যেখানে মানুষের জায়গা এরইমধ্যে দখল করছে এআই

মানুষের কর্মক্ষেত্রে এআই এর সর্বশেষ ধাক্কাটা লাগে গতবছর ওপেনএআই এর চ্যাটজিপিটি চালুর পর, যা কয়েক মিনিটের মধ্যে প্রবন্ধ, বক্তৃতা এমনকি রেসিপিও লিখে দিতে পারে।

নিউজ ডেস্কবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 17 June 2023, 04:28 AM
Updated : 17 June 2023, 04:28 AM

এইত কদিন আগেও একটি ছোট মার্কেটিং কোম্পানির কপিরাইটার ছিলেন ডিন মেডোক্রফট, তার কাজ ছিল সংবাদ বিজ্ঞপ্তি ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে পোস্ট লেখার পাশাপাশি কোম্পানির জন্য অন্যান্য কনটেন্ট তৈরি করা।

গত বছরের শেষ দিকে তার কোম্পানি এসব কাজের ভার দেয় একটি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা এআই সিস্টেমের ওপর।

মেডোক্রফট বলেন, শুরুর দিকে আমাদের ধারণা ছিল, মানুষের পাশাপাশি এই প্রযুক্তি কাজ করবে, যাতে কপিরাইটিংয়ের কাজটা দ্রুত গতিতে করা যায়, যাতে কাজটা আরো একটু ভালোভাবে করা যায়।

কিন্তু এআই যা করছিল, তাতে সন্তুষ্ট হতে পারেননি মেডোক্রফট।

তার কথায়, এআইয়ের লেখা কপিগুলো যেন মানুষকে রাস্তার মাঝখানে ছেড়ে দেয়, কিংবা বেড়ার সামনে দাঁড় করিয়ে দেয়। আর সব কপি যেন একই রকম। ফলে কেউ সেগুলো খুব একটা আমলে নেয় না।

তাছাড়া এআই যা লিখেছে তা অন্য কোথাও থেকে মেরে দেওয়া কিনা, সেটা নিশ্চিত হতে কোম্পানির কর্মীদেরই আবার যাচাই করতে হয়।

তবে এআই কাজটা করছিল খুব দ্রুত। একজন মানব কপিরাইটারের যেটা লিখতে এক থেকে দেড় ঘণ্টা লাগে, সেখানে এআই করছিল ১০ মিনিট বা তার কম সময়ে।

বিবিসি জানিয়েছে, কপিরাইটিংয়ের কাজে এআই চালুর চার মাস পর মেডোক্রফটসহ ওই বিভাগের চার কর্মীর সবাইকে ছাঁটাই করা হয়।

এআই যে মানুষের জায়গা দখল করে নিচ্ছে, তা নিয়ে এখন আর কোনো সন্দেহ নেই মেডোক্রফটের।

“অথচ এআই লেখকদের জায়গা দখল করবে, কিংবা এআইয়ের কারণে মানুষের চাকরি যাবে– এমন কথা শুনলে আমি আগে হাসাহাসি করতাম,” বলেন তিনি।

মানুষের কর্মক্ষেত্রে এআই এর সর্বশেষ ধাক্কাটা লাগে গতবছর ওপেনএআই এর চ্যাটজিপিটি চালুর পর। মাইক্রোসফট সমর্থিত চ্যাটজিপিটি মানুষের মত প্রশ্নের উত্তর দিতে পারে। কয়েক মিনিটের মধ্যে প্রবন্ধ, বক্তৃতা এমনকি রেসিপিও লিখে দিতে পারে।

অন্যান্য প্রযুক্তি কোম্পানিও এখন নিজস্ব সিস্টেম চালু করতে উঠেপড়ে লেগেছে। এরই মধ্যে গত মার্চে গুগল চালু করেছে বার্ড। পুরোপুরি নিখুঁত না হলেও এ ধরনের সিস্টেমগুলোকে ইন্টারনেটের বিপুল তথ্যভাণ্ডার ব্যবহার করে কাজ করতে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে, যে পরিমাণ তথ্য হজম করা মানুষের পক্ষে অসম্ভব।

ফলে স্বাভাবিকভাবেই অনেকের প্রশ্ন জাগছে, কোন খাতের কর্মীরা সবচেয়ে বেশি চাকরি হারানোর ঝুঁকিতে রয়েছেন। 

চলতি বছরের শুরুর দিকে যুক্তরাষ্ট্রের বিনিয়োগ ব্যাংক গোল্ডম্যান স্যাকস এক প্রতিবেদনে বলে, ৩০ কোটি পূর্ণকালীন কর্মীর জায়গা দখল করার সম্ভাবনা রাখে এআই।

তবে এর প্রভাব সব খাতে সমানভাবে পড়বে না। গোল্ডম্যান স্যাকসের প্রতিবেদন বলছে, প্রশাসনিক ক্ষেত্রে ৪৬ শতাংশ, আইন পেশায় ৪৪ শতাংশ কাজ কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার দখলে চলে যেতে পারে। আবার নির্মাণ কাজের ৬ শতাংশ এবং রক্ষণাবেক্ষণ কাজের ৪ শতাংশ জায়গা দখল করতে পারে এআই।

ওই প্রতিবেদনে এটাও বলা হয়েছে, মানুষের কর্মক্ষেত্র দখল করলেও এআই উৎপাদন ও প্রবৃদ্ধি বাড়ানোর পাশাপাশি নতুন চাকরির সুযোগও তৈরি করতে পারে। 

বিবিসি জানিয়েছে, এআই ব্যবহারের এসব সুবিধার কিছু প্রমাণও ইতোমধ্যে মিলেছে। ফার্নিচার কোম্পানি ইকিয়া বলছে, ২০২১ সাল থেকে তারা কল সেন্টার ও ডিজাইন বিভাগে কাজ করা সাড়ে আট হাজার কর্মীকে পুনঃপ্রশিক্ষণ দিয়েছে। এখন তাদের গ্রাহকদের ৪৭ শতাংশ ফোন কল বিলি নামের একটি এআই প্রযুক্তিতে পরিচালিত হয়। এআই ব্যবহারে ইকিয়ার কেউ চাকরি না হারালেও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার এই বিকাশ কর্মীদের উদ্বিগ্ন করে তুলছে।

সম্প্রতি বিশ্বের বিভিন্ন দেশের ১২ হাজার কর্মীর ওপর একটি জরিপ চালিয়েছে বস্টন কনসাল্টিং গ্রুপ (বিজিসি)। তাতে দেখা গেছে, জরিপে অংশ নেওয়া এক তৃতীয়াংশ কর্মী মনে করেন, এআই তাদের জায়গা দখল করবে। আর ব্যবস্থাপকদের চেয়ে সামনের সারির কর্মীরাই এ নিয়ে বেশি দুঃশ্চিন্তায়।

এর কারণ হিসেবে বিজিসির জেসিকা অ্যাপোথেকার বলেন, এই উদ্বেগের একটি কারণ হয়ত তৈরি হয়েছে না জানা থেকে।

জরিপে দেখা গেছে, কোনো কোম্পানির নেতৃস্থানীয় ব্যক্তি এবং ব্যবস্থাপনায় থাকা কর্মকর্তাদের ৮০ শতাংশ সপ্তাহে একবার হলেও এআই ব্যবহার করেন। কিন্তু সামনের সারির কর্মীদের ক্ষেত্রে এই হার মাত্র ২০ শতাংশ। ফলে আস্ন্ন প্রযুক্তিগুলো সম্পর্কে ধারণা না থাকায় তাদের উদ্বেগ আর দুঃশ্চিন্তা অনেক বেশি।

উদ্বিগ্ন হওয়ার সঙ্গত কারণও আছে। আলেহান্দ্রো গ্রাউ গত বছর তিন মাস একটি জনপ্রিয় ইউটিউব চ্যানেলে কণ্ঠ দেওয়ার কাজ করেছিলেন। ওই কাজকে বেশ ‘সম্ভাবনাময়’ মনে হয়েছিল তার কাছে। ওই ইউটিউব চ্যানেলের সব ইংরেজি ভাষার কনটেন্টে স্প্যানিশ ভাষায় কণ্ঠ দেওয়া ছিল তার কাজ।  

গত বছরের শেষ দিকে গ্রাউ ছুটিতে যন। ছুটি থেকে ফিরে ওই কাজেই যোগ দেওয়ার কথা ছিল তার।

গ্রাউ বলেন, “আমি ভেবেছিলাম, এ কাজ থেকেই জীবন ধারণের জন্য যথেষ্ট অর্থ আমি উপার্যন করতে পারব। আমার দুটো মেয়ে আছে, আমার টাকার দরকার।”

কিন্তু ছুটি শেষে কাজে ফেরার আগেই তিনি দেখলেন, ওই ইউটিউব চ্যানেলে স্প্যানিশ ভাষার একটি নতুন ভিডিও আপলোড হয়েছে, যেটায় তিনি কণ্ঠ দেননি।

“সেই ভিডিওতে ক্লিক করার পরে দেখলাম আমার কণ্ঠ নয়। সেটা এআই ব্যবহার করে তৈরি স্বর, খুব বাজে একটি ভয়েসওভার, জঘন্য।

“ভাবছিলাম, এটা কী। এটাই কি তাহলে আমার নতুন সঙ্গী হতে চলেছে? নাকি এটা আমার জায়গা দখল করতে চলেছে?”

পরে সেই স্টুডিওতে ফোন করে তিনি নিশ্চিত হন, সেই চ্যানেল কর্তৃপক্ষ এআই ব্যবহার করে পরীক্ষা করে দেখতে চেয়েছে, কারণ এটা সস্তা আর দ্রুত কাজ করে।

গ্রাউ জানান, সেই পরীক্ষা ব্যর্থ হয়। দর্শকরা ভয়েসওভারের মান নিয়ে আপত্তি তোলেন। অবশেষে চ্যানেলটি এআই ভয়েসযুক্ত সেই ভিডিও সরিয়ে নেয়।

কিন্তু গ্রাউ খুব একটা স্বস্তি পাননি। তার ভয়, এই প্রযুক্তির উন্নতি ঘটবে, যা তার মত কণ্ঠ দেওয়া শিল্পীদের উৎখাত করবে।

গ্রাউ বলেন, “আমার প্রত্যেক চাকরিতেই যদি এটা ঘটতে থাকে, তাহলে কী করা উচিত? আমার কি একটা খামার কেনা উচিত না? আমি ঠিক জানি না, অন্য আর কী চাকরির সন্ধান করতে পারি যেখানে ভবিষ্যতে এই প্রযুক্তি আমার কাজ দখল করে নেবে না? বিষয়টা জটিল।”

তার এখন মনে হচ্ছে, এমন কোনো কাজের কথা হয়ত ভাবতে হবে, যেখানে এআই দিয়ে কাজ করানোই হল কাজ।

এআই এর কারণে চাকরি হারানো সাবেক কপিরাইটার ডিন মেডোক্রফট কয়েক মাস কাটিয়েছেন ফ্রিল্যান্সিং করে। তারপর তার ক্যারিয়ার নতুন দিকে মোড় নেয়।

তিনি এখন একটি কর্মী সহায়তা কোম্পানিতে কাজ করেন, যারা কর্মীদের সুস্থতা ও মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ে পরামর্শ দেয়। আর এ কাজটি তাকে করতে হয় এআই ব্যবহার করে।

“আমি মনে করি এখানেই এআই এর ভবিষ্যত; যা মানুষকে একেবারে সরিয়ে না দিয়ে মানুষের কাজগুলো দ্রুত সমাধা করতে ভূমিকা রাখবে।”