আনুষ্ঠানিক হিসেবে দেড়শ দিন পেরিয়েছে ইউক্রেইন যুদ্ধ। রাশিয়ার সামরিক আগ্রাসন শুরু হওয়ার পর থেকেই স্বদেশ প্রতিরক্ষায় ড্রোন ব্যবহার করছে ইউক্রেইন। তবে, এই সামরিক কাজে ব্যবহৃত ড্রোনগুলো তৈরি হয়েছিল অসামরিক কাজে ব্যবহারের লক্ষ্যে।
পিছিয়ে নেই রাশিয়াও, আকাশপথে হামলা চালাতে নিজস্ব স্বয়ংক্রিয়যান ব্যবহার করছে দেশটির সেনা বাহিনী।
প্রযুক্তির অগ্রগতি যে যুদ্ধ-বিগ্রহের দৃশ্যপট পাল্টে দিতে পারে, একুশ শতকে এসেও যেন তারই প্রত্যক্ষ প্রমাণ মিলছে ইউক্রেইন-রাশিয়া যুদ্ধ থেকে। কয়েক দশক ধরে যুদ্ধক্ষেত্রে ড্রোনের উপস্থিতি থাকলেও, অসামরিক ড্রোনের সামরিকায়ন আর ব্যবহারের পরিধি বলছে, ইউক্রেইন-রাশিয়া যুদ্ধে নতুন মাত্রা যোগ করেছে ড্রোন প্রযুক্তি।
ইউক্রেইন বনাম রাশিয়া: কার কাছে কোন ড্রোন?
বিবিসি জানিয়েছে, ইউক্রেইনের মূল সামরিক ড্রোনের ভূমিকায় আছে তুরস্কের তৈরি ‘বায়রাক্তার টিবি২’ ড্রোন। আকারে ছোট প্লেনের সমান ড্রোনটির আছে নিজস্ব ক্যামেরা। লেজার নিয়ন্ত্রিত বোমা বহন করতে পারে এটি।
যুদ্ধের শুরুতে ইউক্রেইনের কাছে ৫০টিরও কম বায়রাক্তার টিবি২ ড্রোন ছিল বলে জানিয়েছে বিবিসি।
বিপরীতে রাশিয়ার মূল ড্রোনের ভূমিকা পালন করছে আকারে তুলনামূলক ছোট ‘ওরল্যান-১০’। বায়রাক্তারের মতো আধুনিক না হলেও, রাশিয়া কয়েক হাজার ওরল্যান-১০ নিয়ে যুদ্ধে নেমেছিল। পাঁচ মাস শেষে রাশিয়ার ওরল্যান-১০ ড্রোনের সংখ্যা এখন শ’র ঘরে।
এই ড্রোনগুলোরও নিজস্ব ক্যামেরা আছে; আছে মিসাইল ছোড়ার সক্ষমতা।
সামরিক ড্রোনের কার্যকারিতা কতোটুকু?
উভয় পক্ষের ড্রোনের সবচেয়ে কার্যকার ব্যবহার দেখা গেছে শত্রুকে চিহ্নিত করে গোলাবর্ষণের দিক নির্দেশনা দেওয়ার ক্ষেত্রে।
“রাশিয়ার বাহিনী ওরল্যান-১০ দিয়ে শত্রুকে চিহ্নিত করার তিন থেকে পাঁচ মিনিটের মধ্যে কামানের লক্ষ্য ঠিক করে গোলা ছুড়তে পারে। ড্রোনগুলো ছাড়া এ কাজে ২০ থেকে ৩০ মিনিট সময় লাগতো”-- জানিয়েছেন যুক্তরাজ্যের থিংক ট্যাংক ‘রয়্যাল ইউনাইটেড সার্ভিস ইনস্টিটিউট’ (রুসি)’র গবেষক ড. জ্যাক ওয়াটলিং।
অন্যদিকে, ড্রোনের সুবাদে ইউক্রেইন ছোট সামরিক বাহিনী নিয়েও বড় এলাকা জুড়ে প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ধরে রাখতে পেরেছে বলে মন্তব্য করেছেন কিংস কলেজ লন্ডনের প্রতিরক্ষাবিষয়ক গবেষক ড. মার্টিনা মিরন।
“শত্রুর অবস্থান খুঁজে বের করতে আগে স্পেশাল ফোর্সের ইউনিট পাঠাতে হতো, এতে প্রাণহানিও হতো। আর এখন সর্বোচ্চ একটা ড্রোনকে ঝুঁকিতে ফেলছেন আপনি”-- বলেন ড. মিরন।
যুদ্ধের প্রথম কয়েক সপ্তাহে ইউক্রেইনের বায়রাক্তার বেশ সমাদৃত হয়েছে। “অস্ত্র মজুদের মতো লক্ষ্যে হামলা চালাতে দেখা গেছে ড্রোনগুলোকে। যুদ্ধজাহাজ মস্কোভা ডুবিয়ে দেওয়াতেও ভূমিকা রেখেছিল ড্রোনগুলো।”
তবে, ইউক্রেইনের মূল সামরিক ড্রোনের অনেকগুলো গত কয়েক মাসে রাশিয়ার আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ধ্বংস করেছে।
“ড্রোনগুলো আকারে বড়, তুলনামূলক ধীর গতির এবং ওড়ে মাঝারি উচ্চতায়; ফলে ড্রোনগুলো গুলি করে ফেলে দেওয়া বেশ সহজ,” বলে মন্তব্য করেছেন ড. ওয়াটলিং।
অসামরিক ড্রোনের ব্যবহার হচ্ছে কী ভাবে?
সামরিক ড্রোন প্রতিস্থাপনের খরচ অনেক। একটি বায়রাক্তার ড্রোনের দাম প্রায় ২০ লাখ ডলার। তাই উভয় পক্ষই কম দামের অসামরিক বাণিজ্যিক ড্রোনের দিকে ঝুঁকেছে। যুদ্ধক্ষেত্রে ডিজেআই ম্যাভিক ৩-এর মতো অসামরিক ড্রোনের উপস্থিতি এখন নজরে পড়ার মতো; দামও কম এই ড্রোনগুলোর, দুই হাজার ডলারের কিছু বেশি।
আকারে ছোট এই বাণিজ্যিক ড্রোনগুলোতে ছোট বোমাও জুড়ে দেওয়া যায়। তবে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই শত্রু বাহিনীর অবস্থান চিহ্নিত করতে এবং আক্রমণের দিক নির্দেশনা দিতে ব্যবহৃত হচ্ছে ড্রোনগুলো।
“রাশিয়ার সমান গোলাবারুদ নেই ইউক্রেইনের কাছে। শত্রুকে চিহ্নিত করার জন্য আকাশে চোখ থাকায় এবং গোলাবর্ষণের দিক নির্দেশনা দেওয়ার মাধ্যমে যা আছে তার পূর্ণ ব্যবহার করতে পারছে তারা,” বলেন ড. মিরন।
তবে সামরিক ড্রোনের সঙ্গে তুলনা করলে অসামরিক ড্রোনের অনেক সীমাবদ্ধতাও আছে। ডিজেআই ম্যাভিক সর্বোচ্চ ৩০ কিলোমিটার দূরে যেতে পারে, উড়তে পারে সর্বোচ্চ ৪৬ মিনিট। দাম কমার সঙ্গে সঙ্গে কমে আসে ড্রোনের ক্ষমতাও। বাণিজ্যিক ড্রোনগুলোর ওড়ার ক্ষমতা আরও কম।
ড্রোনের বিপরীতে দুই পক্ষ নিজেদের রক্ষা করছে কীভাবে?
ড. মিরন বলছেন, শত্রুপক্ষের ড্রোন মোকাবেলা করতে সামরিক ড্রোনের বেলায় রেডার প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা এবং বাণিজ্যিক ড্রোনের বেলায় ইলেকট্রনিক ডিভাইস ব্যবহার করছে রাশিয়া।
“রাশিয়া বাহিনীর কাছে স্টুপোর রাইফেল আছে, এটি ইলেকট্রোম্যাগনেটিক পালস ছুড়ে দেয়। এতে বাণিজ্যিক ড্রোনগুলোর জিপিএসের মাধ্যমে পথ খুঁজে নেওয়ার প্রক্রিয়ায় বাধা সৃষ্টি হয়।”
ছবি: mavic3-dji-250722-01 ছবি: ডিজেআইয়ের ইউটিউব ভিডিও থেকে।
এ ছাড়াও বাণিজ্যিক ড্রোনগুলো চিহ্নিত করতে এবং নিয়ন্ত্রকের সঙ্গে যোগাযোগে প্রতিবন্ধকতা তৈরি করতে ‘এরোস্কোপ’-এর মতো অনলাইন প্রযুক্তি ব্যবহার করছে রাশিয়া। ড্রোনকে তার বেইসে ফেরত পাঠানো থেকে শুরু করে, নিয়ন্ত্রকের কাছে তথ্য পাঠানোর পথ বন্ধ করে দিয়ে ক্র্যাশ করাতে পারে এরোস্কোপ।
রুসির প্রতিবেদন বলছে, ইউক্রেইনের ড্রোনগুলো যুদ্ধক্ষেত্রে গড়ে এক সপ্তাহ করে টিকছে।
ড্রোন সরবরাহ করছে কে?
হোয়াইট হাউজের তথ্য অনুযায়ী, এখন ইরানের কাছ থেকে ‘শাহিদ’ ড্রোন কিনছে রাশিয়া। সৌদি আরব এবং সংযুক্ত আরব আমিরাতে হামলা চালাতে একই ড্রোন ব্যবহার করেছে ইয়েমেনের হুতি বিদ্রোহীরা।
অন্যদিকে ইউক্রেইনকে প্রায় সাতশ সুইচব্লেড ‘কামিকাজি’ ড্রোন সরবরাহ করেছে যুক্তরাষ্ট্র। এই ড্রোনগুলোতে বিস্ফোরক ঠাসা থাকে। শত্রুর খোঁজ পাওয়ার আগ পর্যন্ত বাতাসেই ভেসে থাকে ড্রোনগুলো।
অন্যদিকে, ইউক্রেইনকে স্টারলিংকের মাধ্যমে স্যাটেলাইটনির্ভর ইন্টারনেট সেবা দিচ্ছেন স্পেসএক্স প্রধান ইলন মাস্ক। বাণিজ্যিক ড্রোন আর নিয়ন্ত্রকের মধ্যে নিরাপদ যোগাযোগের পথ করে দিচ্ছে স্টারলিংক।
আর রাশিয়া ও ইউক্রেইন উভয় পক্ষকে ড্রোন সরবরাহ বন্ধ করে দিয়েছে ডিজেআই।
ইউক্রেইন ড্রোনের দাম মেটাচ্ছে কী ভাবে?
সম্প্রতি দুইশ নতুন ড্রোন কিনতে তহবিল সংগ্রহ শুরু করেছে ইউক্রেইন। ড. মিরন বলেন, “বায়রাক্তার টিবি২-এর মতো বড় ড্রোনের পাশাপাশি, আকারে ছোট অনুসন্ধানী ড্রোনের খোঁজ করছেন তারা।”
যুদ্ধের তহবিল জোগাড় করতে সম্প্রতি নিজের ট্রফিও বেচে দিয়েছেন গানের প্রতিযোগিতা ইউরোভিশনের ইউক্রেইনিয়ান বিজয়ী কালুশ ওরকেস্ট্রা। তার অনুদানের ৯ লাখ ডলার দিয়ে ইউক্রেইনের নিজস্ব প্রযুক্তিতে তৈরি তিনটি পিডি-২ ড্রোনের দাম উঠবে বলে জানিয়েছে বিবিসি।