ইন্টারনেট থেকে পাওয়া বিশাল ডেটায় থাকতে পারে বৈষম্যের উপাদান। বিভিন্ন এআই মডেল বা টুল প্রশিক্ষণেও এগুলো ব্যবহৃত হলে সেটাই হবে সবচেয়ে বড় উদ্বেগের বিষয়।
Published : 14 Jun 2023, 04:46 PM
দ্রুতগতিতে বিকশিত হতে থাকা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ব্যবস্থায় মানব বিলুপ্তির চেয়েও বড় শঙ্কা বৈষম্য নিয়ে– এমনই বলছেন ‘ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ)’র প্রতিযোগিতা প্রধান মারগ্রেথ ভেস্টেগার।
এই প্রযুক্তির সবচেয়ে বড় ঝুঁকিগুলো মোকাবেলায় ‘পর্যাপ্ত ব্যবস্থা’ প্রয়োজন, বিবিসিকে বলেন ভেস্টেগার।
তিনি আরও বলেন, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা এমনসব সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হতে পারে, যা সম্ভবত জীবিকার ওপর প্রভাব ফেলবে। উদাহরণ হিসেবে ধরা যাক, কেউ সম্পত্তি বন্ধকের জন্য আবেদন করতে পারবেন কি না সেটি যাচাই করার মতো বিষয়।
বুধবার কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার জন্য প্রস্তাবিত নীতিমালা নিয়ে ভোটাভুটি করবে ইউরোপীয় পার্লামেন্ট।
সাধারণত মানব বুদ্ধির প্রয়োজন পড়ে এমন সব কাজ করতে সক্ষম এই প্রযুক্তির বিকাশ নিয়ে উদ্বেগ সৃষ্টির পর ‘এআই অ্যাক্ট’ নামের সম্ভাব্য আইনটি বিবেচনায় রেখেছেন সেখানকার রাজনীতিবিদরা।
বিশেষজ্ঞরা সতর্কবার্তা দিয়েছেন, মানুষকে বিলুপ্তির দিকে নিয়ে যেতে পারে এআই।
তবে ভেস্টেগার বলছেন, এআই’র ঝুঁকি রয়েছে পক্ষপাত বা বৈষম্য বাড়ানোয় ব্যবহারের মধ্যে। ইন্টারনেট থেকে পাওয়া বিশাল পরিমাণ ডেটার মধ্যে থাকতে পারে বৈষম্যের উপাদান। বিভিন্ন এআই মডেল বা টুল প্রশিক্ষণেও এগুলো ব্যবহৃত হতে পারে। আর সেটাই সবচেয়ে বড় উদ্বেগের বিষয়।
“সম্ভবত মানব অস্তিত্ব হারিয়ে যাওয়ার ভয়টি থেকেই যাবে। তবে, আমি মনে করি এর সম্ভাবনা খুবই ক্ষীণ। আমার ধারণা, এর চেয়েও বড় শঙ্কা হলো এর ফলে মানুষের মধ্যে বৈষম্যের প্রবণতা বাড়বে।” --বলেন তিনি।
“ব্যাংক যদি এআই ব্যবহার করে সিদ্ধান্ত নিতে চায়, একজন মর্টগেজ পাওয়ার যোগ্য কি না, বা পৌরসভার কোনো পরিষেবা পাওয়ার যোগ্য কি না, আপনি অবশ্যই নিশ্চিত করতে চাইবেন যে, লিঙ্গ, বর্ণ বা পোস্টাল কোডের কারণে আপনি যেন বৈষম্যের শিকার না হন।”
মঙ্গবার আয়ারল্যান্ডের ডেটা সুরক্ষা কর্তৃপক্ষ ডিপিসি বলেছে, তারা ইইউ’তে গুগলের চ্যাটবট বার্ড চালুর কার্যক্রম আটকে রেখেছে।
সংস্থাটি বলেছে, এই সপ্তাহে চ্যাটজিপিটির প্রতিদ্বন্দ্বী চ্যাটবটটি ইউরোপে চালু করার বিষয়টি গুগল তাদের জানিয়েছে। তবে, সম্ভাব্য ব্যবহারকারীদের ডেটা সুরক্ষা সংশ্লিষ্ট ঝুঁকি শনাক্তের পাশাপাশি কোম্পানি কীভাবে সেগুলো কমিয়ে আনার চেষ্টা করেছে, সে সম্পর্কে বিস্তারিত কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি।
ডিপিসি’র ডেপুটি কমিশনার গ্রাহাম ডয়েল বলেন, সংস্থাটি ‘দ্রুততার সঙ্গে’ এইসব তথ্য চাচ্ছে। আর ডেটা সুরক্ষা নিয়েও গুগলের কাছে বাড়তি তথ্য জানতে চেয়েছে তারা।
‘জাতিসংঘের পদ্ধতি’
বিবিসিকে দেওয়া বিশেষ সাক্ষাৎকারে ইউরোপীয় কমিশনের নির্বাহী ভাইস প্রেসিডেন্ট ভেস্টেগার বলেন, এআই’র নিয়ন্ত্রণ ‘বৈশ্বিক বিষয়’ হতে হবে।
তবে আইনটি নিয়ে ইউরোপীয় পার্লামেন্টের ভোটাভুটির আগে তিনি জোর দিয়ে বলেন, চীনের মতো আরও কঠোর ব্যবস্থা চালুর আগে ‘সমমনা’ দেশগুলোর ঐক্যমতকে অগ্রাধিকার দেওয়া উচিৎ।
“আমরা জাতিসংঘের পদ্ধতিতে কাজ শুরু করতে পারি। তবে, আমাদের হাত পা গুটিয়ে বসে থাকলে চলবে না।” --বলেন তিনি।
“আমদের পক্ষে এখন যা করা সম্ভব, সেটাই করা উচিত।”
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ইউরোপের এক ঐচ্ছিক যৌথ আচরণবিধি তৈরির উদ্যোগে ইউরোপীয় ইউনিয়ন অংশের নেতৃত্ব দিচ্ছেন ভেস্টেগার। এটি করা সম্ভব হলে এআই নির্মাতাদের কোনো আইনি বাধ্যবাধকতা মুক্ত একটি মান গ্রহন করতে হতে পারে।
‘বাস্তববাদী’ হওয়া
এআই অ্যাক্টের খসরায় কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার বিভিন্ন প্রয়োগকে গ্রাহকের জন্য ঝুঁকির স্তর হিসাবে শ্রেণিবদ্ধ করার বিষয়টি উল্লেখ রয়েছে। আর এতে এআই চালিত ভিডিও গেইম বা স্প্যাম ফিল্টারগুলো আছে সবচেয়ে কম ঝুঁকির বিভাগে।
উচ্চ ঝুঁকির এআই ব্যবস্থার মধ্যে রয়েছে ঋণের জন্য ‘ক্রেডিট স্কোর’ মূল্যায়ন বা ও হাউজিংয়ে প্রবেশাধিকারের মতো বিষয়গুলো। আর এই প্রযুক্তি কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণের মূল মনযোগ এখানেই।
তবে, এআই’র দ্রুত বিকাশ অব্যাহত থাকায় ভেস্টেগার বলেন, এই প্রযুক্তি ঘিরে বিভিন্ন নিয়ম সূক্ষ্মভাবে যাচাইয়ের ক্ষেত্রে আরও বাস্তববাদী হওয়া দরকার।
ভেস্টেগার বলেন, পরবর্তী নির্বাচনগুলোয় প্রভাব ফেলতে ‘নিশ্চিতভাবেই এআই ব্যবহারের ঝুঁকি’ রয়েছে।
তিনি আরও বলেন, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর জন্য চ্যালেঞ্জ হবে এআই। অপরাধ শনাক্তে এআইয়ের ঝুঁকি গুরুত্বের বিবেচনায় ‘একেবারে শীর্ষ’ থাকবে, কারণ এই প্রযুক্তির সুবিধা অপরাধীরাও নেবে এমন উদ্বেগ আছে।
“সামাজিক মাধ্যম ফিড স্ক্যান করে আপনার একটি প্রোফাইল দাঁড় করানো গেলে জালিয়াতির ঝুঁকি অনেক বেড়ে যাবে।” --বলেন তিনি। “আর যদি এমন পরিস্থিতিতে পৌঁছাই যেখানে আমারা কিছুই বিশ্বাস করতে পারছি না, তখন বুঝতে হবে, আমরা সমাজের গুরুত্ব পুরোপুরি উপেক্ষা করেছি।”
ওপেনএআই’র জিপিটি ৪-এর চেয়ে শক্তিশালী এআই ব্যবস্থার বিকাশ আটকে দেওয়ার লক্ষ্যে মার্চে এক খোলা চিঠিতে স্বাক্ষর করেন বেশ কিছু প্রযুক্তি নেতা ও গবেষক।
তবে ভেস্টেগার বলেন, এটা বাস্তবসম্মত ছিল না।
“এটা চাপিয়ে দেওয়ার বিষয় নয়। কেউ নিশ্চিত করতে পারবে না যে সবাই এতে যোগ দেবেন।” --এই সুযোগ নিয়ে প্রতিযোগীরা এগিয়ে যেতে পারে, এমন ইঙ্গিত দিয়ে বলেন তিনি।
“আমার কাছে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, প্রতিটি নির্মাতা যেন জানে যে সবাই এই নীতিমালা মানছে আর কেউ যেন অতিরিক্ত ঝুঁকি না নেয়।”
চেহারা শনাক্তকরণ
এআই অ্যাক্টের জন্য ইউরোপীয় পার্লামেন্টের প্রস্তাবনায় বায়োমেট্রিক ও চেহারা শনাক্তকরণ ব্যবস্থার মাধ্যমে সামাজিক মাধ্যম বা সিসিটিভি ফুটেজ থেকে ব্যবহারকারীর ডেটা নির্বিচারে সংগ্রহ সীমাবদ্ধ করার বিষয়টি উল্লেখ রয়েছে।
“আমরা কঠোর নিয়ন্ত্রণ রাখতে চাই যাতে এটি ‘রিয়েল টাইমে’ ব্যবহৃত না হয়ে বরং সুনির্দিষ্ট কিছু সংখ্যক পরিস্থিতিতে ব্যবহৃত হয়। উদাহরণ হিসেবে ধরা যায়, নিখোঁজ শিশুকে খোঁজা বা সন্ত্রাসী পালিয়ে যাওয়া।” --বলেন ভেস্টেগার।
“পার্লামেন্টের আরও বেশি নীতিগত অবস্থান থাকায় তারা আগামীকাল এ বিষয়ে ভোট দেবে যাতে আমরা এটা পুরোপুরি নিষিদ্ধ করতে পারি।”
কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা নিয়ন্ত্রণে বিশ্বের প্রথম ‘গাইডলাইন’ হিসেবে এআই অ্যাক্ট চূড়ান্ত হওয়ার আগে ইইউ’র তিনটি বিভাগ কমিশন, পার্লামেন্ট ও কাউন্সিলকে এর চূড়ান্ত সংস্করণ নিয়ে একমত হতে হবে বলে প্রতিবেদনে লিখেছে বিবিসি।
২০২৫ সালের আগে এই আইন কার্যকর হওয়ার সম্ভাবনা নেই।