এদের দেখলে মনে হয়, ফুঁ দিলেই এগুলো উড়ে যাবে। গোটা বিশ্বে এমন হাজার হাজার ‘নিখুঁতভাবে ভারসাম্য ধরে রাখা পাথরের’ দেখা মেলে।
Published : 01 Dec 2024, 03:24 PM
এদের দেখলে মনে হয়, ফুঁ দিলেই এগুলো উড়ে যাবে। গোটা বিশ্বে এমন হাজার হাজার ‘নিখুঁতভাবে ভারসাম্য ধরে রাখা পাথরের’ দেখা মেলে। এদের অদ্ভুত অবস্থানের কারণে মনে হয়, এগুলো যে কোনো সময় পড়ে যেতে পারে।
এইসব পাথর একসময় নিছক ভূতাত্ত্বিক কৌতুহলের বিষয় মনে হলেও এখন ভূমিকম্পের ঝুঁকি নিয়ে মানুষের প্রচলিত ধারণা আরও উন্নত করার সম্ভাবনা দেখাচ্ছে এগুলো।
এত সূক্ষ্মভাবে অবস্থান করা এইসব পাথর যেভাবে এখনও দাঁড়িয়ে আছে, তা ইতিহাস সম্পর্কে গভীর ধারণা দেয়। আধুনিক সিসমোমিটারে ভূমিকম্প পরিমাপের বহু আগে থেকেই এদের অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায়।
“পৃথিবীতে একসময় কী ঘটেছে, এইসব বিরল পাথর সে ধারণা পাওয়ার একমাত্র সাক্ষী,” বলেন যুক্তরাজ্যের ইম্পেরিয়াল কলেজ লন্ডনের ভূতত্ত্ববিদ ডিলান রুড।
এমনকি ভবিষ্যতের জন্য প্রস্তুতি নেওয়ার বেলাতেও এগুলো কাজে দিতে পারে। এর মধ্যে রয়েছে ভূমিকম্পের বিপদ চিহ্নিত করা মানচিত্র ব্যবস্থা উন্নত করার বিষয়টিও, যার ফলে দুর্যোগ পরিকল্পনা, বীমা ও বাড়ি নির্মাণের ক্ষেত্রেও সাবধান হওয়ার সুযোগ মিলবে বলে প্রতিবেদনে লিখেছে বিবিসি।
এগুলো ভেঙে পড়বে না তো?
এ ধরনের পাথরগুলো ‘প্রিক্যারিয়াসলি ব্যালেন্সড রক’ বা ‘পিবিআর’ নামে পরিচিত, যা ‘ফ্র্যাজাইল জিওলজিকাল ফিচার্স’ নামের ভূমিরূপের মধ্যে পড়ে।
এদের কয়েকটির উৎপত্তি ঘটেছে পাহাড় ক্ষয়ের মাধ্যমে, যার মধ্যে রয়েছে ‘রক আর্চ’ শ্রেণির পাথর, যা দেখতে অনেকটা দরজার মতো এবং সেইসব পাথরের চূড়া, যেগুলো দেখতে টাওয়ারের মতো।
যুক্তরাষ্ট্রের ইউটাহ অঙ্গরাজ্যে অবস্থিত আর্চেস ন্যাশনাল পার্কে এ ধরনের বৈশিষ্ট্যওয়ালা হাজার হাজার পাথরের দেখা মেলে। এদের অবস্থান এমন এক অঞ্চলে, যেখানে প্রায়শই বৃষ্টির পানির কারণে জমাট বেঁধে থাকা বেলে পাথর ক্ষয়ের ঘটনা ঘটে থাকে।
এদিকে, সমুদ্রের স্রোত থেকেও পাথর ক্ষয়ে এমন চূড়া তৈরি হতে পারে। এর অন্যতম নজির হচ্ছে স্কটল্যান্ডের অর্কনি আইল্যান্ডসে অবস্থিত ‘ওল্ড ম্যান অফ হয়’, যার চূড়ায় প্রায়শই ভ্রমণপিপাসূরা আহরণ করেন।
অন্যান্য ক্ষেত্রে এমন ভূতাত্বিক বৈশিষ্ট্য বেড়ে উঠতে কিছুটা সময় লাগে। এর উদাহরণ হিসেবে ধরা যায়, গুহার মধ্যে ‘ডিপ ফ্রিজের বরফের মতো’ ঝুলে থাকা বিভিন্ন খাড়া পাথর, যেগুলো ‘স্টালাগমাইটস’ নামে পরিচিত। কিছু কিছু ক্ষেত্রে, এদের দৈর্ঘ্য বেশ কয়েক মিটার পর্যন্ত হতে পারে। আর কিছুক্ষেত্রে এদের ভর অনেক বেশি হলেও এদের ব্যাস মানুষের হাতের চেয়ে বেশি হয় না।
ইতিহাসের জানালা
হাইকাররা সেলফি তোলার উদ্দেশ্যে এইসব বিপজ্জনক পাথর ভ্রমণ করলেও, ভূমিকম্প নিয়ে গবেষণা করা সিসমলজিস্টদের কাছে এর আবেদন ভিন্ন কিছুর কারণে। সেটা হল, অতীতে ঘটে যাওয়া বিভিন্ন ভূমিকম্প সম্পর্কে নতুন তথ্য দেওয়ার সম্ভাবনা দেখাচ্ছে এগুলো।
কিন্তু সেটা কীভাবে, তা জানতে ফিরে যেতে হবে ৯০’র দশকের শুরুতে, যখন ভূতত্ত্ববিদরা ক্যালিফোর্নিয়া ও নেভাদায় অবস্থিত পাথরগুলোতে অদ্ভুত এক প্যাটার্ন লক্ষ্য করেছিলেন। এতে দেখা যায়, এদের সীমানা বা কোনার অংশ তুলনামূলক কম ক্ষয়প্রাপ্ত হয়।
ফলে, নতুন এক ধারণা তৈরি হয়েছে। তা হচ্ছে, এইসব পাথর থেকে ভূমিকম্প সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য বের হয়ে আসতে পারে। এমনকি কোনো এলাকায় এ ধরনের বিপজ্জনক পাথর থাকলে সেটা কত সময় পর পড়ে যেতে পারে, তা খুঁজে বের করার সম্ভাবনাও দেখাচ্ছে এ পাথরগুলো।
এইসব অনিশ্চিত শিলা সূক্ষ্মভাবে বিশ্লেষণ এবং পরিশোধনের পেছনে কাজ করেছেন ইম্পেরিয়াল কলেক লন্ডনের গবেষক দম্পতি আনা ও ডিলান রুড। এমনকি অতীতের সাক্ষী হিসেবে বিবেচিত এইসব পাথর নিয়ে আরও গবেষণা করার লক্ষ্যে তারা আরও সুনির্দিষ্ট ও সম্ভাব্যতা-ভিত্তিক একটি পদ্ধতিও তৈরি করেছেন বলে উঠে এসেছে বিবিসি’র প্রতিবেদনে।
গুরুত্বপূর্ণ অবকাঠামো
এইসব অনিশ্চিত পাথরের সহায়তায় ভবিষ্যতে প্রকৌশলীরা এমন সিদ্ধান্তও নিতে পারেন যে, এ পাথরের আড়ালে কোনো তেজস্ক্রিয় বর্জ্য পুতে ফেলা উচিৎ কি না।
এমন পাথর নিয়ে পারমাণবিক পর্যায়ের প্রথম পরীক্ষা ক্ষেত্র হয়ে ওঠার কথা ছিল ‘ইয়ুকা’ পর্বতের, যা নেভাদায় অবস্থিত একটি সম্ভাব্য পারমাণবিক বর্জ্য ভাণ্ডার। কিন্তু এ পরীক্ষা এখন বাতিল হয়ে গেছে।
এ শ্রেণির যেসব পাথরে ‘বার্নিশ’-এর প্রলেপ রয়েছে, সেগুলো বিশ্লেষণ করেছেন ‘ইউনিভার্সিটি অফ নেভাদা, রেনো’র গবেষকরা। বার্নিশ একটি কাদামাটি সমৃদ্ধ পদার্থ, যা দীর্ঘ সময় ধরে মরুভূমিতে তৈরি হয়। এর উপস্থিতি থেকে গবেষকরা জানতে পারেন, এর মধ্যে কিছু কিছু শিলা ৮০ হাজার বছর ধরে সটান হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। এর থেকে ইঙ্গিত মেলে, ইয়ুকা পর্বতে যে ভূমিকম্পের ঝুঁকি আসলেই আছে।