দুদিন পর ফের সূচক পতন, ‘এক শতাংশের পতন’ থামল কিছু কোম্পানির

টানা ৪৮ কর্মদিবস পতনের পর বাড়ল উসমানিয়া গ্লাস। ৪৪ কর্মদিবস পর বাড়ল জিলবাংলা সুগার মিলস, ৪৮ কর্মদিবসে দ্বিতীয়বারের মত বাড়ল তসরিফার দর।

জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 1 March 2023, 11:15 AM
Updated : 1 March 2023, 11:15 AM

টানা পড়তে থাকা পুঁজিবাজারে পরপর দুই কর্মদিবস সূচক বাড়লেও তৃতীয় দিনে এসে ছন্দপতন হল।

বুধবার সূচকের উত্থান-পতনে লেনদেন চললেও একেবারে শেষ ঘণ্টায় সূচক পড়ে যায়। এর আগ পর্যন্ত মনে হচ্ছিল টানা তৃতীয় দিন হয়ত সূচকের ঘরে পয়েন্ট যোগ করে লেনদেন শেষ হবে। 

টানা ৪৮ কর্মদিবস পড়ার পর দুটি কোম্পানিকে এদিন দর বৃদ্ধির শীর্ষ দশে উঠে আসতে দেখা গেল। আরও একটি কোম্পানি শীর্ষ দশে এসেছে, যার দর গত ৪৮ কর্মদিবসে কেবল আর একদিন বেড়েছে। অন্য একটি কোম্পানির দর এই সময়ে কমেছে ৪৪ কর্মদিবস; বাকি চার দিন একই দরে হাতবদল হয়েছে, আর চার দিন একটি শেয়ারও হাতবদল হয়নি। অন্য একটি কোম্পানির দর টানা দ্বিতীয় দিন বেড়ে গিয়েও শেষ পর্যন্ত পতন ঠেকাতে পারেনি।

সকালে লেনদেন শুরু হয় সূচক বাড়ার মধ্য দিয়ে। বেলা ১১টা ৪৫ মিনিটে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের সাধারণ সূচক ডিএসইএক্স আগের দিনের চেয়ে ১৮ পয়েন্ট বেশি ছিল। এরপর কিছুটা কমে ফের বেলা ১২টা ৫০ মিনিটে ১৬ পয়েন্ট বেড়ে লেনদেন হচ্ছিল।

সূচক এরপর কমতে থাকে। বেলা ১টা ৩৮ মিনিটেও তা আগের দিনের চেয়ে বেশি ছিল ৯ পয়েন্ট। বাকি ৪২ মিনিটে বিক্রির চাপে হয় পতন। এই সময়ে ১১ পয়েন্ট হারিয়ে শেষ পর্যন্ত আগের দিনের চেয়ে দুই পয়েন্ট কমে শেষ হয় লেনদেন।

এক পর্যায়ে শতাধিক কোম্পানির শেয়ারের দর বেড়ে লেনদেন হচ্ছিল। শেষ পর্যন্ত ৬৮টি কোম্পানির শেয়ারের দর বেড়েছে, কমেছে ৮০টির। আগের দিনের দরে হাতবদল হয়েছে ১৮২টি কোম্পানি, সেগুলোর প্রায় সবগুলোই ফ্লোর প্রাইসে।

৬০টি কোম্পানির একটি শেয়ারও হাতবদল হয়নি এদিন। এসব কোম্পানিও ফ্লোর প্রাইসে আছে।

সূচক কমলেও লেনদেন কিছুটা বেড়েছে। হাতবদল হয়েছে ৪৫২ কোটি ৪০ লাখ ২০ হাজার টাকার শেয়ার। যা আগের দিন ছিল ৪২০ কোটি ৬৬ লাখ ৩৭ হাজার টাকা।

এই লেনদেন গত ১২ কর্মদিবসের মধ্যে সর্বোচ্চ। এর আগে গত ১২ ফেব্রুয়ারি ডিএসইতে হাতবদল হয়েছিল ৪৭০ কোটি ৮৪ লাখ ৮০ হাজার টাকার শেয়ার।

গোটা ফেব্রুয়ারি মাস পুঁজিবাজারে বিনিয়োগকারীদের মধ্যে ছড়িয়েছে হতাশা। ১৯ কর্মদিবসে সূচক ৫০ পয়েন্ট কমার তথ্য বোঝা যাবে না বিনিয়োগকারীদের আর্থিক ক্ষতি কতটা হয়েছে।

বেশিরভাগ কোম্পানির শেয়ার তার বেঁধে দেওয়া সর্বনিম্ন দর বা ‘ফ্লোর প্রাইসে’ গড়াগড়ি খাওয়ার মধ্যে ‘ফ্লোর’ তুলে দেওয়া বহু কোম্পানির শেয়ার দর হারিয়েছে বেঁধে দেওয়া সর্বনিম্ন দর এক শতাংশ বা কাছাকাছি।

প্রায় প্রতি দিনই এক শ বা তার চেয়ে বেশি কোম্পানির শেয়ারের ক্রেতা থাকেনি। এ অবস্থায় পুঁজিবাজার স্বল্প মূলধনী কিছু কোম্পানির ওপর ভর করে আছে। এসব কোম্পানির দর বাড়লে সূচক বাড়ে, কমলে কমে।

গত ৮ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত এসব কোম্পানির দর ছিল ঊর্ধ্বমুখী। এরপর কোনোটি ২০ শতাংশ, কোনোটি ২৫ শতাংশ, কোনোটি তার চেয়ে বেশি দর হারিয়ে ফেলে। তবে যেহেতু শেয়ার সংখ্যা কম, তাই সূচকে প্রভাব পড়েনি বললেই চলে।

এই সময়ে গুঞ্জন ছড়ায়, সব কোম্পানির ‘ফ্লোর প্রাইস’ তুলে দেওয়া হবে। গত রোববার গুজব ব্যাপকভাবে ছড়ায়। এতে কম দামে শেয়ার বিক্রি করে দিতে চাইলেও ক্রেতা পাওয়া যায়নি। লেনদেন নেমে আসে দুইশ কোটি টাকার ঘরে।

তবে সেদিন নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসি থেকে আসে ‘বার্তা’। বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের প্রশ্নে সংস্থাটির মুখপাত্র রেজাউল করিম জানান, ফ্লোর প্রাইস তুলে দেওয়ার কোনো আলোচনাই হয়নি।

এরপর দুই কর্মদিবস স্বল্প মূলধনী কোম্পানিগুলোর শেয়ার উত্থানে ফেরে। তবে থামেনি ‘এক শতাংশের’ পতন। এর মধ্যে মঙ্গলবার বিএসইসি চেয়ারম্যান শিবলী রুবাইয়াত-উল ইসলাম রাজধানীতে একটি অনুষ্ঠানে বলেন, ‘ফ্লোর প্রাইস’ বহাল থাকবে। আর মার্চে পুঁজিবাজারের জন্য সুখবর আসবে।

এই সময়ের মধ্যে ব্যাংকগুলো লভ্যাংশ ঘোষণা করবে জানিয়ে তিনি বলেন, ‘ভালো’ লভ্যাংশের আশাই তিনি করছেন। তাতে পুঁজিবাজারে তারল্য বাড়বে।

তবে ‘সুখবর’ অন্যটি। তিনি জানান, বন্ডে যে বিনিয়োগ, সেটি ব্যাংকের বিনিয়োগসীমা বা এক্সপোজার লিমিটের বাইরে রাখার বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক ইতিবাচক সিদ্ধান্ত নেবে। তাতে ব্যাংকের বিনিয়োগ করার সক্ষমতা বাড়বে। সেই সুখবরের খবরে গত দুই দিনে সূচক বাড়ে ৩৪ পয়েন্ট।

টানা ৪৮ কর্মদিবস কমার পর বাড়ল দর

এদিন দর বৃদ্ধির শীর্ষ দশে থাকা তিনটি রাষ্ট্রায়ত্ত কোম্পানি ওসমানিয়া গ্লাস ঘুরে দাঁড়িয়েছে ৪৮ কর্মদিবস পর। জিলবাংলা সুগারের দর বেড়েছে ৪৪ কর্মদিবস পতনের পর।

গত ২১ ডিসেম্বর থেকে যেসব কোম্পানির ফ্লোর প্রাইস তুলে এক দিনে পতনের সীমা এক শতাংশ করে দেওয়া হয়, তার মধ্যে আছে এসব কোম্পানি।

কিন্তু গত ২১ ডিসেম্বর পর্যন্ত ফ্লোর প্রাইসেই বিক্রি হয় এসব কোম্পানির শেয়ার। যদিও লেনদেন ছিল খুবই কম। এরপর থেকে শুরু হয় দরপতর।

এর মধ্যে ৯.৪০ শতাংশ বেড়ে দর বৃদ্ধির শীর্ষ দশের দ্বিতীয় অবস্থানে উঠে এসেছে উসমানিয়া গ্লাস।

দরপতন শুরু হওয়ার আগে গত ২১ ডিসেম্বর ৭৪ টাকা ৬০ পয়সায় লেনদেন হয়। মঙ্গলববার নেমে আসে ৪৮ টাকা ৯০ পয়সায়। বুধবার সর্বোচ্চ বাড়তে পারত ৪ টাকা ৮০ পয়সা। বেড়েছে ৪ টাকা ৬০ পয়সায়। দিন শেষে দর দাঁড়িয়েছে ৫৩ টাকা ৫০ পয়সা।

জিলবাংলা সুগার মিলসের ছিল এই তালিকার ছয় নম্বরে। লোকসানি কোম্পানিটির দর বেড়েছে ৫.৮৪ শতাংশ। আগের দিন দর ছিল ১১৮ টাকা ১০ পয়সা। দিন শেষে দাঁড়িয়েছে ১২৫ টাকা। যদিও এক পর্যায়ে উঠে যায় ১২৯ টাকা ৪০ পয়সা।

গত ২১ ডিসেম্বর যখন টানা পতন শুরুর আগের দিন দর ছিল ১৭৪ টাকা ২০ পয়সা। ৫ থেকে ১০ জানুয়ারি পর্যন্ত তিন কর্মদিবসে লেনদেন হয় ১৬৪ টাকা ৩০ পয়সায়। এরপর আবার কমতে থাকে। এই কয়দিনে চারদিন একটি শেয়ারও হাতবদল হয়নি কোম্পানিটির।

দর বৃদ্ধির সপ্তম স্থানে থাকা বস্ত্র খাতের তসরিফা ইন্ডাস্ট্রিজের দরপতনও শুরু হয় ২২ ডিসেম্বর। এর আগে শেয়ারদর ছিল ২৪ টাকা ২০ পয়সা। মাঝে কেবল ১৭ জানুয়ারি একদিনের জন্য বেড়েছিল। এরপর আবার কমতে কমতে মঙ্গলবার দাঁড়ায় ১৭ টাকা ৮০ পয়সায়। সেখান থেকে এক টাকা বা ৫.৬১ শতাংশ বেড়ে লেনদেন শেষ হয়েছে ১৮ টাকা ৮০ পয়সায়। দিনের সর্বোচ্চ দর ছিল ১৯ টাকা ১০ পয়সা।

তবে শ্যামপুর সুগার মিলস টানা দুই দিন শুরুতে বেড়েও বাড়তি দর ধরে রাখতে পারেনি। কোম্পানিটির দর কমল টানা ৪৯ কর্মদিবস।

মঙ্গলবার দর বেড়ে লেনদেন শুরু করেছিল শ্যামপুর সুগার। তবে শেষ পর্যন্ত সর্বোচ্চ সীমার এক শতাংশের কাছাকাছি কমে শেষ করে লেনদেন। বুধবার লেনদেন শুরু হয় এক শতাংশের কাছাকাছি দর হারিয়ে। তবে পরে দেখা যায় উল্টো চিত্র। এক পর্যায়ে বাড়তে বাড়তে দর ঠেকে ৬৯ টাকা ৮০ পয়সায়। এরচেয়ে বেশি দর বাড়ার সুযোগ ছিল না।

দিনের শেষ লেনদেন হয় ৬৬ টাকায়, যা আগের দিনের চেয়ে ৩.৯৩ শতাংশ বেশি। তবে শেষ মুহূর্তের সমন্বয়ে দর দাঁড়ায় ৬৩ টাকা ১০ পয়সা, যা আগের দিনের চেয়ে ২০ পয়সা কম।

আরও ৪০টির বেশি কোম্পানি এক শতাংশ হারে দর হারিয়েছে এদিন।

দর বৃদ্ধির শীর্ষ তালিকায় পরপর দ্বিতীয় দিন দেখা গেল সাধারণ বীমা খাতের কোম্পানি বিজিআইসিকে।১০ শতাংশ দর বেড়েছে এর। গত এক মাসে ৬৯ টাকা ৩০ পয়সা থেকে দর ৪৪ টাকা ৬০ পয়সায় নেমে আসার পর মঙ্গলবারও দর বাড়ে ৯.৯৮ শতাংশ।

এছাড়া ঢাকা ইন্স্যুরেন্সের দর ৮.৮৬ শতাংশ, আলহাজ্ব টেক্সটাইলের দর ৭.৬৭ শতাংশ, এমবি ফার্মার দর ৬.৮৭ শতাংশ, প্রগতি লাইফের দর ৫.৩১ শতাংশ, আমরা নেটওয়ার্কেটর দর ৪.২৪ শতাংশ এবং লিব্রা ইনফিউশনের দর বেড়েছে ৩.৯১ শতাংশ।

আরও তিনটি কোম্পানির দর ৩ শতাংশের বেশি, ১২টির দর দুই শতাংশের বেশি, ১৯টির দর এক থেকে দুই শতাংশের কাছাকাছি কমেছে।

সূচক ফেলেছে ওরিয়ন গ্রুপ

যে ১০টি কোম্পানি সবচেয়ে বেশি সূচক কমিয়েছে, তার মধ্যে ওরিয়ন গ্রুপের কোম্পানি ছিল তিনটি। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ২.৩২ পয়েন্ট সূচক ফেলেছে বিকন ফার্মা। কোম্পানিটির দর কমেছে ১.২৭ শতাংশ। দিনের সবচেয়ে বেশি দর হারানো কোম্পানি ওরিয়ন ইনফিউশনের শেয়ারদর ৬.৩৩ শতাংশ কমায় সূচক কমেছে ১.১৪ পয়েন্ট। এছাড়া ওরিয়ন ফার্মার দর ০.৭২ শতাংশ কমায় সূচক কমেছে ০.৩ পয়েন্ট।

সব মিলিয়ে তিনটি কোম্পানির কারণেই সূচক কমেছে ৩.৭৬ পয়েন্ট।

গ্রুপের অপর কোম্পানি কোহিনূর কেমিক্যালস দর হারিয়েছে ৪ টাকা ১ পয়সা বা ০.৯৭ শতাংশ।

এছাড়া সোনালী পেপার ১.৭৯ পয়েন্ট, সি পার্ল হোটেল ১.৬৩ পয়েন্ট, বসুন্ধরা পেপার ০.৬৯ পয়েন্ট, বাংলাদেশ শিপিং করপোরেশন ও জেএমআই হসপিটাল ০.৫৬ পয়েন্ট করে, ইউনিক হোটেল ০.৪৮ পয়েন্ট এবং এডিএন টেলিকমের কারণে সূচক ০.৪৩ পয়েন্ট কমেছে।

এই ১০টি কোম্পানির কারণে সূচক পড়েছে ৯.৯২ পয়েন্ট।

দর পতনের শীর্ষ দশের মধ্যে ওরিয়ন ইনফিউশন ছাড়াও সবগুলোর দরই কমেছে এক শতাংশের বেশি। এগুলোর সবগুলোর ‘ফ্লোর প্রাইস’ আছে এবং সেগুলো বেঁধে দেওয়া সর্বমিম্ন দরের বেশিতে লেনদেন হচ্ছে।

এর মধ্যে সোনালী পেপারের দর ৩.২২ শতাংশ, জেএমআই হসপিটালের দর ২.১৯ পয়েন্ট, বসুন্ধরা পেপার মিলসের দর ১.৯২ পয়েন্ট, এডিএন টেলিকমের দর ১.৯১ পয়েন্ট, সোনালী লাইফের দর ১.৮৮ পয়েন্ট, সি পার্লের দর ১.৮১ পয়েন্ট, রূপালী লাইফের দর ১.৭১ পয়েন্ট আইটিসির দর ১.৪২ পয়েন্ট এবং বিকন ফার্মার দর কমেছে ১.২৬ পয়েন্ট।