পুঁজিবাজারে ঢালাও পতনে ‘মাথা উঁচু করে দুর্বল কোম্পানি’

এদিন যেসব কোম্পানির দর বেড়েছে, তার মধ্যে সাতটি কোম্পানি লোকসানি। এর মধ্যে দুটি বন্ধ ছিল কয়েক বছর। সম্প্রতি উৎপাদনে ফিরেছে।

নিউজ ডেস্কবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 19 Feb 2023, 10:16 AM
Updated : 19 Feb 2023, 10:16 AM

বড় দরপতন দিয়ে নতুন সপ্তাহের লেনদেন শুরু করেছে পুঁজিবাজার; ফ্লোর প্রাইসের কারণে সিংহভাগ কোম্পানির শেয়ারের দরপতন সম্ভব না হওয়ার পরও সূচক ১৮ পয়েন্ট কমে নেমে এসেছে পাঁচ সপ্তাহের সর্বনিম্ন অবস্থানে।

রোববার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জে বেড়েছে কেবল ১৮টি কোম্পানির দর। বিপরীতে কমেছে ১৪৮টির। ১৩২টি কোম্পানি ফ্লোর প্রাইসে আগের দিনের দরে হাতবদল হয়েছে।

সব মিলিয়ে লেনদেন হয়েছে ২৯৮টি কোম্পানির, যদিও তালিকাভুক্ত কোম্পানির সংখ্যা ৩৯২টি। এর মধ্যে একটির লেনদেন দীর্ঘদিন ধরে স্থগিত। ফলে ৯৩টি কোম্পানির একটি শেয়ারও হাতবদল হয়নি।

ডিএসইর প্রধান সূচক ডিএসইএক্সের অবস্থান নেমেছে ৬ হাজার ২২৭ দশমিক ৯৩ পয়েন্টে, যা গত ১২ জানুয়ারির পর সর্বনিম্ন। সেদিন সূচকের অবস্থান ছিল ৬ হাজার ২১৫ দশমিক ০৪ পয়েন্ট।

লেনদেন নেমেছে ২৮৫ কোটি ১৫ লাখ ৭৬ হাজার টাকায়। গত ৮ জানুয়ারির পর এটিই সর্বনিম্ন লেনদেন। সেদিন হাতবদল হয়েছিল ২৮৪ কোটি ২০ লাখ ৩ হাজার টাকা।

দর বৃদ্ধির তুলনায় পতন হওয়া কোম্পানির সংখ্যা এত বেশি হলেও সূচক তুলনামূলক কম কমার কারণ হল, এসব কোম্পানির শেয়ার সংখ্যা ও বাজার মূলধন কম। ফলে বড় দরপতনেও সূচকে তেমন প্রভাব পড়ে না। সূচকে উল্লেখযোগ্য প্রভাব পড়তে পারে, এমন কোম্পানির বেশিরভাগই ফ্লোর প্রাইসে পড়ে আছে।

এদিন যেসব কোম্পানির দর বেড়েছে, তার মধ্যে সাতটি কোম্পানি লোকসানি। এর মধ্যে দুটি বন্ধ ছিল কয়েক বছর। উৎপাদনে ফিরেছে সম্প্রতি।

যেগুলোর দর বেড়েছে, সেগুলোর শেয়ার দরে খুব বেশি অর্থ যোগ হয়নি। কেবল শীর্ষে থাকা একটির দর বেড়েছে ৯.৩৩ শতাংশ।

এর বাইরে একটির দর ৫ শতাংশের বেশি, দুটির তিন শতাংশের বেশি, দুটির দর ২ শতাংশের বেশি, তিনটির দর বেড়েছে এক শতাংশের বেশি।

অন্যদিকে যেসব কোম্পানির এক শতাংশের বেশি দর পতনের সুযোগ আছে, সেগুলোর বিনিয়োগকারীরা ব্যাপক আর্থিক ক্ষতির স্বীকার

৮ শতাংশের বেশি দর হারিয়েছে একটি কোম্পানি, ৭ শতাংশের বেশি হারিয়েছে ৪টি। ৫টি কোম্পানি ৪ শতাংশের বেশি, ৬টি কোম্পানি ৩ শতাংশের বেশি, ১০টি কোম্পানি ২ শতাংশের বেশি এবং ১১টি কোম্পানির শেয়ার ১ থেকে ২ শতাংশ পর্যন্ত দর হারিয়েছে।

বেশি দর হারানো বেশিরভাগ কোম্পানি স্বল্প মূলধনী, যেগুলোর দর গত এক মাস ধরে অনেকটাই বেড়ে গিয়েছিল। কিন্তু বাজার মূলধন কম হওয়ার কারণে সূচকে খুব বেশি প্রভাব রাখতে পারে না।

ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর থেকে অর্থনীতি নিয়ে অনিশ্চয়তায় টানা এক বছর ধরে পুঁজিবাজারের পরিস্থিতি নিয়ে বিনিয়োগকারীদের মধ্যে আছে তীব্র হতাশা। দরপতন কৃত্রিমভাবে ঠেকিয়ে রাখতে শেয়ারের সর্বনিম্ন দর বা ফ্লোর প্রাইস বেঁধে দিয়েও লাভ হয়নি।

এর মধ্যে প্রায় অর্ধেক কোম্পানির ফ্লোর প্রাইস তুলে দিয়ে পতনের সীমা এক শতাংশ করে দেওয়ার পর বিনিয়োগকারীদের মধ্যে তৈরি হয়েছে মিশ্র প্রতিক্রিয়া। ‘এক বাজারে দুই নীতি’ নিয়ে হচ্ছে আলোচনা।

আবার মূল বাজারে ফ্লোর প্রাইসের নিচে শেয়ার বিক্রি হওয়া সম্ভব না হলেও ব্লক মার্কেটে ১০ শতাংশ কমে বিক্রির সুযোগ দেয়া হয়েছে। এতে দেখা যাচ্ছে, কিছু কোম্পানির শেয়ারের লেনদেন মূল বাজারের চেয়ে ব্লকেই বেশি হচ্ছে।

এ পরিস্থতিতে বাজার সংশ্লিষ্টদের একটি অংশ ফ্লোর প্রাইস তুলে দেয়ার দাবি জানাচ্ছে, তবে নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসি এতে রাজি নয়। তারা বলছে, এই মুহূর্তে ফ্লোর প্রাইস তুলে দিলে বিনিয়োগকারীরা আতঙ্কিত হবে। এতে বড় দরপতনে লোকসানে পড়বে তারা।

কী কারণে এই দশা

পুঁজিবাজারের পরিস্থিতি নিয়ে জানতে চাইলে শীর্ষস্থানীয় একটি ব্রোকারেজের সিইও বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “লিক্যুইডিটি চ্যালেঞ্জ রয়েছে। যখন আপনার কাছে টাকা থাকে, তখন ২০ টাকার শেয়ার ৮০ টাকাতে কিনবেন। যদি না থাকে তাহলে ২০ টাকাতেও ওভারভ্যালুড মনে হবে। লিকুইডিটি ফিরে আসতে সময় লাগবে।

“পুরো মানি মার্কেটে এই তারল্য সংকট রয়েছে। আগে ব্যাংকগুলো বলছিল তারল্য আছে, কিন্তু হঠাৎ করে চ্যানেল ড্রাই হয়ে গেছে। এটার উৎপত্তিটা ডলার সংকট দিয়ে। এর কারণ আবার এক্সচেঞ্জ রেট। বাংলাদেশ ব্যাংক যখন আগে ডলার বিক্রি করত ৮৬ টাকায়, এখন সেটা ১০৪ টাকা । সেখানে বড় একটা ঘাটতি তৈরি হয়েছে। এসব কারণে ব্যাংকগুলোর শেয়ারবাজারে সাপোর্ট দেয়ার আগ্রহ কমে গেছে। কারণ, তার প্রধান ব্যবসাটা তো আগে সাপোর্ট করতে হবে। এটা একটা বড় কারণ।”

তিনি বলেন, “ব্যাংকগুলোর রিপেমেন্ট বন্ধ হয়ে আছে। গুডস ইমপোর্ট করা হয়েছে, কিন্তু উৎপাদন করে ক্যাশ কনভারশন সার্কেলটা হচ্ছে না, যার কারণে টাকা আটকে আছে। ক্যাশ কনভার্শন সার্কেলটা না ঘুরলে টাকা আসবে না।”

দর বৃদ্ধির শীর্ষে অনেক লোকসানি কোম্পানির ভিড়

সবচেয়ে বেশি দর বেড়েছে গোল্ডেন জুবিলি মিউচুয়াল ফান্ডের। গত ডিসেম্বরে সমাপ্ত অর্থবছরের জন্য ১০ টাকার ইউনিটপ্রতি ১২ পয়সা লভ্যাংশ ঘোষণার প্রতিক্রিয়ায় গত ১৫ ফেব্রুয়ারি ৩০ শতাংশ দর হারিয়ে ৯ টাকা ৯০ পয়সা থেকে ৬ টাকা ৯০ পয়সায় নেমে যায়।

পরের দুই কর্মদিবসে সর্বোচ্চ পরিমাণ বেড়ে কিছুটা দর পুনরুদ্ধার করল পুঁজিবাজারে অবণ্টিত লভ্যাংশ দিয়ে গঠন করা মিউচুয়াল ফান্ডটি। বৃহস্পতিবার ৬০ পয়সার পর আবার বাড়ল ৭০ পয়সা। বর্তমান দর ৮ টাকা ২০ পয়সা।

দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ৫.৬৭ শতাংশ বেড়ে স্বল্প মূলধনী কোম্পানি মুন্নু অ্যাগ্রোর শেয়ারদর দাঁড়িয়েছে ১ হাজার ৬৩ টাকা ৩০ পয়সায়।

কখনও ভালো লভ্যাংশ দিতে না পারা কোম্পানিটি শেয়ারদর মন্দা বাজারেও গত এক বছরের সর্বোচ্চ অবস্থানে। গত ২০ নভেম্বরও দর ছিল ৫৫৬ টাকা ৫০ পয়সায়। তিন মাসে প্রায় দ্বিগুণ হয়ে গেছে দর।

এছাড়া ছয় বছর পর পরীক্ষামূলক উৎপাদনে ফেরার পর লাফাতে থাকা জুট স্পিনার্স টানা পতনের বৃত্ত ভেঙে আবার ফিরেছে উত্থানে। দুই দিনে ১৯ টাকা ৪০ পয়সা বেড়ে দর এখন ২৫৭ টাকা ২০ পয়সায়। রোববার বেড়েছে ৩.৭৪ শতাংশ।

এছাড়া পাঁচ বছর পর উৎপাদনে ফেরা এমারেল্ড অয়েল ২০১৭ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত তিন বছরের আর্থিক প্রতিবেদন প্রকাশের তথ্য জানানোর পরদিন এমারেল্ড অয়েলের দর বেড়েছে ৩.৩৩ শতাংশ।

ইউনিটপ্রতি ৬০ পয়সা লভ্যাংশ ঘোষণা করা এনসিসিব্যাংক মিউচুয়াল ফান্ডের দর ২.৮৫ শতাংশ; আমরা টেকনোলজির দর ২.০৮ শতাংশ; লোকসানের কারণে গত এক যুগেও লভ্যাংশ দিনে তা পারা দুলামিয়া কটনের দর ১.৮১ শতাংশ; রূপালী লাইফের দর ১.৪৯ শতাংশ; অর্ধবার্ষিকে শেয়ার প্রতি ১০ টাকা ৫৭ পয়সা লোকসান দেওয়া রেনউইক যজ্ঞেশ্বরের দর ১.৩১ শতাংশ এবং লোকসানের কারণে গত বছর লভ্যাংশ না দেয়া আনলিমা ইয়ার্নের দর বেড়েছে ০.৯৭ শতাংশ।

হঠাৎ লাফিয়ে এখন দরপতনের শীর্ষে

দরপতনের শীর্ষে থাকা এপেক্স ফুটওয়্যারের দর গত ৩১ জানুয়ারি ছিল ফ্লোর প্রাইস ২৫৭ টাকা ৫০ পয়সায়। হঠাৎ করে বেড়ে ১৪ ফেব্রুয়ারি দর দাঁড়ায় ৩৩০ টাকা ৬০ পয়সা, যা গত এক বছরের সর্বোচ্চ দরের কাছাকাছি। উল্টো যাত্রায় তিন কর্মদিবসে দর কমে দাঁড়িয়েছে ২৯৮ টাকা ৯০ পয়সা। এর মধ্যে রোববার কমল ৮.০৮ শতাংশ।

এক মাসেরও কম সময়ে ৪৩ টাকা থেকে ৫৩ টাকা ৮০ পয়সায় উঠে যাওয়ার পর শাইনপুকুর সিরামিকস গত ৭ কর্মদিবসের মধ্যে ছয় দিন দর হারিয়ে নেমেছে ৪৩ টাকা ৬০ পয়সায়। এর মধ্যে রোববার দর হারিয়েছে ৭.৮২ শতাংশ।

৩৫ টাকা ৯০ পয়সা বা ৭.৫৮ শতাংশ দর হারিয়ে জেমিনি সি ফুডের দর দাঁড়িয়েছে ৪৩৭ টাকা ৭৯ পয়সায়। গত সপ্তাহেই স্বল্প মূলধনি কোম্পানিটির দর ছাড়িয়ে যায় ৫০০ টাকার ঘর।

কয়েক মাস ফ্লোর প্রাইস ৬১৫ টাকা ১০ পয়সায় পড়ে থাকার পর চার কর্মদিবস লাফিয়ে ৭০০ টাকা ছাড়িয়ে যাওয়ার পর উল্টোযাত্রায় থাকা সোনালী পেপার দর হারিয়েছে ৭.৪৮ শতাংশ। দর নেমেছে ৬৩৮ টাকা ২০ পয়সায়।

এছাড়া ইন্ট্রাকো রিফুয়েলিংয়ের দর ৭.১৪ শতাংশ, মেট্রো স্পিনিংয়ের দর ৪.৯৭ শতাংশ, বিডি ল্যাম্পসের দর ৪.৮৯ শতাংশ, ওরিয়ন ইনফিউশনের দর ৪.৩২ শতাংশ, প্রগতি লাইফের দর ৪.২৪ শতাংশ এবং মনোস্পুল পেপারের দর কমেছে ৪.১৭ শতাংশ।

সূচকে প্রভাব যাদের

সূচক সবচেয়ে বেশি কমিয়েছে সোনালী পেপার। স্বল্প মূলধনী কোম্পানিটি দর হারিয়েছে ৭.৪৮ শতাংশ। এতে সূচক কমে গেছে ৩.২২ পয়েন্ট। অলিম্পিকের দর ৩.৩৭ শতাংশ কমায় সূচক কমেছে ১.৯ পয়েন্ট, ওরিয়ন ফার্মার দর ৩.৬৫ শতাংশ কমায় সূচক কমেছে ১.৩৮ পয়েন্ট।

রাষ্ট্রায়ত্ত বাংলাদেশ শিপিং করপোরেশনের দর ২.৬ শতাংশ কমায় ১.০৪ পয়েন্ট, শাইনপুকুর সিরামিকসের দর ৭.৮২ শতাংশ কমায় ১.০৩ পয়েন্ট, বসুন্ধরা পেপারের দর ৩.২৪ শতাংশ কমায় সূচক কমেছে ০.৮৬ পয়েন্ট।

এছাড়া ওয়ান ব্যায়ক ০.৭৪ পয়েন্ট, কোহিনূর কেমিক্যালস ০.৬৭ পয়েন্ট, অ্যাপেক্স ফুটওয়্যার ০.৬৫ পয়েন্ট এবং জেনেক্স ইনফোসিস ০.৬৪ পয়েন্ট সূচক কমিয়েছে।

সব মিলিয়ে এই ১০টি কোম্পানির কারণেই সূচক পড়েছে ১২ দশমিক ১৩ পয়েন্ট।

বিপরীতে একটিমাত্র কোম্পানি সূচকে এক পয়েন্টের বেশি যোগ করতে পেরেছে। সেটি হলো বিকন ফার্মা, যার দর ০.৯৩ শতাংশ বাড়ায় সূচকে যোগ হয়েছে ১.২৩ পয়েন্ট।

এছাড়া ইসলামী ব্যাংকের দর ০.৩ শতাংশ বাড়ায় ০.৩১ পয়েন্ট, মুন্নু অ্যাগ্রোর দর ৫.৬৭ শতাংশ বাড়ায় ০.৩ পয়েন্ট, প্রাইম ব্যাংকের দর ০.৫ শতাংশ বাড়ায় ০.২১ পয়েন্ট, গোল্ডেন জুবিলি মিউচ্যুয়াল ফান্ডের দর ৯.৩৩ শতাংশ বাড়ায় ০.১৩ পয়েন্ট, বার্জার পেইন্টসের দর ০.০৮ শতাংশ এবং উত্তরা ব্যাংকের দর ০.৪৩ শতাংশ বাড়ায় ০.১২ পয়েন্ট করে, এমারেল্ড অয়েলের দর ৩.৩৩ শতাংশ বাড়ায় ০.১১ পয়েন্ট এবং আমরা টেকনোলজির দর ০.৮৯ শতাংশ বাড়ায় সূচকে যোগ হয়েছে ০.০৯ পয়েন্ট।

সব মিলিয়ে এই ৯টি কোম্পানি যোগ করতে পেরেছে কেবল ২ দশমিক ৬২ পয়েন্ট।