চীনা কোম্পানির টিকটক, অথচ চীনেই নেই কেন?

টিকটকের পরিবর্তে চীনে চলে ডুয়িন, কিছু বৈশিষ্ট্য ছাড়া দুটি অ্যাপ একই রকম।

নিউজ ডেস্কবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 25 March 2023, 01:12 PM
Updated : 25 March 2023, 01:12 PM

যুক্তরাষ্ট্রে টিকে থাকার লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে জনপ্রিয় ভিডিও শেয়ারিং অ্যাপ টিকটক; এর চীনা মালিকরা কোম্পানি বিক্রি করে না দিলে অ্যাপটি নিষিদ্ধে ক্রমাগত চাপ তৈরি হচ্ছে ওয়াশিংটনে।

মজার ব্যাপার হল, চীনা প্রযুক্তিতে তৈরি জনপ্রিয় এই প্ল্যাটফর্মটি চীনেই বন্ধ, সেখানে এর অস্তিত্বই নেই। টিকটকের পরিবর্তে একটি আলাদা ‘সিস্টার অ্যাপ’ ডুয়িন এর প্রচলন রয়েছে দেশটিতে।

এ দুটি অ্যাপই বেইজিংভিত্তিক মূল কোম্পানি বাইটড্যান্সের মালিকানাধীন। ‍ডুয়িন চালু হয়েছিল টিকটকের আগে এবং তা ব্যাপক জনপ্রিয় হয়ে উঠে। পরবর্তীকালে এর শক্তিশালী অ্যালগরিদম টিকটকের ভিত্তি এবং বিশ্বে সফলতার চালিকাশক্তি হয়ে ওঠে। অ্যাপ দুটি চেহারায় একরকম হলেও স্পষ্টত তা পরিচালিত হচ্ছে ভিন্ন নিয়ম মেনে।

বাইটড্যান্সের মালিকানাধীন ডুয়িন ও টিকটকের মধ্যে পার্থক্য কোথায়, যুক্তরাষ্ট্র কেন টিকটক নিষিদ্ধের কথা বলছে এবং সেইসঙ্গে টিকটক নিষিদ্ধ হলে যুক্তরাষ্ট্রে কী প্রভাব পড়বে, এক প্রতিবেদনে তা তুলে ধরেছে সিএনএন।

আসলেই জনপ্রিয়

টিকটকের মতো শর্ট-ফর্ম ভিডিও অ্যাপ ডুয়িন প্রতিদিন প্রায় ৬০ কোটি মানুষ ব্যবহার করে। ২০১৬ সালে যাত্রা শুরু করা এই অ্যাপ টিকটকের আগে বাইটড্যান্সের মুনাফার প্রধান উৎস ছিল।

অন্যদিকে বাইটড্যান্স প্রতিষ্ঠা করেন মাইক্রোসফটের প্রাক্তন কর্মী ঝাং ইমিং। প্রথমদিকে এর নিউজঅ্যাপ জিনরি টুটিয়াও বা ‘টুডেজ হেডলাইনস’র জন্য বাইটড্যান্স পরিচিতি লাভ করে। কোম্পানির প্রতিষ্ঠার পরপর ২০১২ সালে এই নিউজ অ্যাপটি চালু করা হয়েছিল।

টুটিয়াও ব্যবহারকারীর চাহিদা ও প্রয়োজন অনুযায়ী নিউজ ফিড তৈরি করে। লোকজন খুব দ্রুতই সেটি গ্রহণ করে। প্ল্যাটফর্মটিতে ব্যবহারকারীরা প্রতিদিন গড়ে ৭০ মিনিটের বেশি সময় দিচ্ছিলেন। ডুয়িনের ক্ষেত্রেও বাইটড্যান্স একই কৌশল প্রয়োগ করে।

এরপর বেসরকারি প্রযুক্তি কোম্পানিটি যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক একটি স্টার্টআপ কিনে নেয় এবং বিদেশে ডুয়িনের পরিবর্তে টিকটকের আত্মপ্রকাশ ঘটায়। বাইটড্যান্স জনপ্রিয় আরেকটি লিপসিঙ্ক অ্যাপ ‘মিউজিক্যাল.লি’ ২০১৮ সালে কিনে নিয়ে এর ব্যবহারকারীদের টিকটকে ফিরিয়ে নেয়।

সেসময় থেকে টিকটেকর জনপ্রিয়তা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে। ২০২১ সালে বিশ্বে টিকটকের মাসিক সক্রিয় ব্যবহারকারীর সংখ্যা ১০০ কোটিতে পৌঁছায়।

বিউটি ফিল্টার

টিকটক ও ডুয়িনের ইন্টারফেসগুলো দেখতে একই রকম; কিন্তু ব্যবহারকারীরা যখন তাদের ক্যামেরা চালু করেন তখন একটি পার্থক্য স্পষ্ট দেখতে পান। সেটি হল- ডুয়িনে একটি স্বয়ংক্রিয় বিউটি ফিল্টার রয়েছে, যা ত্বককে মসৃণ করার পাশাপাশি ব্যবহারকারীর মুখের আকৃতি পরিবর্তনও ঘটায়।

চীনের নারীরা দীর্ঘকাল ধরে বিউটি স্ট্যান্ডার্ডগুলো মেনে চলতে চাপের মুখোমুখি হয়েছেন। স্লিম ফিগার, আয়ত চোখ, লাবণ্যময় ত্বক ও গালের উঁচু হারকে বিউটি স্ট্যান্ডার্ড ধরে তা মেনে চলার চেষ্টা করেছেন তারা।

চীনে প্লাস্টিক সার্জারির চাহিদাও বাড়ছে। ২০১৪ থেকে ২০১৭ সালের মধ্যে চীনে প্লাস্টিক সার্জারি করা লোকের সংখ্যা বেড়েছে দ্বিগুণেরও বেশি। বিউটি অ্যাপগুলো বিউটি ফিল্টার তৈরিতে প্রতিযোগিতা করে, যা ব্যবহারকারীদের নিজেদের আরও সুন্দর হিসেবে ক্যামেরায় তুলে ধরে।

ডুয়িনের মতো টিকটকেরও বিউটি ফিল্টার আছে। ব্যবহারকারীরা যখন ভিডিও ধারণ করেন, তখন সেটি চালু করতে পারেন। টিকটকে বিউটি ফিল্টারগুলো স্বয়ংক্রিয় চালু হয় না।

কেনাকাটার জন্য অ্যাপ

টিকটক ও ডুয়িনের মধ্যে আরেকটি বড় পার্থক্য রয়েছে চীনের বিশাল অনলাইন শপিং মার্কেটের ক্ষেত্রে। লাইভস্ট্রিম পণ্য বিক্রি চীনে বিলিয়ন ডলারের শিল্পে পরিণত হয়েছে। মহামারীকালে এটি সব থেকে বেশি সম্প্রসারিত হয়েছে।

বেইজিংয়ের বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে সম্পৃক্ত সংস্থা ‘একাডেমি অফ চায়না কাউন্সিল ফর দ্য প্রমোশন অফ ইন্টারন্যাশনাল ট্রেড’ বলছে, গত বছরের জুন পর্যন্ত চীনের মূল ভূখণ্ডে লাইভস্ট্রিমিং ই-কমার্স ব্যবহারকারীর সংখ্যা ছাড়িয়েছে ৪৬ কোটিরও বেশি।

তাওবাও ও আলিবাবার ই-বেসহ অনলাইন মার্কেটপ্লেসের মতো ডুয়িন হল লাইভস্ট্রিমারদের জন্য প্রধান প্লাটফর্ম।

অ্যাপে কেনাকাটা এখন সহজ। পণ্য ও ছাড়ের বিষয়গুলো স্ক্রিনেই দেখানো হয়, এক ক্লিকেই হয়ে যায় কেনাকাটা।

ব্যাপক সেন্সরশিপ

সিএনএন লিখেছে, চীনে রয়েছে বিশ্বের অন্যতম কঠোর সেন্সরশিপ ব্যবস্থা। আর ডুয়িনকেও অবশ্যই সেই নিয়মগুলো মেনে চলতে হয়।

ইন্টারনেটে নজরদারি প্রতিষ্ঠানগুলো নিয়মিত অনলাইনে ভিন্নমত দম করে এবং রাজনৈতিক সংবেদনশীল তথ্য ব্লক করে দেয়।

ডুয়িনে ‘তিয়েনআনমেন ১৯৮৯’ সার্চ করে দেখেছে সিএনএন, তবে তাতে কোনো ফলাফলই না পাওয়ার কথা জানিয়েছে মার্কিন সংবাদমাধ্যমটি।

তিয়েনআনমেন স্কয়ারে ১৯৮৯ সালে গণতন্ত্রের দাবিতে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের উপর সাঁড়াশি অভিযান চালিয়েছিল তখনকার চীন সরকার। সেই ঘটনাকে চীনের ইতিহাসের বইগুলো থেকে মুছে ফেলেছে সরকার। ওই ঘটনা নিয়ে কোনো আলোচনাও কঠোরভাবে নিষিদ্ধ ও নিয়ন্ত্রণ করা হয়।

যখন টিকটকে একই কথা লিখে সিএনএন সার্চ করেছে, তখন ওই ঘটনা নিয়ে অনেক ব্যবহারকারী কথা বলেছেন- এমন ভিডিওসহ সার্চ ফলাফলে অনেক কিছু এসেছে।

“একই কোম্পানির (বাইটড্যান্স) দুই রকমের প্লাটফর্মে এই বৈপরীত্যর বিষয়টি মজার,” বলেন চীনের বিনিয়োগ পরামর্শক কোম্পানি বিডিএ এর প্রতিষ্ঠাতা ও চেয়ারম্যান ডানকান ক্লার্ক।

তরুণ ব্যবহারকারীরা নিয়ন্ত্রণে

দুটি প্লাটফর্মের মধ্যে আরেকটি প্রধান পার্থক্য হল- তরুণ ব্যবহারকারীদের প্রতি কঠোর নীতি মেনে চলে ডুয়িন।

১৪ বছরের কম বয়সীরা কেবল শিশুদের জন্য নির্ধারিত নিরাপদ কনটেন্টগুলো পেতে পারে এবং দিনে ৪০ মিনিটের বেশি ব্যবহার করতে পারে না। তারা রাত ১০ থেকে সকাল ৬টা পর্যন্ত এ অ্যাপ ব্যবহার করতে পারে না।

কয়েক বছর ধরে চীন ভিডিও গেমে আসক্তি এবং অন্যান্য অস্বাস্থ্যকর অনলাইন অভ্যাস রোধের চেষ্টা করেছে। অপ্রাপ্তবয়স্কদের জন্য সপ্তাহের কার্যদিবসগুলোতে অনলাইন গেমিং সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ করার আগে ২০১৯ সালে অনলাইন গেমিংয়ে কারফিউ ঘোষণা করেছিল সরকার।

এমনকি সপ্তাহের ছুটির দিনগুলোতে ১৮ বছরের কম বয়সীদের কেবল তিন ঘণ্টার জন্য অনলাইন গেমিংয়ের সুযোগ দেওয়া হয়।

ক্লার্ক বলেন, “অনলাইন কন্টেন্টের প্রতি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে অনেক বেশি হস্তক্ষেপ না করার মনোভাব রয়েছে, এমনকি কিশোর-কিশোরী আর অনুপযুক্ত ব্যক্তিদের টার্গেট করা কনটেন্টের ক্ষেত্রেও।

“চীনা সরকার ডুইনের পরিসর বাড়ার প্রাথমিক পর্যায়ে বিশেষত অল্পবয়সীদের সুরক্ষার ক্ষেত্রে অনেক বেশি নিয়ন্ত্রণের দিকে ঝুঁকেছে।”

টিকটক একই ধরনের কিছু পদক্ষেপ নেয় এই মাসের শুরুতে। ঘোষণা দেওয়া হয়, ১৮ বছরের কম বয়সী প্রত্যেক ব্যবহারকারী শিগগিরই তাদের অ্যাকাউন্টগুলো দিনে এক ঘণ্টার জন্য ডিফল্ট হিসেবে পাবে; যদিও কিশোর ব্যবহারকারীরা এই নতুন ডিফল্ট সেটিংটি চাইলে বন্ধ করতেও পারবে।

টিকটকই একাই নয়

যুক্তরাষ্ট্রে সফল হওয়া টিকটকই একমাত্র চীনা মালিকানাধীন প্ল্যাটফর্ম নয়। অ্যাপলের অ্যাপ স্টোরে শীর্ষ ১০টি সর্বাধিক জনপ্রিয় বিনামূল্যের অ্যাপের মধ্যে চারটি চীনা প্রযুক্তিতে তৈরি হয়েছে।

টিকটক ছাড়াও শপিং অ্যাপ টেমু, ফাস্ট ফ্যাশন রিটেইলার শিন এবং ভিডিও এডিটিং অ্যাপ ক্যাপকাট রয়েছে, যা বাইটড্যান্সের মালিকানাধীন।

যুক্তরাষ্ট্রে ব্যাপক জনপ্রিয় টিকটকের মাসিক ১৫ কোটি ব্যবহারকারী রয়েছে, যা দেশটির মোট জনসংখ্যার অর্ধেক। এখন জনপ্রিয় এই অ্যাপটি যে নিরাপত্তা হুমকির কারণ নয়, মার্কিন আইনপ্রণেতাদের টিকটক সেটি বোঝাতে পারে কিনা, সেটিই এখন দেখার বিষয়।

কিন্তু ওয়াশিংটনে কর্মকর্তাদের তোড়জোড়কে নিরাপত্তা ও ডেটার গোপনীয়তা সম্পর্কে বৃহত্তর প্রশ্নগুলোই তুলে ধরছে, যাতে অন্যান্য অ্যাপগুলো বহিষ্কারের আওতায় আসতে পারে।

ডানকান ক্লার্ক বলেন, মার্কিন বিনিয়োগকারী ও বিদেশি প্ল্যাটফর্মগুলোতে ব্যবহারকারীর সংখ্যা বিবেচনা করে যুক্তরাষ্ট্রে বড় প্রযুক্তি সংস্থাগুলোকে নিয়ন্ত্রণে আরও পরিশীলিত কাঠামো প্রয়োজন।

“তাদের এও ভাবা দরকার যে, ওই প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানগুলো যুক্তরাষ্ট্রে চীনা বিনিয়োগ কতটা বাড়াবে এবং শীর্ষ দশটি অ্যাপের মধ্যে চারটিকে সম্পূর্ণভাবে বাদ দেওয়ার পরিণতি কী হবে।”

“এগুলোর পরিবর্তে কী আসবে? কীভাবে সেগুলো গড়ে উঠবে? সেইসঙ্গে নতুন অ্যাপগুলো বিনিয়োগকারীদের কাছে কীভাবে যুক্তিসঙ্গত হয়ে উঠবে?...এটি জগাখিচুড়ি”, বলেন ক্লার্ক।