পতনের সূত্রপাত ঘটে ২০১৫ সালে, যখন কোম্পানির একাধিক বিভাগে দুর্নীতির অভিযোগ প্রকাশ্যে আসে। ওই দুর্নীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন কোম্পানির শীর্ষ কর্মকর্তারাও।
Published : 20 Dec 2023, 03:56 PM
৭৪ বছরের দীর্ঘপথ পাড়ি দেওয়ার পর টোকিও’র স্টক এক্সচেঞ্জ থেকে নাম মুছে গেছে জাপানের ইলেকট্রনিক জায়ান্ট ‘তোশিবা’র।
একটা সময় ছিল, যখন অনেকের বাড়িতেই তোশিবার তৈরি একাধিক পণ্যের দেখা মিলত। হোক সেটা টিভি, কম্পিউটার, স্পিকার সিস্টেম বা অন্য কোনো ইলেকট্রনিক গ্যাজেট।
বিবিসি বলছে, এক সময় জাপানের ইলেকট্রনিক খাতের ‘পোস্টার বয়’ হিসেবে পরিচিতি পাওয়া কোম্পানিটি টোকিও’র স্টক এক্সচেঞ্জ থেকে নিজেদের নাম সরিয়ে নিয়েছে, যার ফলে দেশটির শেয়ারবাজারের সঙ্গে কোম্পানির ৭৪ বছর দীর্ঘ ইতিহাসের অবসান ঘটল।
জাপানের প্রযুক্তি শিল্পের অন্যতম জনপ্রিয় নামটির এ অধঃপতনের কারণ কী, এমন প্রশ্ন অনেকের মনেই থাকতে পারে?
এর সূত্রপাত ঘটে ২০১৫ সালে, যখন কোম্পানির একাধিক বিভাগে দুর্নীতির অভিযোগ জনসমক্ষে আসে। আর এ দুর্নীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন কোম্পানির শীর্ষ পর্যায়ের কর্তারাও।
বিবিসি’র প্রতিবেদন অনুযায়ী, সাত বছরে সর্বমোট ১৫৯ কোটি ডলারের মুনাফা বাড়িয়ে বলেছে তোশিবা।
২০২০ সালে কোম্পানির হিসাব বিভাগে আরও অনিয়ম ধরা পরে।
এ ছাড়া, কোম্পানির কর্পোরেট ব্যবস্থাপনা ও অংশীদারদের সিদ্ধান্ত নেওয়ার ধরন নিয়েও অভিযোগ এসেছে।
২০২১ সালের এক তদন্তে উঠে আসে, জাপানের বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে গোপনে আঁতাত করেছে তোশিবা, যারা কোম্পানিটিকে মূল্যায়ন করেছে ‘বিদেশী বিনিয়োগকারী আকৃষ্ট করার কৌশলগত সম্পদ’ হিসেবে।
সে সময় বিশেষজ্ঞরা বলেন, এ খবর প্রকাশের পর জাপানের শেয়ারে বিনিয়োগ করার বিষয়ে অনিশ্চিত হয়ে পড়েন বিদেশী বিনিয়োগকারীরা। ফলে এটি শুধু তোশিবা’র একার নয়, বরং জাপানের গোটা শেয়ার বাজারের সমস্যার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছিল।
২০১৬ সালের শেষ দিকে তোশিবা বলেছিল, তারা একটি পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ খরচ বাবদ কয়েকশ কোটি ডলার খরচ করবে, যা এর এক বছর আগে মার্কিন কোম্পানি ‘ওয়েস্টিংহাউস ইলেকট্রিক’ কিনেছিল।
এর তিন মাস পরই নিজেদের দেউলিয়া ঘোষণা করে ওয়েস্টিংহাউজ। ফলে, নিজেদের পারমাণবিক ব্যবসায় বড় ধাক্কার মুখে পড়ার পাশাপাশি ছয়শ কোটি ডলারের বেশি লোকসান গুণতে হয় তোশিবাকে।
এর পরপরই নিজেদের একাধিক ব্যবসা বিক্রি করে দিতে বাধ্য হয় কোম্পানিটি, যার মধ্যে রয়েছে স্মার্টফোন, মেডিকেল ও ইলেকট্রনিক পণ্য ব্যবসাও।
পরবর্তীতে, নিজেদের চিপ নির্মাণ বিভাগ ‘তোশিবা মেমোরি’ও বিক্রি করতে বাধ্য হয় কোম্পানিটি। এ ছাড়া, কোম্পানির এক অংশীদারের দ্বিমত থাকায় এ অধিগ্রহণের চুক্তি পিছিয়েছে বেশ কয়েক মাস।
বিভিন্ন কোম্পানি যখন ভবিষ্যৎ প্রযুক্তি ও উদ্ভাবনের পেছনে ব্যাপক বিনিয়োগ চালাচ্ছিল, ঠিক তখনই আর্থিক তহবিল তুলতে নিজেদের সাজানো গোছানো ব্যবসাগুলো বিক্রি করতে হয়েছে তোশিবাকে।
২০১৭ সালের শেষ নাগাদ বিদেশী বিনিয়োগকারীদের কাছ থেকে ৫৪০ কোটি ডলার তুলতে পেরেছিল তোশিবা, যার সহায়তায় সেবারের মতো শেয়ারবাজার তালিকায় টিকে যায় কোম্পানিটি।
তবে, পরবর্তীতে কোম্পানির পরিচালনা ব্যবস্থা নিয়ে প্রতিবাদ করেন কয়েকজন অংশীদার। এর ফলে, নিজেদের ব্যাটারি, চিপ, পারমাণবিক ও সামরিক যন্ত্র উৎপাদন খাতে দীর্ঘকালীন চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ে কোম্পানিটি।
কোম্পানিটিকে ভেঙে ছোট ছোট কোম্পানি তৈরি করা উচিৎ কি না, তা নিয়েও দীর্ঘ আলোচনা হয় তোশিবার অংশীদারদের মধ্যে। পরবর্তীতে কোম্পানিকে ব্যক্তিমালিকানাধীন করা যায় কি না, তার উপায় খুঁজে দেখতে একটি কমিটিও গঠন করে তোশিবা।
২০২২ সালের জুনে আটটি অধিগ্রহণের প্রস্তাব পায় তোশিবা।
এ বছরের শুরুতে তোশিবা নিশ্চিত করে, এক হাজার চারশ কোটি ডলারে কোম্পানিটি অধিগ্রহণ করছে রাষ্ট্রায়ত্ত জাপানী বিনিয়োগকারী গ্রুপ ‘জাপান ইনভেস্টমেন্ট কর্পোরেশন (জেআইসি)’।
নতুন মালিকরা তোশিবার ঘুরে দাঁড়ানোর বিষয়ে কী ধরনের পরিকল্পনা করছে, তা এখনও পরিষ্কার নয়। তবে, কোম্পানির বিদায়ী চেয়ারম্যান বলেছেন, কোম্পানির মূল মনযোগগুলোর একটি হবে লাভজনক ডিজিটাল সেবা।
অতীতে, সনির ল্যাপটপ বিভাগ ও অলিমপাসের ক্যামেরা বিভাগের মতো শীর্ষ উৎপাদন ব্যবসা ঢেলে সাজাতে দেখা গেছে জেআইসিকে।
এ ছাড়া, ২০১৪ সালে সনির ‘ভায়ো’ ল্যাপটপের ব্যবসা অধিগ্রহণের পর এ বছর কোম্পানিকে নিজেদের সেরা বিক্রির রেকর্ড অর্জনে সহায়তা করেছে বিনিয়োগ গ্রুপটি।
তবে, তোশিবা এর চেয়েও বড় কোম্পানি হওয়ায় এতে ঝুঁকিও বেশি। বর্তমানে প্রায় এক লাখ ছয় হাজার কর্মসংস্থান দেওয়া কোম্পানিটির কিছু কিছু কাজ দেশটির জাতীয় নিরাপত্তার ক্ষেত্রেও গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে বিবেচনা করা হয়।