ডার্ক ওয়েব: যেখানে মেলে মাদক, ভাড়াটে খুনিও

কী কারণে কে তাকে হত্যা করতে চায়? অথবা, পরিচিতদের মধ্যে এমন কে আছে, যার একজন খুনির সঙ্গে যোগাযোগ থাকতে পারে?

প্রযুক্তি ডেস্কবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 28 Nov 2022, 11:20 AM
Updated : 28 Nov 2022, 11:20 AM

জীবনে অনেক সময়ই আমরা না চাইলেও অন্যের মন খারাপের কারণ হই। আর যার মন খারাপ হয়, তিনি হয়তো নম্রতার সঙ্গেই পরবর্তীতে তা আর না করার অনুরোধ জানান; কখনও ভুলে যেতে চান।

কিন্তু, কেউ ওই ভুলের শোধ নেওয়ার জন্য যদি ডার্ক ওয়েবে লাখ টাকা খরচ করে পেশাদার খুনী ভাড়া করে, তাহলে একে কী বলা যায়? এমনই ঘটেছিল মার্কিন এক নারীর সঙ্গে।

২০১৮ সালে অ্যালেক্সিস (ছদ্মনাম), মার্কিন আইনশৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর একটি ফোন পান। দায়িত্বরত কর্মকর্তা তার সঙ্গে কথা বলতে তাৎক্ষণিকভাবে থানায় আসতে বলেন, যা ১৯ বছর বয়সী এই তরুণীর জীবন চিরতরে বদলে দেয়।

“তারা জিজ্ঞেস করে, আমি কাউকে খেপিয়েছি কি না। আমি জবাব দেই, ‘না, আমার এমন কিছু মনে পড়ছে না’… তারা বললেন, আমাকে হত্যার উদ্দেশ্যে কেউ এরই মধ্যে হাজার দুয়েক ডলার খরচ করেছে।”

নিরপত্তার স্বার্থে অ্যালেক্সিসের মূল পরিচয় প্রকাশ করেনি ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম স্কাই নিউজ।

তার মাথায় তখন বিভিন্ন প্রশ্ন ঘুরপাক খেয়েছে। কে তাকে কী কারণে হত্যা করতে চায়? পরিচিতদের মধ্যে এমন কে আছে, যার একজন খুনীর সঙ্গে যোগাযোগ থাকতে পারে?

খুনী ভাড়া করা ব্যক্তি যেই হোক না কেন, অ্যালেক্সিসকে শেষ করে দেওয়ার জন্য তাকে কোনো মাফিয়া বা এলাকাভিত্তিক কোনো অস্ত্রধারী গ্যাংয়ের সঙ্গে যোগাযোগ করতে হয়নি।

খুনি খুঁজে পাওয়া এরচেয়েও সহজ!

ওই ব্যক্তি কেবল নিজের ল্যাপটপের মাধ্যমে এমন একটি ভয়াবহ অনলাইন স্পেসে গিয়েছেন, যেখানে বেআইনি কাজ করে দেওয়ার জন্য অপরাধীরা নিজ পরিচয় গোপন রাখতে পারে।

এই জায়গাটি পরিচিত ‘ডার্ক ওয়েব’ নামে।

এটি ইন্টারনেটের এমন একটি লুকানো জায়গা, যেখান থেকে লোকজন মাদক ও অস্ত্র বিক্রির পাশাপাশি বেআইনি পর্নগ্রাফি দেখতে, এমনকি বিভিন্ন ব্যক্তি বা ব্যবসাকে লক্ষ্যবস্তু বানিয়ে হ্যাকার পর্যন্ত ভাড়া করা যায়।

এতে অসংখ্য ‘ভাড়াটে খুনি’ সাইটও আছে, যেখানে বিটকয়েনের মতো ক্রিপ্টোমুদ্রার বিনিময়ে ‘হিটম্যান’ (আততায়ী) ভাড়া করা যায়।

অ্যালেক্সিসকে অপহরণ ও হত্যার উদ্দেশ্যে ‘ক্যামোরা হিটম্যান’ নামের সাইটে প্রবেশ করে বিটকয়েনের মাধ্যমে পাঁচ হাজার সাতশ ৭০ ডলার পরিশোধ করে পরিচয় গোপন রাখা এক ডার্ক ওয়েব ব্যবহারকারী।

সাইটটি এখন বন্ধ হয়ে গেলেও, এই ধরনের অন্যান্য বেশ কিছু সাইট আছে, যারা এখনও ডার্কওয়েবে সক্রিয় আছে ও একই ‘সেবা দেওয়ার’ দাবি করছে।

ভাড়ায় খুনের রেট ১৫ হাজার ডলার থেকে

এইসব কার্যক্রমের ধরন সম্পর্কে জানতে এমন বেশ কয়েকটি সাইটের সঙ্গে যোগাযোগ করেছে স্কাই নিউজ। তবে, কারও কাছ থেকেই জবাব মেলেনি।

এর মধ্যে দুটো সাইটে কয়েকজন ব্যক্তির ছবি দেখা যাচ্ছে, যারা ছুরিকাঘাত বা সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছেন। এইসব ছবি আসল বা আসলেই ওয়েবসাইটের কার্যক্রমের ফল কি না, সেটি পরিষ্কার নয়।

একটি সাইট ১৫ হাজার ডলার থেকে ‘চুক্তিভিত্তিক হত্যা’ ও ‘মারধরের’ সেবা দিচ্ছে দুই হাজার ডলার থেকে। ওই সাইটের নাম প্রকাশ করেনি স্কাই।

শিকারে বিস্তারিত তথ্য দেয় ডার্ক ওয়েব ব্যবহারকারী

এইসব সাইটে ক্রেতা ও বিক্রেতার বিভিন্ন লেনদেন সম্পর্কিত তথ্যে প্রবেশাধিকার পান যুক্তরাজ্য-ভিত্তিক হ্যাকার ও ডার্ক ওয়েব সদস্য ক্রিস মন্টিয়েরো।

পরবর্তীতে, তিনি এইসব তথ্য পাঠিয়ে দেন যুক্তরাজ্য ও বিদেশী বিভিন্ন আইন প্রয়োগকারী সংস্থার কাছে। এমনকি, অ্যালেক্সিসের ঘটনাও মার্কিন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কানে পৌঁছান তিনি।

“অনেক বছর ধরে এমন হাজার হাজার হত্যার পরিকল্পনা দেখেছি আমি।” --বলেন তিনি।

“লোকজন এইসব সাইটে যাচ্ছে ও তারা যাকে হত্যা করতে চায়, তার সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য দিচ্ছে। এর মধ্যে আছে তারা কোথায় কাজ করে, কোথায় থাকে ও এর জন্য কী পরিমাণ অর্থ পরিশোধ করতে ইচ্ছুক, এমন বিষয়গুলো।”

‘সঙ্গে ছুরি রাখতাম আমি’

বেশ কয়েক বছর অনুসন্ধান করে মন্টিয়েরো খুঁজে পান, এতোদিন তিনি যেসব সাইট হ্যাক করে আসছিলেন, এগুলো আসলে তা নয়, যা তারা দাবি করে।

তিনি যেসব ওয়েবসাইটে প্রবেশ করেছেন, সেগুলোর একটিও আসল নয়। আর ডার্ক ওয়েবে থাকা এইসব ‘কন্ট্রাক্ট কিলিং’ সাইটের সকল তদন্তেই এগুলো জাল বলে প্রমাণ মিলেছে।

এর মধ্যে আছে অ্যালেক্সিসকে হত্যা করতে চাওয়া সাইটও।

তবে, এই সাইট আসল বা নকল যাই হোক না কেন, কেউ একজন তার জীবন নাশের জন্য এই সাইটে এসেছে।

“প্রথমে আমি একটু ভয় পেয়েছিলাম… আমার কাছে পেপার স্প্রে থাকতো, আর একটি ছুরিও ছিল। কারও আক্রমণ ঠেকাতে আমার গাড়িতে ছিল একটি কাঠের লাঠি। আমার জীবন স্বাভাবিক ছিল না।”

আইন প্রয়োগকারীদের ভূমিকা ‘যথেষ্ট নয়’

২০১৯ সালে মার্কিন আইনশৃঙ্খলা বাহিনী অ্যালেক্সিসের মামলা এফবিআইকে পাঠিয়ে তাকে জানায়, “দেশটির অ্যাটর্নি অফিস এই বিচার কাজ চালাতে অস্বীকৃতি জানিয়েছে।”

অ্যালেক্সিসকে হত্যার চেষ্টাকারী এখনও বিচারের আওতায় আসেনি, মুক্ত।

অ্যালেক্সিস ও মন্টিয়ের দুজনই অভিযোগ করেছেন, আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলো এইসব সাইট সংশ্লিষ্ট সমস্যা নিরসনে বিশেষ কিছু করছে না।

“এইসব অপরাধমূলক সাইট সরিয়ে ফেলতে, ডার্ক ওয়েবে গুরুতর ও সংগঠিত উপায়ে অপরাধ করা ব্যক্তি শনাক্তে, এমনকি যারা শিশুদের আপত্তিজনক ছবি শেয়ার থেকে প্রথম শ্রেণির মাদক সরবরাহ করছে, তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে ঘনিষ্টভাবে কাজ করছে ‘এনসিএ’ ও এর বৈশ্বিক অংশীদাররা।” --এর সমাধানে করণীয় কী, এই প্রশ্নের জবাবে স্কাই নিউজ ডেইলি পডকাস্টে দেওয়া এক বিবৃতিতে বলেছে যুক্তরাজ্যের ‘ন্যাশনাল ক্রাইম এজেন্সি’।

এইসব সাইটের সত্যতা নিয়ে প্রশ্ন থাকলেও, তার মানে এই নয়, মানুষ হত্যার উদ্দেশ্যে ভয়ঙ্কর লোকজন তাদের অর্থ পরিশোধ করছে না।

নিজ ঘটনা সম্পর্কে অ্যালেক্সিস বলছেন, তিনি এখন জীবনে এগিয়ে যেতে চান।

“আমি একজন ব্যক্তি হিসেবে আরও পরিণত হওয়ার চেষ্টা করছি… এই মূহুর্তে, কেবল এগিয়ে যাওয়াই ভালো। এর রেশ ধরে বসে নিজের আত্মবিশ্বাস কমাতে চাই না।”