সাকুল্যে প্রায় এক হাজার সাতশ অনুসারী থাকা অ্যাকাউন্ট থেকে পোস্ট করা দুই মিনিটের ওই ভিডিও দর্শকরা দেখেছেন ১২ লাখেরও বেশিবার।
Published : 24 Oct 2022, 05:58 PM
‘কনসেন্ট’ শব্দটির শাব্দিক অর্থ সম্মতি হলেও প্রচলিত অর্থে এর মাধ্যমে শারীরীক ঘনিষ্টতায় দুই পক্ষের সম্মতি বোঝায়। কনসেন্ট নিয়েই তৈরি এক ভিডিও টিকটকে আপলোড হওয়ার পর তা ভেসে যাচ্ছে নারীবিদ্বেষী মন্তব্যের জোয়ারে।
কনসেন্ট বিষয়টিকে কেন্দ্র করে তৈরি ব্রিটিশ এক স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্রের ক্লিপ টিকটকে পোস্ট হওয়ার পর সেখানে ব্যবহারকারীরা ক্রমাগত অভিযোগ করে বলছেন, এখানে নারী আক্রমণাত্মক হয়ে উঠেছেন পুরুষের ওপর।
বিদ্বেষমূলক ওইসব কমেন্টে এমনকি উঠে এসেছে বিতর্কিত ইনফ্লুয়েন্সার অ্যান্ড্রু টেইটের নাম। নারীবিদ্বেষী মনোভাবের কারণে এরইমধ্যে বেশ কিছু প্ল্যাটফর্মে নিষিদ্ধ হয়েছেন তিনি।
বিবিসি’র প্রতিবেদন বলছে, সাকুল্যে প্রায় এক হাজার সাতশ অনুসারী থাকা অ্যাকাউন্ট থেকে পোস্ট করা দুই মিনিটের ওই ভিডিও দর্শকরা দেখেছেন ১২ লাখেরও বেশিবার।
এই স্বল্পদৈর্ঘ্যের চলচ্চিত্রের নির্মাতা ও মূল অভিনেত্রী এমিলিন হার্টলি বলছেন, এই ভিডিওর প্রতি এতো ঘৃণা ছড়ানোর মূল কারণ টিকটকের অ্যালগরিদম বলে মনে করেন তিনি।
ব্যবহারকারীর আগের পছন্দ করা বিভিন্ন ভিডিও এবং তার মতো লোকজন যেসব ভিডিও দেখেন বা মন্তব্য করেন, সেগুলোর ওপর ভিত্তি করে কনটেন্ট পরিবেশন করে টিকটক।
তবে, অ্যালগরিদম নিয়ে কথা না বলে টিকটক বলেছে, প্ল্যাটফর্মে নারীবিদ্বেষ একেবারেই সমর্থন করে না তারা।
“আমাদের কমিউনিটি গাইডলাইন একে স্পষ্টভাবেই ঘৃণামূলক মতাদর্শ হিসেবে দেখে। এটিও পরিষ্কার যে, এমন জিনিস (ঘৃণামূলক মন্তব্য) আমরা প্ল্যাটফর্মে চাই না।” --বলেছেন টিকটকের এক মুখপাত্র।
টিকটক আরও যোগ করেছে, হার্টলি’র ভিডিও থেকে একশরও বেশি কমেন্ট সরিয়েছেন তারা। তবে, এখনও ভিডিও’তে থেকে যাওয়া কমেন্টের এটি কেবল ক্ষুদ্র একটি ভগ্নাংশ বলে স্বীকারও করে নিয়েছে প্ল্যাটফর্মটি।
হার্টলি বলছেন, কমেন্টের স্রোতের ফলে সহায়তার জন্য প্ল্যাটফর্মের কারও সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগও করতে পারছিলেন না তিনি।
“সব কমেন্টের জবাব দেওয়ার মতো জনবল নেই আমাদের।” --বলেছেন হার্টলি।
“আমি ভাবছিলাম, ‘আমি কী এমন করলাম! (মনে হচ্ছে,) আমি এমন একটি সিনেমা বানিয়েছি যেটি ধর্ষণ সংস্কৃতিকেই সমর্থন করছে।”
টিকটকে অন্যান্য ভিডিও কনটেন্টও এমন অবমাননাকর কমেন্টে ভেসে যেতে দেখেছেন তিনি। ওইসব ভিডিওতে নির্মাতারা লাইক চাওয়ার পাশাপাশি ‘টিকটককে ভুল দিক থেকে ফিরিয়ে আনতে’ সহায়তাও চেয়েছেন বলে জানিয়েছেন হার্টলি।
‘এই গল্পটি সম্পূর্ণ কাল্পনিক’
হার্টলি’র পোস্ট করা ভিডিওটি তার ‘কিপ ব্রিদিং’ নামে একটি সিনেমার অংশ। ইংল্যান্ডের ডার্বি শহরের বেশ কিছু সাহায্য সংস্থার আর্থিক সহায়তায় ১৮ মিনিটের এই চলচ্চিত্রটি তিনি বানিয়েছিলেন ২০১৮ সালে। পাশাপাশি, এতে সমর্থন দিয়েছে ‘ব্রিটিশ ফিল্ম ইনস্টিটিউট’।
কাল্পনিক এই কাহিনিতে আগে ঘটে যাওয়া এক শারীরীক ঘনিষ্টতার ঘটনা নিয়ে এক যুগলকে লিফটে থাকা অবস্থায় তর্ক করতে দেখা যায়। তর্কের পাশাপাশি এতে ওই পুরোনো ঘটনার বিভিন্ন ফ্ল্যাশব্যাকও ছিল।
গল্পে দেখা যায় মদ্যপান করে আসা ওই দুই চরিত্রের পরিচয় হয়েছে একটি নাইটক্লাবে। তারা কে কীভাবে বাড়ি যাবেন অথবা লোকটি ওই নারীর সঙ্গে থাকবেন কি না - এসব বিষয় নিয়ে তাদের মধ্যে ভুল বোঝাবুঝি হয়।
টিকটকে হার্টলি’র পোস্ট করা ওই ক্লিপে কেবল দুজনের তর্কের অংশটি ছিল, কোনো ফ্ল্যাশব্যাক ছিল না। হার্টলি পরে আরেক ভিডিওতে ফ্ল্যাশব্যাকের অংশগুলো পোস্ট করার চেষ্টা করলে সেটি বারবার সরিয়ে ফেলছিল টিকটক। কারণ হিসেবে প্ল্যাটফর্মটি বলেছে, ভিডিওটি ‘বেশি খোলামেলা’।
নির্মাতা এমিলিন হার্টলিআমি ভাবছিলাম, - আমি কী এমন করলাম! (মনে হচ্ছে,) আমি এমন একটি সিনেমা বানিয়েছি যেটি ধর্ষণ সংস্কৃতিকেই সমর্থন করছে।
বিবিসি’র প্রতিবেদন বলছে, তিনি এখন গোটা বিষয়টি ব্যাখ্যা করার পরও এখনও অনেক মন্তব্য আছে যেগুলো নারীবিদ্বেষী।
এর আগে ভিডিওটি নামিয়ে ফেলার কথা ভাবলেও হার্টলি এখন বলছেন, পোস্ট রেখে দেওয়ার সিদ্ধান্তে তিনি অটল।
“আমি অনুশোচনা করি না। তবে, কীভাবে এর জবাব দেওয়া যায়, সেটি বের করার চেষ্টা করছি।” --বলেন তিনি।
এর মধ্যে ইতিবাচক মন্তব্যও এসেছে। কমেন্টের মধ্যেই নিজেদের আলোচনায় কিছু লোক তাদের মনোভাব পাল্টেছেন। “আমার ধারণা, এটি গুরুত্বপূর্ণ, এর দরকার আছে।” - বলেছেন তারা।
যেভাবে কাজ করে টিকটকের অ্যালগরিদম
সামাজিক মাধ্যম পরামর্শক ম্যাট নাভারা বলেছেন, পরামর্শমূলক হিসেবে কাজ করে টিকটকের অ্যালগরিদম। নতুন কনটেন্টে সম্পৃক্ততার বেলায় একজন ব্যবহারকারী ও তার মতো অন্যান্য লোকজনের আগের কার্যক্রমের ধরন বিবেচনায় নেয় এটি।
ব্যবহারকারীকে প্ল্যাটফর্মে দীর্ঘ সময় রাখতে ও তুলনামূলক বেশিবার আনতে সাহায্য করে এই ব্যবস্থা। ফলে এটি বিজ্ঞাপনদাতার পাশাপাশি টিকটকের বিজ্ঞাপনী আয়ের জন্যেও ভালো।
“এর মানে, এই কনটেন্ট যদি এমন একদল ব্যবহারকারী দেখে, সম্পৃক্ত হয় এবং পছন্দ করে, যারা ধরা যাক, অ্যান্ড্রু টেইটের ভক্ত, তবে ওই কনটেন্টের অংশ হয়তো আরও বেশি লোক দেখবেন, যারা এই ধরনের ব্যবহারকারী।” --বলেছেন নাভারা।
“এটি চলতেই থাকে।”
“নির্মাতা চাইলেও স্টেশন একবার ছেড়ে গেলে, নির্মাতা এই ট্রেনের গতি আর আটকাতে পারেন না, কারণ অ্যালগরিদমের ওপর তাদের কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। আর, এইসব সমস্যা নিয়ে অভিযোগ জানানোর সুযোগও সীমিত।”
জুলাইয়ে বিভিন্ন প্রতিবেদনে উঠে এসেছে, ফেইসবুক ও ইনস্টাগ্রামের মালিক কোম্পানি মেটা এরইমধ্যে টিকটকের কাছাকাছি একটি অ্যালগরিদম বানাচ্ছে। ফেইসবুক এতোদিন ব্যবহারকারীর অনুসরণ করা নির্মাতাদের কনটেন্ট দেখাতো।