“আমরা কমিশনের সুপারিশের অধিকাংশ ক্ষেত্রে একমত হয়েছি। এখন কিছু কিছু বিষয় আছে আরও বিচার-বিশ্লেষণ করতে হবে,” বলেন সালাহউদ্দিন।
Published : 22 Apr 2025, 06:20 PM
প্রধান বিচারপতি নিয়োগ প্রক্রিয়ায় আপিল বিভাগের জ্যেষ্ঠতম বিচারপতি নির্দিষ্ট না করে ‘জ্যেষ্ঠতম বিচারপতিদের মধ্যে ন্যূনতম দুই থেকে তিনজন’ রাখার প্রস্তাব করেছে বিএনপি।
মঙ্গলবার দুপুরে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে বৈঠকের মধ্যাহ্ন বিরতিতে দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ এ কথা বলেন।
তিনি বলেন, “ওনাদের (জাতীয় ঐকমত্য কমিশন) প্রস্তাব ছিল, অ্যাপিলেট ডিভিশনের সিনিয়র মোস্ট যেন পরবর্তী চিফ জাস্টিস হন।”
“আমাদের প্রস্তাব, এক্ষেত্রে অন্তত একটা অপশন থাকা উচিত। সিনিয়র মোস্ট বিচারপতিদের মধ্যে কমছে কম দুই থেকে তিনজন যেন এই অপশনের মধ্যে থাকে।”
তবে সেই জায়গাটা (প্রস্তাব) এখনো গৃহীত হয়নি, সেটা নিয়ে আলোচনা চলছে, বলেন সালাহউদ্দিন।
প্রস্তাবের যৌক্তিকতা ব্যাখ্যা করে সালাহউদ্দিন আহমদ বলেন, “রাষ্ট্রের মধ্যে কিছু অসংহতি আগে দেখা গিয়েছে। সর্বক্ষেত্রে যদি আমরা ফিক্সড (নির্দিষ্ট) করে দিই, কোনো অপশন যদি না থাকে …ভবিষ্যতে যেহেতু আমরা জুডিশিয়ারির ফুল ইন্ডিপেন্ডেন্সটা এনসিউর করতে চাই।”
“সেক্ষেত্রে আগের মত কিছু বিচারপতি যদি চিফ জাস্টিস হয়ে যান তাহলে রাষ্ট্রের জন্য এটা কল্যাণকর হবে না।”
বিভাগীয় পর্যায়ে হাইকোর্ট বেঞ্চের বিপক্ষে বিএনপি
সালাহউদ্দিন বলেন, “সুপ্রিম কোর্টের বিকেন্দ্রীকরণ নিয়ে কথা হয়েছে। ওনাদের প্রস্তাব হল যে স্থায়ী বেঞ্চ যেন বিভাগগুলোতে করা হয়। আপনারা জানেন যে, অষ্টম সংশোধনী ছিল সামরিক শাসক এইচএম এরশাদের সময়ে।
“সুপ্রিম কোর্টের বিকেন্দ্রীকরণের জন্য যে বিধান আনা হয়েছিল সংবিধানে, সেটা অসাংবিধানিক ঘোষণা করা হয়।”
তিনি বলেন, “সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগের স্থায়ী বেঞ্চ সংবিধানের মৌলিক কাঠামোর সাথে যায় না এবং সাংঘর্ষিক। যেহেতু এটা বাতিল করে জাজমেন্ট আছে সেজন্য আমরা বলেছি, সার্কিট বেঞ্চ স্থাপনের জন্য আর্টিক্যাল-১০০ এ প্রভিশন আছে যে, এটা ওপরে যেন একটা কম্পালশন আমরা আনতে পারি।
“জুডিশিয়ারিকে যেন আমরা এখানে কনস্টিটিউশনে একটা প্রভিশন করতে পারি অথবা সাব সেকশন করতে পারি। যাতে করে প্রতিবছর প্রয়োজনীয় সংখ্যক সার্কিট বেঞ্চ স্থাপনের জন্য এখানে একটা বাধ্যবাধকতা আরোপ করা যায়। তাতে একই ফাংশন করা যাবে।”
বিএনপির এই নেতা বলেন, “সুপ্রিম জুডিশিয়াল অ্যাপয়েন্টমেন্ট অথবা ‘জুডিশিয়াল অ্যাপয়েন্টমেন্ট কমিশনের’ প্রস্তাব ওনারা করেছেন। আমরা এটার বিষয়ে নীতিগতভাবে একমত। বলেছি যে, এটা সংসদে আলোচনা করতে হবে।
সংবিধানে একটা নতুন প্রভিশন যুক্ত করা প্রয়োজন হবে, যাতে সুপ্রিম কোর্ট, হাইকোর্টের নিয়োগের ক্ষেত্রে কী কী বিধি-বিধান করতে হবে। এটা এখন এখানে আলোচনা করছি না।”
সালাহউদ্দিন বলেন, “আমরা বিচার বিভাগের সম্পূর্ণ স্বাধীনতা নিশ্চিত করার জন্য অঙ্গীকারাবদ্ধ। কিন্তু সব কিছু আমরা আইনানুগভাবে এবং সাংবিধানিকভাবে করতে চাই।”
তিনি বলেন, “বিচারক নিয়োগের যোগ্যতায় ঐকমত্য কমিশন প্রস্তাব করেছেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপককেও যাতে বিচারক নিয়োগ করা যায়।
“আমরা বলেছি এ বিষয়টি প্রস্তাবিত আইন আছে অথবা এখন যে আইনটা করার চেষ্টা করছি, বিচারক নিয়োগ অধ্যাদেশ, যেটা এখন হাইকোর্টে চ্যালেঞ্জড রয়েছে বিভিন্ন কারণে, সেইটা নিষ্পত্তি হলে তখন আইনে করা যাবে। তবে আমরা এ বিষয়ে নীতিগতভাবে একমত।”
মঙ্গলবার বেলা ১১টা ১০ মিনিটে জাতীয় সংসদের এলডি হলে বিএনপি তৃতীয় দিনের মত জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে আলোচনায় বসে, যা বিকালে শেষ হয়।
দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদের নেতৃত্বে চার সদস্যের প্রতিনিধি দলে বিএনপির চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য ইসমাঈল জবিউল্লাহ, আইনজীবী রুহুল কুদ্দুস কাজল ও সাবেক সচিব আবু মো. মনিরুজ্জামান খান ছিলেন।
জাতীয় ঐক্যমত্য কমিশনের ভাইস প্রেসিডেন্ট অধ্যাপক আলী রীয়াজ এই বৈঠকে সভাপতিত্ব করেন। কমিশন সদস্যদের মধ্যে বদিউল আলম মজুমদার, ইফতেখারুজ্জামান, বিচারপতি এমদাদুল হক, সফর রাজ হোসেন ও প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী (ঐকমত্য) মনির হায়দার বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন।
‘সব কমিশনকে সাংবিধানিক কমিশন করা প্রসঙ্গে’
সালাহউদ্দিন বলেন, “উনার বেশ কয়েকটা প্রতিষ্ঠানকে সাংবিধানিক কমিশন হিসেবে নিয়ে আসার জন্য প্রস্তাব করেছেন। মানবাধিকার কমিশন, দুর্নীতি দমন কমিশন এবং আরও একটা কমিশন সৃষ্টি করার জন্য বলেছেন যেটা এখন নাই, স্থানীয় সরকার কমিশন। আমরা বলেছি যে, প্রত্যেকটা কমিশনকে সাংবিধানিকভাবে স্বীকৃতি দিয়ে সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করা হয় এতে জটিলতা বাড়বে।
“বিদ্যমান আইনে প্রতিষ্ঠানগুলো যেভাবে পরিচালিত হচ্ছে সেভাবে থাকা উচিত।”
গণভোট প্রসঙ্গে
বিএনপি নেতা সালাহউদ্দিন বলেন, “আমরা আগেও বলেছি, গণভোট সব বিষয়ে হবে না। সংবিধান সংশোধনের কিছু আর্টিক্যাল থাকে, মৌলিক অধিকারের ক্ষেত্রে আর্টিক্যাল-৮,৪৮,৫৬ ও ১৪২ যাতে সংবিধান সংশোধনীর বিভিন্ন উপায় বলা আছে, এগুলো পরিবর্তনে আওয়ামী লীগ সরকার গণভোট বাতিল করে দিয়েছিল।”
তিনি বলেন, পঞ্চদশ সংশোধনীর রায়ে যে বিষয়ে গণভোটের পক্ষে রায় হয়েছিল সেই বিষয় ছাড়া অন্যান্য বিষয়ে গণভোট হওয়া উচিত না।
“তবে আমরা প্রভিশন রেখেছি.. আমরা প্রস্তাব রেখেছি যে, ভবিষ্যতে পার্লামেন্ট যদি আরও কোনো কোনো আর্টিক্যালের পরিবর্তনের ক্ষেত্রে গণভোটের বিধান রাখতে চায় সেটা ভবিষ্যৎ পার্লামেন্টের বিষয়।”
রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতার ভারসাম্য
বিএনপির স্থায়ী কমিটির এই সদস্য বলেন, “নির্বাহী বিভাগের ক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে মন্ত্রিসভা, বিষয়টা আসলে টেকনিক্যাল, আসলে এটা হচ্ছে… কর্তৃত্বে মন্ত্রিসভা কর্তৃক পরিচালিত হবে সরকার। সেটা আগের বিধান। এখানে আমরা একমত নই বলতে পারেন।
“আর রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা বাড়াতে আমরা আর্টিক্যাল-৪৮ এর সাব সেকশন-৩ পরে আরেকটা নতুন আর্টিক্যাল আমরা প্রস্তাব করব। এখানে রাষ্ট্রপতির হাতে কী কী ক্ষমতা অর্পণ করা যায় এবং প্রধানমন্ত্রীর সাথে আলোচনা না করে রাষ্ট্রপতি কী কী ফাংশন করতে পারেন সেটা ডিটেলড করা থাকবে, অনেক বিষয় থাকবে। এই মুহুর্তে আমরা ডিসক্লোজড করছি না। সেটা উনারা (কমিশন) মোটামুটি গ্রহণ করেছেন বলে মনে হয়েছে।
“এখানে যাতে রাষ্ট্রের প্রধানমন্ত্রী ও রাষ্ট্রপতির ক্ষমতার মধ্যে ভারসাম্য আনা যায়, একটা ভারসাম্যপূর্ণ সরকার ও রাষ্ট্র ব্যবস্থা কায়েম করা যায় সেই বিষয়ে আমরা অঙ্গীকারবদ্ধ সেই বিষয়ে আমরা কাজ করছি।”
‘প্রধানমন্ত্রী তিনটি পদে না থাকার প্রস্তাবে না’
সালাহউদ্দিন বলেন, “প্রধানমন্ত্রী যাতে তিনটি পদে না থাকে। প্রধানমন্ত্রী, দলীয় প্রধান ও সংসদ নেতা। সংখ্যা গরিষ্ঠতা পাওয়া দল ঠিক করে কে প্রধানমন্ত্রী হবেন। নেসেসারেলি যে, পার্টির চিফ হবেন, এমন তো কথা নাই, এরকম উদাহরণ অনেক আছে।”
“সংসদে একটা প্রথা আছে যে প্রধানমন্ত্রী সংসদ নেতা হন। কোনো কোনো দেশে আলাদা সংসদ নেতা করার নজির আছে। কিন্তু এখানে সংসদ নেতার কোনো নির্বাহী ক্ষমতা নেই, সংসদ রাষ্ট্র পরিচালনায় কোনো মন্ত্রণালয় লিড করেন তা নয়, এখানে সংসদ নেতা ও প্রধানমন্ত্রী অনেকটা অবিচ্ছেদ্য অংশের মত।”
ন্যাশনাল কনস্টিটিউশন কাউন্সিল (এনসিসি), সংসদের উভয় কক্ষের মেয়াদ, সংসদ সদস্যের বয়স ২১ বছর করা, সংরক্ষিত নারী আসনের নির্বাচন পদ্ধতি প্রভৃতি বিষয়ে ঐকমত্য কমিশনের প্রস্তাবের সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করেছেন বিএনপির নেতারা।
তত্ত্বাবধায়ক সরকারে উপদেষ্টামণ্ডলীর সদস্য ১৪ জন, উপদেষ্টামণ্ডলীর কার্যাবলি, প্রধান উপদেষ্টা পদত্যাগ করলে উপদেষ্টামণ্ডলী থেকে একজনকে নির্বাচিত করা, উচ্চ কক্ষ-সিনেট, নিম্ন কক্ষ-জাতীয় সংসদ, এই দুই কক্ষের কার্যাবলী, দুই কক্ষের ডেপুটি স্পিকার বিরোধী দল থেকে নেওয়া, ন্যায় পাল নিয়োগ, রাষ্ট্রপতির অভিসংশন প্রক্রিয়া, লোকাল গভর্নমেন্ট ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠা, স্থানীয় সরকারের কোনো নির্বাচনে দলীয় প্রতীক বরাদ্দ না করা,
আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিষয়ে (আরও বিস্তারিত আলোচনা করতে হবে), জেলা পর্যায়ে অ্যাটর্নি সার্ভিস পরীক্ষামূলকভাবে (১০%) শুরু করা প্রভৃতি বিষয় ঐকমত্য কমিশনের প্রস্তাবের সঙ্গে একমত বলে জানান সালাহউদ্দিন।
তিনি বলেন, “আমরা কমিশনের সুপারিশের অধিকাংশ ক্ষেত্রে একমত হয়েছি। এখন কিছু কিছু বিষয় আছে আরও বিচার-বিশ্লেষণ করতে হবে।”
“স্থানীয় সরকারে কোনো সরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানে কোনো পদে এমপিরা না থাকার বিষয়ে নীতিগতভাবে একমত হলেও তা সংসদে আলোচনার একটু দাবি রাখে,” বলেন তিনি।