বেশিরভাগ ক্ষেত্রে প্রাণীর সংগ্রহদাররা কম জায়গায় একসঙ্গে অনেক প্রাণীর রক্ষণাবেক্ষণ করে থাকেন।
Published : 04 Apr 2024, 07:56 PM
দেড়শ’র বেশি পোষা প্রাণীকে নিষ্ঠুর অবস্থায় রাখার জন্য সম্প্রতি এক ফরাসি দম্পতিকে এক বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে। তবে, কারাদণ্ড বা ওই সাজা মওকুফ নয়, এ ঘটনা আলোচিত হচ্ছে অন্য কারণে।
ফ্রান্সের দক্ষিণের শহর নিস-এ বসবাসকারী এ দম্পতি, তাদের ৮৬১ বর্গফুটের ফ্ল্যাটে ১৫৯টি বিড়াল এবং সাতটি কুকুর রেখেছিলেন।
গত বছর এসব পোষা প্রাণীকে ফ্ল্যাটের মধ্যে নোংরা অবস্থায় পাওয়া যায় এবং এদের মধ্যে অনেক প্রাণী পানিশূন্যতা, অপুষ্টি ও পরজীবীর সংক্রমণে ভুগছিল। এক বছরের সাজার রায়ে বিচারক বলেছেন, এ দম্পতি পোষা প্রাণীদের যথাযথ যত্ন নিতে পারেননি।
৬৮ বছরের নারী ও ৫২ বছরের পুরুষ এ দম্পতি আর কখনোই বাড়িতে পোষা প্রাণী রাখতে পারবেন না বলে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে আদালত। পাশাপাশি জরিমানা হিসেবে তাদের পশু অধিকার নিয়ে কাজ করে এমন দাতব্য সংস্থা ও বিভিন্ন নাগরিক সংগঠনে এক লাখ ২৮ হাজার ডলারের বেশি অর্থ প্রদানের আদেশও এসেছে। আর এইসবের বদলে জেল খাটা থেকে রেহাই পেয়েছেন তারা।
গত বছর এ দম্পতির ফ্ল্যাটের প্রতিটি ঘরে এইসব প্রণী খুঁজে পায় পুলিশ। গোটা ফ্ল্যাটজুড়ে পোষা প্রাণীর মলমূত্র দেখে কর্তৃপক্ষকে খবর দেওয়া হয়।
ততদিনে বেশ কিছু বেড়াল ও কুকুর এমন অস্বাস্থ্যকর পরিবেশের কারণে মারাও গিয়েছে। তদন্তকারীরা একটি বাথরুমে অন্তত দুটি বিড়াল-কুকুরের মৃতদেহ পান।
এক পরিত্যক্ত বিল্ডিংয়ে বাস করা অবস্থায় প্রায় ৩০টি বিড়ালকে তার ফ্ল্যাটে নিয়ে আসার আগে, ২০১৮ সালে তিনি তার বাবা-মায়ের তিনটি বিড়াল ও তিনটি কুকুরকে পালার জন্য নিয়েছিলেন। ওই ছয়টি কুকুর আর বেড়াল থেকেই এদের সংখ্যা দেড়শ’ ছাড়িয়েছে।
নূহ নবীর নামে অসুখ?
ইসলাম, খ্রিষ্টান ও ইহুদি ধর্মমতে বিশ্বব্যপী ভয়াবহ বন্যা থেকে সকল প্রাণীকে রক্ষা করার জন্য একজন প্রেরিত পুরুষ বিশাল এক নৌকা তৈরি করে সেখানে সকল মানুষ ও প্রাণীকে তুলে নেন। ইসলাম ধর্ম অনুসারে এ কাজটি করেন হজরত নূহ (আঃ) আর খ্রিষ্টান ও ইহুদি ধর্মমতে ইংরেজি ভাষায় এই নামটির রূপ নোয়া (Noah)।
আলোচিত এই দম্পতির আচরণ নিয়ে গবেষকরা বলছেন, এটি এমন একটি মানসিক অবস্থা যেখানে, প্রাণীদের বাঁচানোর জন্য ব্যাক্তি সবসময় একটি মানসিক তাড়না বোধ করেন, এমনকি সঠিকভাবে এদের দেখভাল করতে অক্ষম হলেও।
আইনজীবিরা এ দম্পত্তির জন্য ১৮ মাসের কারাদণ্ডের আবেদন করেছিলেন। এর আগে, ২০১৪ সালে ১৮ বর্গমিটার স্টুডিওতে ১৩টি বিড়াল নিয়ে বাস করার জন্যও তদন্তের মুখে পড়েছিলেন এ দম্পতি।
‘নোয়া সিনড্রোমে’র কারণ
এই অসুখে আক্রান্তরা চান তাদের আশপাশে অনেক বেশি প্রাণী থাকবে। যদি কেউ দায়িত্বশীলভাবে প্রাণী পালন করে থাকেন, তবে তাদের পর্যাপ্ত জায়গা ও প্রাণী পালনের জন্য প্রয়োজনীয় সুযোগ-সুবিধা থাকবে। আর কেউ যদি এই অসুখে আক্রান্ত হন, তবে তারা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই পুরো বাড়ি ভর্তি করে প্রাণী রাখবে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে এই অসুখে আক্রান্তরা কম জায়গায় একসঙ্গে অনেক প্রাণীর দেখভাল করে থাকেন।
এর বিভিন্ন কারণ সাধারণত মানসিক, যার মধ্যে রয়েছে—
● অবসেসিভ কম্পালসিভ ডিসঅর্ডার বা ওসিডি: এতে আক্রান্ত ব্যক্তিরা বাড়িতে প্রাণী সংগ্রহ করতে বাধ্য নন, তবে এ প্রতি অনেক বেশি ঝুঁকে পড়েন।
● আসক্তি: এতে কোনো ব্যক্তির বাড়িতে প্রাণী রাখার বিষয়টি আসক্তির পযায়ে পরিণত হয়, যা প্রাণীর মালিকদের মধ্যে প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করে ও তাদের অস্বাস্থ্যকর আচরণের পুনরাবৃত্তি ঘটায়।
● বিভ্রম: এতে প্রাণী রাখার নেতিবাচক প্রভাব সম্পর্কে মালিকরা একেবারেই অজ্ঞ থাকেন।
● ডিমেনশিয়া: এটি প্রায় বিভ্রমের মতোই, যেখানে মালিকরা তাদের প্রাণী সংগ্রহ করার সংখ্যা বুঝে উঠতে পারেন না। কারণ ডিমেনশিয়ার কারণে তারা অনেক কিছুই ভুলে যান।
‘নোয়া সিনড্রোমে’র লক্ষণ
‘নোয়া সিনড্রোমে’র কিছু নির্দিষ্ট লক্ষণ রয়েছে, যেমন—
● বাধ্যতামূলকভাবে অনেক বেশি সংখ্যক প্রাণী ঘরের মধ্যে রাখা।
● অন্য কাউকে ঘরে ঢুকতে না দেওয়া।
● অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে জীবনযাপন করেও লজ্জাবোধ না থাকা।
● বাধ্যতামূলকভাবে নানা জিনিস সংগ্রহ করা।
● বাড়ির চারপাশে অনেক বেশি পরিমাণে প্রাণীর মলমূত্র থাকা।
● স্বাস্থ্য ও আচরণগত নানা সমস্যা নিয়েই প্রাণীদের ঘরে রাখা।
● প্রাণীদের জন্য পর্যাপ্ত মৌলিক সুবিধার অভাব।
প্রাণীদের উপর ‘নোয়া সিনড্রোমে’র পরিণতি
দরকারী যত্ন না দিয়ে কেবল প্রাণী সংগ্রহ করা আসলে প্রাণী নির্যাতনেরই একটি রূপ। তবে, যদি কেউ অনেক প্রাণীর যত্ন নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন এবং স্বাস্থ্য ও জীবনমানের দিক থেকে প্রাণীদের সব ধরনের চাহিদা পূরণের ব্যবস্থা করেন, তাহলে তারা এই অসুখে আক্রান্তদের মধ্যে পড়েন না। ‘নোয়া সিনড্রোমে’ আক্রান্ত ব্যক্তিরা প্রাণীদের উপর যেসব অন্যায় আচরণ করেন তার মধ্যে রয়েছে—
অপুষ্টি: ‘নোয়া সিনড্রোমে’ আক্রান্ত ব্যক্তিরা সাধারণভাবেই অনেক বেশি সংখ্যাক প্রাণী পুষে থাকেন। আর আক্রান্ত ব্যক্তিরা মানসিক অবস্থার কারণেই তারা তাদের সমস্যার বিষয়টি বুঝতে পারেন না। ফলে তাদের পোষা প্রাণীদের খাওয়ানোর প্রয়োজনও তারা ভুলে যান, ফলে প্রাণীরা অপুষ্টিতে ভোগে।
ট্রমা: আক্রান্ত ব্যক্তিদের প্রাণীদের উপর উদ্দেশ্যমূলকভাবে মানসিক বা শারীরিক নির্যাতন করার সম্ভাবনা কম হলেও, তাদের অবহেলার পরিমাণ প্রাণীদের উপর এই রকম প্রভাব ফেলতে পারে। প্রাণীদের ভালবাসা ও যত্ন প্রয়োজন। প্রাণীরা আদর, ভালবাসা না পেলে এটি তাদের আচরণের উপর প্রভাব ফেলে মারাত্মক পরিণতি ঘটাতে পারে।
রোগ: অবহেলা প্রাণীদের স্বাস্থ্যের উল্লেখযোগ্য অবনতি ঘটাতে পারে। অবাধ ও অনেক ভিড়ের মধ্যে বাস করা অনেক প্রাণী কেবল ত্বক, পরজীবী সংক্রমণ ও হজমের সমস্যা এমন নানা রোগে সংক্রামিত হতে পারে না, তবে এসব রোগ অন্যান্য প্রাণীদের মধ্যে ছড়িয়ে দিতে পারে। আর ‘নোয়া সিনড্রোমে’ আক্রান্ত ব্যক্তিদের প্রাণীর এ অবস্থা চোখে পড়ে না এবং প্রাণীদের পশুচিকিৎসকের কাছেও নিয়ে যান না।
আক্রমনাত্মক আচরণ: অবহেলিত ও নির্যাতিত প্রাণীরা প্রায়শই অন্যান্য প্রাণীর প্রতি আগ্রাসী আচরণ করে থাকে। ফলে প্রাণীরা বন্য হয়ে উঠে ও আধিপত্য বা কেবল খাবারের জন্য এরা লড়াই করা শুরু করে। এমনকি প্রাণীরা পালানোর চেষ্টাও করতে পারে।
রোগীর উপর ‘নোয়া সিনড্রোমে’র পরিণতি
বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ‘নোয়া সিনড্রোম’ ব্যক্তির মানসিক ও স্নায়বিক স্বাস্থ্য সমস্যার কারণে হয়ে থাকে। আর এমন অবস্থা আক্রান্ত ব্যক্তির দায়িত্ববোধ কমিয়ে দেয়, এমনকি প্রাণীদের অবস্থা অসহনীয় হলেও। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ‘নোয়া সিনড্রোমে’ আক্রান্ত ব্যক্তির পরিণতি প্রাণীদের মতোই ঠিক ততটাই ক্ষতিকর হয়। যেমন—
অস্বাস্থ্যকর অবস্থা: একটি বাড়িতে অনেক বেশি সংখ্যক পোষা প্রাণীর মলমুত্র থাকতে পারে। যাদের ‘‘নোয়া সিনড্রোম’ আছে তারা ঘর পরিষ্কার ও জীবাণুমুক্ত করার কথা ভাবেন না। মলমূত্র ত্যাগের ফলে বিভিন্ন রোগ হতে পারে। বিশেষ করে অনেক ব্যাকটেরিয়া বিস্তার লাভ করে, যা খাবার, এমনকি ঘুমানোর বিছানা দূষিত বা নোংরা করতে পারে। এক্ষেত্রে আক্রান্ত ব্যক্তির স্নায়বিক অবস্থা দুর্বল হলে তিনি নিজের জন্য চিকিৎসা নেওয়ার কথাও ভাববেন না।
প্রাণীর রোগ: জলাতঙ্ক ও হুকওয়ার্ম-এর মতো আরও অনেক রোগ প্রাণী থেকে মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে পড়তে পারে।
‘নোয়া সিনড্রোমে’র চিকিৎসা
‘নোয়া সিনড্রোমে’র চিকিৎসা নির্ভর করে এর কারণের উপর। যদি, এর কারণ মানসিক হয়, তবে এ অবস্থার জন্য উপযুক্ত চিকিৎসা প্রয়োজন। এতে সাধারণত থেরাপি, ওষুধ বা উভয়ই জড়িত। এটি ‘নোয়া সিনড্রোমে’র তীব্রতার উপরও নির্ভর করে। যেহেতু আক্রান্ত ব্যক্তি নিজেকে সমাজের বাকিদের থেকে দূরে রাখেন, তাই তাদের পুনরায় সামাজিকীকরণ করতে হবে, আর এটি এমন একটি প্রক্রিয়া যা খুব কঠিন হতে পারে এবং সবসময় ফল নাও দিতে পারে। এক্ষেত্রে ব্যক্তির আচরণের ধরন পরিবর্তন করা প্রয়োজন, যা অনেকের জন্যই কঠিন।
পাশাপাশি, প্রাণীদের মূল্য বোঝা ও সম্ভব হলে পুনর্বাসন করা প্রয়োজন। প্রাণীদের চিকিৎসা সংক্রান্ত বিভিন্ন সমস্যার সমাধান ও আচরণগত নানা সমস্যা বিবেচনা করতে হবে। তবে, দুর্ভাগ্যবশত, প্রাণীর পুনর্বাসন একটি কঠিন বিষয় হতে পারে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ‘নোয়া সিনড্রোমে’ আক্রান্ত ব্যক্তিরা প্রাণীদের প্রতি তাদের অবহেলার বিষয়টি বুঝতে পারেন না এবং তারা ভাবেন যে, প্রাণীরা তাদের কাছে খুব প্রিয় ও সুস্থ আছে। তাই প্রাণীদের কাছ থেকে তাদের আলাদা করা কঠিন হতে পারে।
তবে, ‘নোয়া সিনড্রোম’ হওয়ার কারণ যদি হয় মস্তিষ্কের অবনতি বা স্মৃতিভ্রংশ, তাহলে এ রোগের পূর্বাভাস সবসময় খুব একটা ভালো হয় না। যারা এ রোগে গুরুতর অবস্থায় পৌঁছায় তাদের প্রায়ই হাসপাতালে ভর্তি করতে হয় বা সেবা কেন্দ্রে পাঠানো হয়। তবে, এ পরিস্থিতিতে তাদের জন্য পুনরায় সংক্রমণ হওয়ার ঝুঁকি বেশি। তবে, বেশিরভাগ ক্ষেত্রে যত্ন বা পরিচর্যা তাদের সারিয়ে তুলতে পারে।