সল্ট: এআই বানাচ্ছে সিনেমা, গল্প লিখছেন দর্শকরাও

গল্পটি সরল নয়, দর্শকদের ভাবাচ্ছে এর বহুমাত্রিকতা। সমালোচকরা বলছেন, এআইয়ের চিত্রায়ন ‘ভয়াবহ সুন্দর আর রহস্যময়’।

প্রযুক্তি ডেস্কবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 26 Sept 2022, 09:18 AM
Updated : 26 Sept 2022, 09:18 AM

পর্দায় সত্তর বা আশির দশকের সায়েন্স ফিকশন সিনেমার আবহ তৈরি করছে ‘সল্ট’, আছে কাল্পনিক মহাকাশযানের ৩৫ মিলিমিটার ফুটেজ আর আলো-আঁধারিতে ঘেরা মলিন ভিনগ্রহ।

কিন্তু, হালের আর দশটি শর্টফিল্ম সিরিজের সঙ্গে এর মূল পার্থক্য– সিনেমার চিত্রায়নের পুরোটাই করছে আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স বা এআই প্রযুক্তি; আর গল্প লেখার বেলায় অংশ নিচ্ছেন দর্শকরাও।

শর্টফিল্ম সিরিজ ‘সল্ট’-এর পেছনের মূল মানুষটির নাম ফাবিয়ান স্টেলজার। পেশায় সিনেমা প্রযোজক বা নির্মাতা নন তিনি। কিন্তু এআই টুলের সহযোগিতা নিয়ে মাস তিনেক ধরে একের পর এক শর্ট ফিল্ম মুক্তি দিয়ে আলোচনায় আছেন এই সফটওয়্যার প্রকৌশলী; কয়েক সপ্তাহ পরপর টুইটারে মুক্তি দিচ্ছেন সিরিজের নতুন কিস্তি।

আর গল্প ফুরালে, সবগুলো ভিডিও একসঙ্গে এডিট করে পূর্ণদৈর্ঘ্য সিনেমা হিসেবে মুক্তি দেওয়ার কথা ভাবছেন এর নির্মাতা।

‘স্টেবল ডিফিউশন’, ‘মিডজার্নি’ আর ‘ডাল-ই টু’-এর মত ইমেজ জেনারেটর এআই ব্যবহার করে সিনেমার দৃশ্যগুলো তৈরি করছেন স্টেলজার। কণ্ঠ দেওয়ার কাজটি করছে ‘সিনথেশিয়া’ অথবা ‘মার্ফ’-এর মত এআই ভয়েস জেনারেটর টুল। সিনেমার সংলাপ শুনে বোঝাও বেশ কঠিন যে কোনো অভিনেতা নয়, কথা বলছে এআইয়ের কৃত্রিম কণ্ঠস্বর।

কেবল চিত্রায়ন বা সংলাপের বেলায় নয়, সিরিজের নতুন কিস্তিগুলোর গল্প লিখতেও ‘জিপিটি-থ্রি’ টেক্সট জেনারেটর ব্যবহার করছেন স্টেলজার।

এতে অংশ নিচ্ছেন সল্টের দর্শকরাও; প্রতি কিস্তির পরেই পরের কিস্তিতে কী হওয়া উচিত সে বিষয়ে ভোট দিচ্ছেন তারা। আর স্ক্রিপ্ট লেখার সময়ে আর চিত্রায়নের জন্য এআইয়কে নির্দেশনা দেওয়ার সময়ে দর্শকের মতামতকে গল্পের সঙ্গে সমন্বয় করছেন স্টেলজার।

এই সায়েন্স ফিকশন শর্টফিল্মগুলোর নির্মাণ প্রক্রিয়া প্রথাগত না হয়ে এআই নির্ভর হওয়ায় অল্প সময়ে একের পর এক নতুন কিস্তি তৈরি করতে পারছেন স্টেলজার।

“আমি চাইলেই আমার বাড়ির স্টুডিওতে বসে অন্তত ৭০টি সাই-ফাই সিনেমা বানাতে পারব,”– স্টুডিওতে বসেই সংবাদমাধ্যম সিএনএনের কাছে এ দাবি করেছেন স্টেলজার।

“আমি আসলে একটা সাই-ফাই সিনেমার চেয়েও বেশি কিছু করতে পারি। আমি চাইলেই ভাবতে পারি যে এ বাস্তবতায় এটি আসলে কী, যেখানে সৃষ্টির কাজ ভাবনার মতোই সহজ?”

সল্টের গল্প আসলে কোন দিকে যাচ্ছে, সেটা এখনও স্পষ্ট নয়। গল্পের মূল পটভূমি গড়ে উঠেছে দূরের মহাকাশের কাল্পনিক গ্রহ কাপলান থ্রি-কে কেন্দ্র করে; গ্রহটি খনিজ লবণের উৎস হলেও যাত্রা পথে বিপদে পড়েছে একটি স্পেসশিপ। আর গল্পটি সরলও নয়, এর বহুমাত্রিকতা ভাবাচ্ছে দর্শকদের।

কিন্তু ফলাফল? সেটা ‘ভয়াবহ সুন্দর আর রহস্যময়’ বলে মন্তব্য করা হয়েছে সিএনএন এর প্রতিবেদনে।

দুই মিনিট ২০ সেকেন্ডের চেয়ে বেশি দৈর্ঘ্যের ভিডিও আপলোডে সুযোগ নেই টুইটারে। তাই এখন পর্যন্ত সিরিজের সবগুলো ভিডিও দুই মিনিটের নিচে রেখেছেন স্টেলজার। আর ভিডিও পোস্ট করার ফাঁকে ফাঁকে ছবি আর ক্যাপশন দিয়েই সল্ট সিরিজের গল্পকে সামনে এগিয়ে নিচ্ছেন এর নির্মাতা।

‘মিডজার্নি’র সহযোগিতা নিয়ে তৈরি ‘স্পেস অপেরা থিয়েটার’ শিরোনামের চিত্রকর্মটি প্রতিযোগিতার পুরস্কার জেতার পর থেকে শিল্পচর্চায় এআইয়ের ব্যবহার নিয়ে খেপেছেন শিল্পীরা। আর স্টেলজারের ‘সল্ট’ সেই বিতর্কের আগুনে আরও ঘি ঢালছে।

সিএনএন লিখেছে, ছবি, টেক্সট আর কণ্ঠস্বর সৃষ্টি করতে সক্ষম এআইয়ের ক্ষমতা এবং সহজলভ্যতা যতোই বাড়ছে, সিনেমা নির্মাণ শিল্পকে কার্যত এলোমেলো করে দেওয়ার হুমকি দিচ্ছে এআই প্রযুক্তি। কেবল এ শিল্পখাত নয়, শিল্পকর্ম এবং শিল্পচর্চার ভাবনাকেই চ্যালেঞ্জ করছে প্রযুক্তির এ অগ্রগতি।

আপাতত এ প্রযুক্তির ওপর কাছ থেকে নজর রাখছেন হাতে গোনা কিছু মানুষ; কিন্তু ভবিষ্যতে এই প্রযুক্তির কাছ থেকে আরও বড় কিছু প্রত্যাশা রাখছেন তারা। “এটি (এআই নির্ভর সৃজরশীলতা) এখনও ভ্রুণের পর্যায়ে আছে,” বলেন স্টেলজার।

অনুপ্রেরণা এআই থেকেই

এআই ইমেজে জেনারেটর মিডজার্নি থেকেই স্টেলজারের সল্ট নির্মাণের অনুপ্রেরণা পেয়েছিলেন বলে জানিয়েছে সিএনএন। ব্যবহারকারীর লিখে দেওয়া ‘প্রম্পট’ বা নির্দেশনার ভিত্তিতে ছবি তৈরি করতে পারে এআই সিস্টেমটি। নির্দেশনার ভিত্তিতে মিডজার্নি যে ছবি বানিয়ে দিয়েছিল, সেটা দেখে ‘সিনেমার জগৎ’ বলে মনে হচ্ছিল স্টেলজারের।

ভিনগ্রহের অদ্ভুতুড়ে গাছপালা, ছায়ায় লুকিয়ে থাকা রহস্যময় কেউ আর লবণের স্ফটিকের মত কিছু একটা ছিল ছবিগুলোর একটিতে।

স্টেলজার বলেন, “নিজের সামনে ছবিগুলো দেখে আমার মনে হচ্ছিল; আচ্ছা, এই জগতে কী হচ্ছে আমি কিছুই জানি না, কিন্তু মনে হচ্ছে এখানে অনেকগুলো গল্প আছে, কৌতুহলউদ্দীপক অনেক কিছু আছে।”

সেখান থেকেই গল্পের বীজ পেয়েছিলেন বলে জানিয়েছেন তিনি। তবে এআই প্রযুক্তির সঙ্গে স্টেলজারের ঘনিষ্টতা এই প্রথম নয়। ২০০৯ সালে ‘আইকুয়ান্ট’ নামের একটি কোম্পানি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন তিনি। কোম্পানিটি কাজ করত এআই নিয়েই। ২০১৮ সালে সেই কোম্পানি বিক্রি করে দেন স্টেলজার।

কিন্তু সিনেমা নির্মাণের ব্যাপারে কিছুই জানা ছিল না তার। মিডজার্নির ছবিতে গল্পের সন্ধান পাওয়ার পর সিনেমা নির্মাণ নিয়ে পড়ালেখা শুরু করেন। তারই ফলাফল সল্ট, ১৪ জুন কোনো বর্ণনা ছাড়াই সিরিজের প্রথম ট্রেইলার প্রকাশ করেন স্টেলজার।

কয়েক দিন পর সল্টের প্রথম এপিসোড মুক্তি পায়। তারপর মুক্তি পেয়েছে একাধিক কিস্তি, গল্প শেষে সবগুলো ভিডিওকে একসঙ্গে এডিট করে পূর্ণ দৈর্ঘ্যের সিনেমা হিসেবে মুক্তি দেওয়ার আশা করছেন স্টেলজার।

পাশাপাশি, এআইয়ের সহযোগিতা নিয়ে সিনেমা বানানোর জন্য একটি কোম্পনিও দাঁড় করাচ্ছেন তিনি।

অনলাইনে সল্টের ভক্তের সংখ্যা এখনও বেশি নয়, কেবল সাড়ে চার হাজার। স্টেলজার কীভাবে ভিডিওগুলো বানাচ্ছেন, দর্শকদের কেউ কেউ সেটাও জানতে চেয়েছেন তার কাছে।

এআইয়ের সহযোগিতা নিয়ে বানানো সিনেমার প্রতি দর্শকদের আগ্রহের কারণ ব্যাখ্যা করে স্টেলজার বলেন, “এটা আসলেই এমন একটা জগৎ তৈরি করতে পারে, যাতে দর্শকরা ডুবে যান। আমি কেবল দেখতে চাই যে এতে আরও কী কী সম্ভব।”