অভিযোগ বলছে, ২০১৭ সালে ইসরায়েলের সুপ্রিম কোর্টের এক রায়ে মিয়ানমারে প্রতিরক্ষা প্রযুক্তি বিক্রি নিষিদ্ধ হওয়ার পরও এই চুক্তি হয়েছে।
Published : 16 Jan 2023, 01:38 PM
মিয়ানমার সামরিক বাহিনীর ক্ষমতা দখলের আগে দেশটির রাষ্ট্রায়ত্ত টেলিযোগাযোগ কোম্পানির কাছ থেকে নজরদারির এক স্পাইওয়্যার বিক্রির টেন্ডার জিতেছিল ইসরাইলের সফটওয়্যার কোম্পানি ‘কগনাইট সফটওয়্যার লিমিটেড’।
সম্প্রতি ইসরায়েলের অ্যাটর্নি জেনারেলের কাছে দায়ের করা অভিযোগ বলছে, ২০১৭ সালে ইসরায়েলের সুপ্রিম কোর্টের এক রায়ে মিয়ানমারে প্রতিরক্ষা প্রযুক্তি বিক্রি নিষিদ্ধ হওয়ার পরও এই চুক্তি হয়েছে।
রাষ্ট্রের অনুরোধে ওই বিরল নিষেধাজ্ঞা গোপনীয় বিষয় হলেও ইসরায়েলের সরকার বেশ অনেকবারই মিয়ানমারে প্রতিরক্ষা রপ্তানি নিষিদ্ধের বিষয়টি প্রকাশ্যেই উল্লেখ করেছে বলে প্রতিবেদনে বলেছে রয়টার্স।
মামলাটি হয়েছে ইসরায়েলের মানবাধিকার বিষয়ক শীর্ষ আইনজীবী ইতাই মাকের নেতৃত্বে। মিয়ানমারের সঙ্গে চুক্তির ফৌজদারি তদন্তের আহ্বান জানিয়েছেন তিনি। মামলায় কগনাইট এবং দেশটির প্রতিরক্ষা ও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অজ্ঞাত কিছু কর্মকর্তার বিরুদ্ধে অভিযোগ, তারা এমন চুক্তি তত্ত্বাবধান করে মিয়ানমারকে ‘মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ পরিকল্পনায় সহায়তার পাশাপাশি তাদের উৎসাহ’ দিয়েছেন।
রয়টার্সের প্রতিবেদন অনুযায়ী, দেশটির সাবেক স্পিকার, অধিকারকর্মী, শিক্ষাবিদ ও লেখক’সহ ৬০ জনের বেশি ইসরায়েলি নাগরিকের পক্ষে এই মামলা হয়েছে।
‘জাস্টিস ফর মিয়ানমার’ নামের এক অধিকার সংগঠনের কাছ থেকে এই চুক্তির নথি পেয়েছে রয়টার্স। এটি আসলে ২০২১ সালের জানুয়ারিতে মিয়ানমারের রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা ‘মিয়ানমার পোস্ট অ্যান্ড টেলিকমিউনিকেশনস (এমপিটি)’র কাছ থেকে ইসরাইলে নিয়ন্ত্রক সংস্থার কাছে পাঠানো এক পত্র।
এই পত্রে ‘ইন্টারসেপ্ট’ নামে পরিচিত এই প্রযুক্তি বিক্রির বিজয়ী কোম্পানি হিসেবে কগনাইটের নাম তালিকাভুক্ত করা হয়েছে। এর ক্রয় আদেশ জারি হয়েছে ২০২০ সালের ৩০ ডিসেম্বরের মধ্যে।
স্পাইওয়্যারটি টেলিকম বা ইন্টারনেট কোম্পানির সহায়তা ছাড়াই নিয়ন্ত্রকদের বিভিন্ন কল শোনার, টেক্সট মেসেজ ও ইমেইল দেখার ক্ষমতা দিতে পারে।
এই বিষয়ে কগনাইটের মুখপাত্র, মিয়ানমারের সামরিক সরকার ও এমপিটি’র সঙ্গে একাধিকবার যোগাযোগ করলেও তাদের পক্ষ থেকে কোনো জবাব মেলেনি।
এমপিটি’তে শেয়ার থাকা জাপানের টেলিযোগাযোগ কোম্পানি ‘কেডিডিআই কর্পোরেশন’ ও ‘সুমিতোমো কর্পোরেশনের’ সঙ্গে রয়টার্স যোগাযোগ করলে তারাও এই বিষয়ে কোনো মন্তব্য করতে রাজী হয়নি।
এই অভিযোগ সম্পর্কে জানতে রয়টার্স ইসরায়েলের অ্যাটর্নি জেনারেল ও দেশটির পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে যোগাযোগ করলে কোনো জবাব মেলেনি। এই বিষয়ে কোনো মন্তব্য করতে রাজি হয়নি দেশটির প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়।
স্পাইওয়্যারটি নিয়ে মিয়ানমারের পরিকল্পনা সম্পর্কে অবগত দুই ব্যক্তি রয়টার্সকে বলেছেন, কগনাইটের এই নজরদারি ব্যবস্থা পরীক্ষা করে দেখেছে এমপিটি। মিয়ানমারের সামরিক সরকার ‘জান্তা’র ভয়ে তারা নিজেদের পরিচয় দিতে রাজী হননি।
এই বিষয়ে সরাসরি জানা আছে এমন এক সূত্র ও তিন ব্যক্তি রয়টার্সকে এমপিটি’র স্পাইওয়্যার ব্যবহারের বিষয়টি জানিয়েছে। তারা অবশ্য সরবরাহকারীর পরিচয় শনাক্ত করতে পারেননি।
কগনাইটের সঙ্গে এই প্রযুক্তি কেনার চুক্তি এমপিটি চূড়ান্ত করেছিল কি না, সেটি নিশ্চিত হতে পারেনি রয়টার্স।
সামরিক অভ্যুত্থানের আগে ২০১৭ সালে অং সান সুচি’র সরকার ক্ষমতায় থাকাকালীন দেশটির সামরিক বাহিনী রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর ওপর নৃশংস দমন-পীড়ন চালিয়েছিল। সে সময় মিয়ানমারে প্রতিরক্ষা রপ্তানি নিয়ে ইসরায়েলের জনসাধারণের উদ্বেগ বেড়ে গিয়েছিল বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছে রয়টার্স।
এই ক্র্যাকডাউনের পর ইসরায়েলের সুপ্রিম কোর্টে মাকের নেতৃত্বে একটি আবেদন করা হয়। এতে তিনি আদালতকে মিয়ানমারে অস্ত্র রপ্তানি নিষিদ্ধ করার অনুরোধ জানান।
জাতিসংঘের তথ্য অনুযায়ী, মিয়ানমারে সামরিক অভ্যুত্থানের পর থেকে রাজনৈতিক বিরোধী’সহ হাজার হাজার মানুষ হত্যা করেছে জান্তা।
রোষানলে কগনাইট
সাইবার নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, বিশ্বের অনেক সরকারই অপরাধী ধরার উদ্দেশ্যে নিজস্ব আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোকে ‘আইনসম্মত তদন্তের’ অনুমতি দেয়। তবে, সাধারণত কোনো আইনি প্রক্রিয়া ছাড়া এইসব প্রযুক্তির প্রয়োগ ঘটে না।
এর আগে রয়টার্সকে সাক্ষাৎকার দেওয়া শিল্প নির্বাহী ও অধিকারকর্মীদের বক্তব্যে উঠে আসে, মিয়ানমারের জান্তা মানবাধিকার সুরক্ষার বিষয়টি উপেক্ষা করেই স্পাইওয়্যারটি ব্যবহার করেছে।
ম্যাক বলেন, টেন্ডারে কগনাইটের অংশগ্রহণ ‘মিয়ানমারে কোনো নিরাপত্তা ব্যবস্থা রপ্তানি হয়নি’ বলে ইসরায়েলি কর্মকর্তাদের দেওয়া বক্তব্যকে মিথ্যা প্রমাণ করে।
নাগরিক ও প্রতিরক্ষা বিষয়ক বিভিন্ন কার্যক্রমের উদ্দেশ্যে তৈরি স্পাইওয়্যারটি ‘দ্বৈত ব্যবহারের’ প্রযুক্তি হিসেবে বর্ণিত হলেও ইসরায়েলের আইনে এমন প্রযুক্তি ‘প্রতিরক্ষা সরঞ্জাম’ হিসেবে শ্রেণিভুক্ত।
ইসরায়েলি আইনে প্রতিরক্ষা-সম্পর্কিত পণ্য রপ্তানিকারী সংস্থাগুলোকে চুক্তির সময় রপ্তানি ও বিপণনের জন্য লাইসেন্স নিতে হয়।
আইনি অভিযোগ অনুসারে, মিয়ানমারের সঙ্গে চুক্তির জন্য যেসব কর্মকর্তা কগনাইটকে লাইসেন্স দিয়েছেন, তাদের বিরুদ্ধে তদন্ত হওয়া উচিৎ। কোম্পানিটি আদৌ এমন লাইসেন্স নিয়েছিল কি না, সেটি নিশ্চিত হতে পারেনি রয়টার্স।