিবারটি জানতো না ইসরায়েল আর হামাসের মধ্যে যুদ্ধবিরতি কার্যকর হতে দেরি হচ্ছে। আর এই সুযোগে ইসরায়েলি জঙ্গি বিমানগুলো আগের মতোই গাজার আকাশ দাপিয়ে বেড়াচ্ছে, হরেদরে ফেলছে বোমা।
বিকট শব্দ হয়েছিল, যা শুনতে পান আহমেদের স্ত্রী হানানও। তিনি সেসময় শহরের কেন্দ্রেই এক আত্মীয়ের বাড়িতে ছিলেন, জিনিসপত্র গোছগাছ করছিলেন, পরিকল্পনা করছিলেন কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই স্বামী আর সন্তানদের সঙ্গে একত্রিত হওয়ার।
“শব্দটা মনে হলো যেন আমার হৃদয়ে আঘাত হানলো,” বলেন হানান। সহজাতভাবেই এ মা বুঝে যান তার সন্তানদের একটা কিছু হয়েছে, যাদেরকে মাত্রই বিদায় দিয়েছেন তিনি।
“আহারে আমার বাচ্চারা, আহারে,” ঘটনার কথা বলতে গিয়ে এভাবেই বিলাপ করছিলেন এ নারী।
গাধার গাড়িটা তছনছ হয়ে গিয়েছিল। হানানের বড় ছেলে, ১৬ বছর বয়সী আদলি ঘটনাস্থলেই মারা যায়। একই দশা সবার মধ্যে ছোট ছয় বছর বয়সী মেয়ে সামারও।
১২ বছর বয়সী ইয়াসমিন জানায়, তাদের গাধার গাড়ির সামনে একটি চার চাকার মোটরযান ছিল, যাতে কিছু মানুষ যুদ্ধবিরতি উদ্যাপন করছিল, সম্ভবত তাদের লক্ষ্য করেই ক্ষেপণাস্ত্রটি ছোড়া হয়েছিল।
“দেখলাম সামা এবং আদলি মাটিতে শুয়ে আছে, আর বাবার শরীর থেকে রক্ত বের হচ্ছে, তিনি গাড়িতে অচেতন হয়ে আছেন,” বলে ইয়াসমিন।
কয়েক সেকেন্ড পরে দ্বিতীয় আরেকটি ক্ষেপণাস্ত্র আছড়ে পড়ার আগেই সে পরে তার ৮ বছর বয়সী বোন আসিলকে দ্রুত সরিয়ে নেয়। ১১ বছর বয়সী মোহাম্মদও বেঁচে যায়।
পরে হানানের জীবনসঙ্গী আহমেদকে হাসপাতালে নিয়ে গেলে চিকিৎসকরা তাকে মৃত ঘোষণা করেন।
খান ইউনিসের নাসের হাসপাতালে আহত আরেক মেয়ে ইমানের বেডের কিনারে বসে থাকা হানান যেন এখনো ঘোরের মধ্যে আছেন।
“কোথায় যুদ্ধবিরতি?,” প্রশ্ন ছুড়ে দেন এ নারী।
অবশেষে ভাঙাচোরা বাড়িতে ফেরা হচ্ছে- এই উত্তেজনায় পরিবারটি রোববার সকালে ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর ঘোষণা শুনতে পাননি।
ওই ঘোষণায় নেতানিয়াহু জানিয়েছিলেন, প্রথম দিন যে তিন ইসরায়েলি জিম্মিকে হামাস ছেড়ে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে, তাদের নাম হাতে না আসা পর্যন্ত যুদ্ধবিরতি কার্যকর হবে না।
আল-কিদরারা হামাসের ব্যাখ্যাও শুনতে পায়নি, যেখানে ফিলিস্তিনের স্বাধীনতাপন্থি এ সংগঠনটি বলছিল- কারিগরি জটিলতায় তারা নাম দিতে পারছে না, তবে যত দ্রুত সম্ভব তারা দেবে। শেষ পর্যন্ত পৌনে তিন ঘণ্টা পর নাম দেয়ও তারা।
কিন্তু আল-কিদরারা জানতো না যুদ্ধবিরতি শুরু হতে পৌনে তিন ঘণ্টার এ দেরিই তাদের পরিবারটিকে তছনছ করে দেবে।
কেবল তাদের পরিবারের ৩ সদস্যই নয় এই সময়ের ভেতর ইসরায়েলের হামলায় অন্তত ১৯ ফিলিস্তিনি প্রাণ হারিয়েছে, বলছে গাজার বেসামরিক প্রতিরক্ষা সংস্থা।
কথা বলতে বলতে কান্নায় ভেঙে পড়েন হানান। তাকে এখন স্বামী আর দুই সন্তানকে ছাড়াই জীবনের কঠোর বাস্তবতার মুখোমুখি হতে হবে।
এর মধ্যে আলাদা করেই বারবার তার মনে পড়ছিল পরিবারের কনিষ্ঠ সদস্যের কথা, “সামা ছিল সবচেয়ে ছোট, সবচেয়ে আদরের। যখনই আমি আরেকটা সন্তান নেওয়ার কথা বলতাম ও তখনই রেগে যেত।”
আর আদলি ছিল ‘ভরসার কেন্দ্র’। সন্তানরাই ছিল হানানের দুনিয়া।
“পুরো যুদ্ধ সয়েছি আমরা। বাড়ি ছাড়া, বোমাবাজির কঠিন সময় পার করেছি। আমার সন্তানরা ক্ষুধা, খাদ্য ঘাটতি আর জরুরি জিনিসপত্রের অভাব মোকাবেলা করেছে। যুদ্ধের এক বছরেরও বেশি সময় বেঁচে থাকতে পেরেছিলাম আমরা, অথচ শেষ মুহূর্তে তারা চলে গেল। এটা কী করে হতে পারে?,” বলেন তিনি।
ইসরায়েলের ওই শেষবেলার হামলা মুহূর্তেই এ পরিবারের আনন্দকে দুঃস্বপ্নে পরিণত করেছিল। অথচ আগের রাতেই যুদ্ধের অবসান উদ্যাপন করেছিল তারা।
“ইসরায়েলি সেনারা কি আমাদের রক্ত যথেষ্ট পায়নি? ১৫ মাস ধরে যে নির্মমতা চালাচ্ছে তা কি যথেষ্ট হয়নি,” প্রশ্ন ছুড়ে দেন হানান।
পরক্ষণেই তার ভাবনায় চলে আসে ভবিষ্যৎ। স্বামী আর দুই সন্তানকে তার কাছ থেকে কেড়ে নেওয়া হয়েছে।
“আর কী বাকি আছে?,” অশ্রু গড়িয়ে পড়া মুখ থেকে বেরিয়ে আসে তার।