৯৩০ কোটি টাকা লভ্যাংশে ‘নাখোশ’, না দেওয়া কোম্পানির দরে লাফ

পুঁজিবাজার বিশ্লেষক আবু আহমেদ বলেন, “আমাদের মার্কেট খুবই অদ্ভুত। এখানে একাধিক সিন্ডিকেট কাজ করে। তাদের কাজই হলো যেসব কোম্পানির শেয়ার সংখ্যা কম, সেগুলো নিয়ে খেলাধুলা করা।”

নিজস্ব প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 23 Oct 2023, 09:47 AM
Updated : 23 Oct 2023, 09:47 AM

শেয়ার প্রতি সাড়ে ১০ টাকা হিসেবে ৯৩০ কোটি ৭৭ লাখ ৩৫ হাজার ৬০৫ টাকা লভ্যাংশ ঘোষণার পরদিন স্কয়ার ফার্মার শেয়ারের দর বাড়ল ৪০ পয়সা।

অন্যদিকে পাঁচ বছরের আর্থিক প্রতিবেদন প্রকাশ করে লভ্যাংশ না দেওয়ার সিদ্ধান্ত জানানো ইমাম বাটনের শেয়ারদর দুই দিনে বাড়ল ২১ টাকা ১০ পয়সা বা সাড়ে ১৪ শতাংশ।

দুই বছরেরও বেশি সময় ধরে মন্দার মধ্য দিয়ে যাওয়া পুঁজিবাজার যে স্বাভাবিক আচরণ করছে না, সেটির প্রমাণ আবার দেখা গেল।

সোমবার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ-ডিএসইতে দিনভর উঠানামার পর সাধারণ সূচক ডিএসইএক্স বাড়ল ১.৭২ পয়েন্ট। আর এদিন লভ্যাংশ ঘোষণা করা দুই কোম্পানির শেয়ারদরে এই বিপরীতমুখী চিত্র উঠে এল।

গত দুই দিনে এক ঝাঁক কোম্পানি লভ্যাংশ ঘোষণা করেছে। এর মধ্যে সর্বোচ্চ লভ্যাংশ দিয়েছে স্কয়ার ফার্মা, কিন্তু এর দরে বিনিয়োগকারীদের আগ্রহ দেখা যায়নি।

একইভাবে ৬৭ টাকা ৫০ পয়সা দর থাকা স্কয়ার ফার্মা ৩০ শতাংশ বা শেয়ারপ্রতি ৩ টাকা লভ্যাংশ ঘোষণার পর ফ্লোর প্রাইসই ছাড়াতে পারেনি শেয়ারদর।

স্কয়ার ফার্মার তাও প্রায় ২ লাখ ৭০ হাজার শেয়ার হাতবদল হয়েছে, কিন্তু স্কয়ার টেক্সটাইলে কেবল ৭ হাজার ৩৪৫টি শেয়ার বিক্রি হয়েছে।

অথচ একই দিন টানা ১৩ বছর লভ্যাংশ দিতে না পারা ইমাম বাটনের ১ লাখ ৫ হাজার ৯৪৬টি শেয়ার হাতবদল হয়েছে।

পুঁজিবাজার বিশ্লেষক আবু আহমেদ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম বলেছেন, “এসব বলে এখন আর কোনো লাভ নেই। আমাদের পুঁজিবাজার কোনো স্বাভাবিক বাজার না। স্কয়ার ফার্মা গত বছরও একই পরিমাণ লভ্যাংশ দিয়েছিল। কোম্পানি আরও বড় হচ্ছে, এর সম্ভাবনা ব্যাপক। এর শেয়ার যারা কিনেছেন তারা প্রকৃত বিনিয়োগকারী। কিন্তু ইমাম বাটনের শেয়ার যারা কিনেছেন, তারা তো তা নন।

“আমাদের মার্কেট খুবই অদ্ভুত। এখানে একাধিক সিন্ডিকেট কাজ করে। তাদের কাজই হলো যেসব কোম্পানির শেয়ার সংখ্যা কম, সেগুলো নিয়ে খেলাধুলা করা। কোম্পানির কী চিত্র, তা এখানে গুরুত্বপূর্ণ না।”

আবু আহমেদ আরও দুটি কোম্পানির উদাহরণ টেনেছেন। সেটি হলো অ্যামবি ফার্ম ও লিবরা ইনফিউশন।

গত এক দশকে কোনো বছর শেয়ার প্রতি ৩ টাকার বেশি লভ্যাংশ ঘোষণা করতে না পারা অ্যামবি ফার্মার শেয়ারদর তিন মাসে ৫২১ টাকা থেকে বেড়ে হয়ে গেছে ১০২২ টাকা।

২০২৩ সালে এসে ২০২১ সালের আর্থিক প্রতিবেদন প্রকাশকে কেন্দ্র করে লিবরার শেয়ারদরও এক মাসে ৮০৭ টাকা থেকে বেড়ে হয়ে গেছে ১ হাজার ৫০৭ টাকা।

শেয়ারপ্রতি ১৫ পয়সা আয় করে কোম্পানিটি ৫০ শতাংশ বোনাস শেয়ার ও ৩০ শতাংশ নগদ লভ্যাংশ ঘোষণা করেছে।

অথচ শেয়ার প্রতি ৪ টাকা লভ্যাংশ ঘোষণা করা মতিন স্পিনিং মিলসের শেয়ারদর গত এক বছর ধরেই ফ্লোর প্রাইসে পড়ে আছে। গত বছরের ১৪ নভেম্বর থেকে শেয়ারের কোনো চাহিদাই নেই।

কোম্পানিটি গত বছরও ৫০ পয়সা এবং তার আগের বছর ৪০ শতাংশ নগদ লভ্যাংশ দিয়েছিল।

একইভাবে ১৭ টাকা ২০ পয়সা দর থাকা ফারইস্ট নিটিং শেয়ার প্রতি এক টাকা লভ্যাংশ ঘোষণার পরেও সেটি ফ্লোর প্রাইস ছাড়াতে পারেনি। কিন্তু গত চার বছরেও ৫ শতাংশের বেশি লভ্যাংশ দিতে না পারা তসরিফা ইন্ডাস্ট্রিজের শেয়ারদর বেড়েছে ২ টাকা ৫০ পয়সা প্রায় ৯ দশমিক ৮০ শতাংশ।

লেনদেন আবার কমল

আগামী ২৮ অক্টোবর বিরোধী দলের বড় সমাবেশের ঘোষণা এবং সেদিন থেকে আন্দোলনের ‘মহাযাত্রা’ শুরুর কথাকে কেন্দ্র করে রাজনৈতিক যে ডামাডোল তৈরি হয়েছে, মন্দা পুঁজিবাজারের বিনিয়োগকারীদের মধ্যে তাও বেশি প্রভাব ফেলেছে।

লেনদেনের খরায় থাকা পুঁজিবাজারে বিনিয়োগকারীরা শেয়ার কেনার সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে বাজার পর্যবেক্ষণ করছেন, যে কারণে টানা দুই দিন কমে গেল লেনদেন।

দিনভর হাতবদল হয়েছে ৪৩৮ কোটি ৭৩ লাখ ১ হাজার টাকার শেয়ার, যা আগের দিন ছিল ৫৩৯ কোটি টাকারও বেশি। গত বৃহস্পতিবার লেনদেন হয়েছিল ৫৫৪ কোটি টাকার বেশি।

তালিকাভুক্ত ৩৯২টি কোম্পানির মধ্যে লেনদেন হয়েছে ৩০১টির। এর মধ্যে সব মিলিয়ে ৬৭টি কোম্পানি দর বেড়ে, ৭৭টি হারিয়ে এবং ১৫৭টি আগের দিনের দরে লেনদেন শেষ করেছে।

তবে ১০ লাখের বেশি শেয়ার হাতবদল হয়েছে কেবল ১২টি কোম্পানির। এক লাখের বেশি শেয়ার লেনদেন হয়েছে, এমন কোম্পানির সংখ্যা ৯৯টি। তবে আরও লাখ লাখ শেয়ার বিক্রির জন্য বসানো থাকলেও ক্রেতা ছিল না।

এদিন দর বৃদ্ধির শীর্ষ ১০টি কোম্পানি ছিল আমাম বাটন, তসরিফা ইন্ডাস্ট্রিজ, ক্যাপিটেক গ্রামীণ গ্রোফ ফান্ড, আরামিট লিমিটেড, আমরা নেটওয়ার্ক, ন্যাশনাল টি কোম্পানি, অ্যামবি ফার্মা, স্ট্যান্ডার্ড ইন্স্যুরেন্স, লিবরা ইনফিউশন ও ফিনিক্স ইন্সুরেন্স। এগুলোর মধ্যে ৯ শতাংশের বেশি দর বেড়েছে তিনটির। একটির ৮ শতাংশের বেশি, তিনটির ৭ শতাংশের বেশি এবং বাকি তিনটির দর বেড়েছে ৬ শতাংশের বেশি।

অন্যদিকে প্রায় ১০ শতাংশ কমে দর হারানোর শীর্ষে ছিল খান ব্রাদার্স পিপি ওভেন কোম্পানি। পতনের শীর্ষে থাকা অন্য কোম্পানিগুলো হলো নর্দার্ন ইন্স্যুরেন্স, ক্রিস্টাল ইন্স্যুরেন্স, ইস্টার্ন ইন্স্যুরেন্স, মেঘনা লাইফ, ফু ওয়াং ফুডস, জিকিউ বলপেন, কে অ্যান্ড কিউ, সোনালী লাইফ ও সমতা লেদার।

আগ্রহ কিছুটা বাড়ল বস্ত্রে

বেলা শেষে গত কয়েক মাসে বীমা খাতে সবচেয়ে বেশি লেনদেনের যে প্রবণতা দেখা যাচ্ছে, সেটি দেখা গেল আবার। মোট লেনদেনের ২১ দশমিক ৮৪ শতাংশ হয়েছে এই একটি খাতেই।

এর মধ্যে সাধারণ বীমা খাতে লেনদেন হয়েছে সাড়ে ১৫ শতাংশের বেশি, জীবন বীমায় ৬ শতাংশের কিছুটা বেশি।

তবে সাধারণ বীমার ১০টি কোম্পানির শেয়ারের দর বৃদ্ধির বিপরীতে কমেছে ৩১টির, একটি কোম্পানির লেনদেন হয়েছে ফ্লোর প্রাইসে।

জীবন বীমার একটির দর বেড়ে, চারটি আগের দিনের দরে এবং আটটি দর হারিয়ে লেনদেন শেষ করেছে।

লেনদেনে দ্বিতীয় অবস্থানে ছিল খাদ্য ও আনুষঙ্গিক খাত। মোট লেনদেনের ১৬ শতাংশের বেশি হয়েছে এই খাতে। দর বেড়েছে ৭টি কোম্পানির, ৬টি আগের দিনের দরে আর সাতটি দর হারিয়ে লেনদেন শেষ করেছে।

১২ দশমিক ৬৫ শতাংশ নিয়ে লেনদেনের তৃতীয় অবস্থানে ছিল ওষুধ ও রসায়ন খাত। দর বেড়েছে ৮টি কোম্পানির, কমেছে ৩টির আর ১৯ টি আগের দিনের দরে ফ্লোর প্রাইসে হাতবদল হয়েছে।

তবে দিনের চমক বলা যায় বস্ত্র খাতকে। দিনের বেশিরভাগ সময় লেনদেনের শীর্ষ অবস্থানে থাকলেও শেষ বেলায় ১২ দশমিক ৫৪ শতাংশ হিস্যা নিয়ে চতুর্থ অবস্থানে উঠে এসেছে খাতটি। গত কয়েক মাসের মধ্যে শতকরা হিসেবে এটি সর্বোচ্চ লেনদেন।

তবে ৫৮টি কোম্পানির বেশিরভাগের ফ্লোর প্রাইসে আটকে থাকার প্রবণতা থেকে বের হতে পারেনি এই খাতটি। দর বেড়েছে কেবল চারটির, ছয়টি দর হারিয়ে আর ৩১টি আগের দিনের দরে লেনদেন হয়েছে। বাকি ১৭টির লেনদেনই হয়নি।