বড় বাজেট ও প্রথম সারির চিপই এআইকে এগিয়ে নেওয়ার একমাত্র উপায় বলে যে ধারণা বাজারে রয়েছে, তাতে ছেদ টেনেছে চীনা অ্যাপের এই সাফল্য।
Published : 28 Jan 2025, 12:59 PM
চলতি মাসে যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে এসেই বাজিমাত করেছে চীনা কোম্পানির এআইভিত্তিক চ্যাটবট ডিপসিক। অ্যাপল স্টোরে যেসব ফ্রি অ্যাপ রয়েছে, তার মধ্যে ডিপসিকই সবচেয়ে বেশি ডাউনলোড হচ্ছে।
বিবিসি লিখেছে, হঠাৎ করেই জনপ্রিয়তা পাওয়া অ্যাপটি জানিয়েছে, যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক এআই কোম্পানিগুলোর তুলনায় ডিপসিক তৈরিতে খরচ কম হয়েছে। আর ওই খবরেই টালমাটাল হয়ে উঠেছে আর্থিক বাজার।
সিলিকন ভ্যালির একজন মূলধন বিনিয়োগকারী (ভেনচার ক্যাপিটালিস্ট) মার্ক অ্যান্ড্রিসেন ডিপসিককে এআইয়ের ‘অন্যতম আশ্চর্যজনক এবং চমকপ্রদ অগ্রগতি’ হিসেবে বর্ণনা করেছেন।
অ্যাপটির নির্মাতা কোম্পানি বলছে, তাদের সবশেষ এআই মডেলটি চ্যাটজিপিটির মত যুক্তরাষ্ট্রের শীর্ষস্থানীয় মডেলের সমতুল্য। যদিও ডিপসিকের নির্মাণ খরচ যুক্তরাষ্ট্রের অ্যাপগুলোর তুলনায় ভগ্নাংশ মাত্র।
অ্যাপটি নির্মাণ সংশ্লিষ্ট গবেষকরা বলছেন, এটি নির্মাণে মোটে ৬০ লাখ ডলার খরচ হয়েছে, যা শত শত কোটি ডলার খরচ করা মার্কিন কোম্পানিগুলোর তুলনায় অনেক কম।
ডিপসিক কী?
চীনের দক্ষিণ-পূর্বের শহর হাংচৌ’য়ে প্রতিষ্ঠিত দেশটির একটি আর্টিফিশিয়াল ইনটেলিজেন্স কোম্পানি ডিপসিক।
ডিজিটাল অর্থনীতি পর্যবেক্ষণ করা সেন্সর টাওয়ারের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৩ সালের জুলাইয়ে ডিপসিক যাত্রা করে। তবে তাদের জনপ্রিয় এআই অ্যাসিস্টেন্ট অ্যাপটি গত ১০ জানুয়ারির আগে যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে আসেনি।
ডিপসিকের প্রতিষ্ঠাতা লিয়াং ওয়েনফেং কে?
ডিপসিক নির্মাণ খরচের একাংশ হেজ ফান্ড থেকে মিটিয়েছেন লিয়াং ওয়েনফেং। ওই ফান্ড গঠনের সঙ্গে তিনি নিজেও সম্পৃক্ত রয়েছেন।
বিবিসি লিখেছে, তথ্য ও ইলেক্ট্রনিক প্রকৌশলে স্নাতক ৪০ বছর বয়সী এই ব্যক্তি বিপুল পরিমাণ এনভিডিয়া এ১০০ চিপ মজুদ করেছেন বলে জানা যাচ্ছে, যে চিপটি বর্তমানে চীনে রপ্তানি করা নিষিদ্ধ।
মজুদ করা আনুমানিক ৫০ হাজার এনভিডিয়া চিপের সঙ্গে তুলনামূলক সস্তা ও চীনে সহজলভ্য চিপ জোড়া লাগিয়ে তিনি ডিপসিক চালু করেছেন বলে বিশেষজ্ঞদের ধারণা।
ডিপসিক নির্মাতা লিয়াংকে সম্প্রতি চীনের প্রধানমন্ত্রী লি ছিয়াংয়ের সঙ্গেও বৈঠক করতে দেখা গেছে।
অ্যাপটি কারা ব্যবহার করছে?
ডিপসিক এআই অ্যাপটি এখন অ্যাপলের অ্যাপ স্টোর এবং তাদের ওয়েবসাইট থেকে ডাউনলোড করা যাচ্ছে।
বিনামূল্যে সেবা দেওয়া অ্যাপটি দ্রুত সময়ের মধ্যে অ্যাপ স্টোরের শীর্ষ ডাউনলোডেড অ্যাপের নজির গড়েছে। যদিও নিবন্ধনের ক্ষেত্রে অনেকই জটিলতার মুখে পড়ার কথা বলেছেন।
যুক্তরাষ্ট্রে অ্যাপলের বাজারে বিনামূল্যের অ্যাপের রেটিংয়ে ডিপসিকই এখন শীর্ষে অবস্থান করছে।
অ্যাপটি কী করতে পারে?
ডিপসিক জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে তার শক্তিশালী এআই অ্যাসিস্টেন্টের জন্য, যা চ্যাটজিপিটির মতই কাজ করে।
অ্যাপ স্টোরের বিবরণ অনুযায়ী, ‘আপনার প্রশ্নের উত্তর দিতে এবং দক্ষতার সঙ্গে আপনার জীবনকে উন্নত করতে’ এটি নকশা করা হয়েছে।
অ্যাপটিকে রেটিং দেওয়া ব্যবহারকারীদের মন্তব্যে বলা হয়েছে, “এটি লেখাকে আরও ব্যক্তিত্বঘনিষ্ঠ করে তোলে।”
তবে রাজনৈতিকভাবে স্পর্শকাতর প্রশ্ন চ্যাটবটটি এড়িয়ে যায় বলে জানিয়েছে বিবিসি।
১৯৮৯ সালের ৪ জুন তিয়েনআনমেন স্কয়ারে কী ঘটেছিল তা জিজ্ঞাসা করলে ডিপসিক উত্তর দেয়: “আমি দুঃখিত, আমি এই প্রশ্নের উত্তর দিতে পারব না। আমি একজন এআই অ্যাসিস্টেন্ট- সহায়ক এবং অক্ষতিকর প্রতিক্রিয়া সরবরাহের জন্য আমাকে নকশা করা হয়েছে।”
বাজারে কেন প্রভাব পড়ল?
ডিপসিক যে অর্থ দিয়ে তৈরি করা হয়েছে, তা এর মার্কিন প্রতিদ্বন্দ্বীদের ব্যয়ের একটি ভগ্নাংশের সমান মাত্র। মার্কিন কোম্পানির তুলনায় শত শত মিলিয়ন ডলার কমে প্রতিষ্ঠিত চীন কোম্পানির উত্থান আমেরিকার এআই আধিপত্যের ভবিষ্যত নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে।
কোম্পানির সম্ভাব্য কম খরচের তথ্য ২৭ জানুয়ারি আর্থিক বাজারকে বিপর্যস্ত করে তোলে। তাতে করে বিশ্বজুড়ে চিপ নির্মাতা এবং ডেটা সেন্টারগুলোর দরে বড় পতন ঘটেছে; আর প্রযুক্তি কোম্পানি সমৃদ্ধ পুঁজিবাজার নাসডাকের দরপতন হয়েছে ৩ শতাংশ।
বিবিসি লিখেছে, যে চিপ ব্যবহার করে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা এআই পরিচালিত হয়, সেই শক্তিশালী চিপ তৈরির মার্কিন কোম্পানি এনভিডিয়া সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
সোমবার এ কোম্পানির ১৭ শতাংশ দরপতন হয়, যার বাজারমূল্য প্রায় ৬০ হাজার কোটি ডলার। এটিই যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে কোনো কোম্পানির জন্য একদিনে সবচেয়ে বড় পতন।
ফোর্বসের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাজারমূল্য বিবেচনায় বৈশ্বিক নিরিখে এনভিডিয়ার অবস্থান শীর্ষে ছিল। কিন্তু সোমবার এ কোম্পানির বাজার মূল্য ৩ দশমিক ৫ ট্রিলিয়ন ডলার থেকে ২ দশমিক ৯ ট্রিলিয়ন ডলারে নেমে আসে; তাতে অ্যাপল ও মাইক্রোসফটের পর তৃতীয় স্থানে নেমে যায় এনভিডিয়া।
এনভিডিয়ার তৈরি চিপের চাইতে কম উন্নত সেমিকন্ডাক্টর চিপ ব্যবহার করে ডিপসিক।
বিবিসি লিখেছে, বড় বাজেট ও প্রথম সারির চিপই এআইকে এগিয়ে নেওয়ার একমাত্র উপায় বলে যে ধারণা বাজারে রয়েছে, তাতে ছেদ ঘটিয়েছে ডিপসিকের সাফল্য। পাশাপাশি উচ্চ-পারফরম্যান্স চিপের প্রয়োজনীয়তা এবং এমন চিপের ভবিষ্যত সম্পর্কে বড় ধরনের অনিশ্চয়তাও তৈরি হয়েছে।