প্রায় এক যুগ পর ফিরল দুই চিরপ্রতিদ্বন্দ্বীর ফাইনাল। জমে উঠল লড়াই। একের পর এক গোলের রোমাঞ্চ, উত্তাপে মেজাজ হারানো, ক্ষণে ক্ষণে রঙ বদলানোর টানাপোড়েন, পুরনো সেই ঝাঁজ, নখ কামড়ানো উন্মাদনা, সব মিলিয়ে সেই সোনালি সময়ই যেন ফিরল আবার। উত্তেজনার পারদ চড়ানো ম্যাচে চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী আবাহনীকে হারিয়ে ফেডারেশন কাপের শিরোপা উৎসবে মেতে উঠল মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাব।
কুমিল্লার শহীদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত স্টেডিয়ামে মঙ্গলবার টাইব্রেকারে ৪-২ গোলে জিতেছে মোহামেডান। পেন্ডুলামের মতো দুলতে থাকা নির্ধারিত ও অতিরিক্ত সময়ের ম্যাচ শেষ হয়েছিল ৪-৪ সমতায়।
বীরোচিত পারফরম্যান্সে একই চার গোল করে মোহামেডানকে লড়াইয়ে রাখা সুলেমান দিয়াবাতে টাইব্রেকারেও দলের হয়ে প্রথম গোলটি করেন নিখুঁত শটে। পরে তাদের হয়ে আলমগীর কবির রানা, রজার দুরাতে দি অলিভিয়েরা, কামরুল ইসলাম পান জালের দেখা। মিস করেন শাহরিয়ান ইমন।
আবাহনীর প্রথম শট নিতে এসে হতাশ করেন অধিনায়ক রাফায়েল আগুস্তো দি সিলভা। এই ব্রাজিলিয়ানের দুর্বল শট ঝাঁপিয়ে আটকান বদলি গোলরক্ষক আহসান হাবিব বিপু। পরে দেনিয়েল কলিনদ্রেস সোলেরাও পারেননি লক্ষ্যভেদ করতে। জালের দেখা পান কেবল এমেকা ওগবাহ ও মোহাম্মদ ইউসুফ।
মাঠের ফুটবল যেমন ছিল রোমাঞ্চ ছড়ানো, ম্যাচের আবহও ছিল তেমনই। আবাহনী-মোহামেডান দ্বৈরথ বলে কথা! প্রখর রোদ উপেক্ষা করে তাই ব্যানার, ফেস্টুন, পটকা, আতশবাজি নিয়ে গ্যালারিতে ভীড় করেন সমর্থকরা।
দুই দল সবশেষ শিরোপা লড়াইয়ে মুখোমুখি হয়েছিল সেই ২০১১ সালে, ‘কোটি টাকার’ সুপার কাপে। সেবার মোহমেডানকে হারিয়ে শিরোপা জিতেছিল আবাহনী। এবার মধুর প্রতিশোধ নিল সাদা-কালোরা।
ফেডারেশন কাপের রেকর্ড ১২ বারের চ্যাম্পিয়ন আবাহনী এবার মুকুট ধরে রাখতে পারল না। এ প্রতিযোগিতায় দশম শিরোপার স্বাদ মোহামেডান পেয়েছিল সেই ২০০৯ সালে। হারানো সেই শ্রেষ্ঠত্ব ফিরে পেল তারা। ২০১৪ সালে স্বাধীনতা কাপ জয়ের পর সব প্রতিযোগিতা মিলিয়ে এটিই তাদের প্রথম ট্রফি!
সবশেষ ২০১৯ সালে লিগ ম্যাচে আকাশি-নীলদের বিপক্ষে জিতেছিল মোহামেডান। সাম্প্রতিক সময়ে ধুঁকতে থাকা দলটির হাল মৌসুমের মাঝপথে ধরেছিলেন আলফাজ আহমেদ। সাবেক এই তারকা ফরোয়ার্ডের হাত ধরে চেনা পথে ফেরার উপলক্ষ পেয়ে গেল দলটি।
আবাহনীর ফাহিমের ঝলক
‘যেখানেই মোহামেডান, সেখানেই আমরা’-এই ব্যানার নিয়ে এসেছিলেন সাদা-কালো জার্সিধারীর সমর্থকরা। আবাহনী সমর্থকদের প্রবল উপস্থিতি ছিল প্রিয় আকাশি-নীল পতাকা নিয়ে। গ্যালারিতে দুই পক্ষের ‘লড়াই’, মাঠে খেলোয়াড়দের লড়াই যেন ফিরিয়ে দিল ঘরোয়া ফুটবলের সেই সোনালি দিনের স্মৃতি।
আবাহনীর শুরুটা করে আক্রমণাত্মক। মোহামেডান ছিল তাদের পাল্টা আক্রমণের চেনা ছকে। শুরুর পনের মিনিটে যদিও কোনো পক্ষ পরিষ্কার সুযোগ তৈরি করতে পারেনি।
আক্রমণভাগে প্রায়ই কলিনদ্রেসের ছায়া থেকে তেড়েফুঁড়ে বেরিয়ে আসতে দেখা যায় ফাহিমকে। মহাগুরুত্বপূর্ণ ফাইনালে আবারও পাদপ্রদীপের আলোয় উঠে এলেন ২১ বছর বয়সী এই তরুণ ফরোয়ার্ড। ষোড়শ মিনিটে এমেকার থ্রু পাস ধরে বাঁ পায়ের কোনোকুনি শটে জাল খুঁজে নেন ফাহিম।
এই গোলের পরই গ্যালারিতে আবাহনী সমর্থকরা পটকা ফোটাতে শুরু করে। আসরে ফাহিমের এটি তৃতীয় গোল।
কলিনদ্রেসের ছোঁয়ায় ব্যবধান দ্বিগুণ
আগের ম্যাচে চোটের কারণে খেলতে পারেননি রাফায়েল অগাস্তো। ব্রাজিলিয়ান এই মিডফিল্ডার ফিরলেন মোহামেডানের বিপক্ষে ফাইনালে। যথারীতি মাঝমাঠের নিয়ন্ত্রণ মুঠোয় নিয়ে একের এর এক আক্রমণের সুর বেঁধে দিতে থাকেন তিনি। রাফায়েলকে আটকানোর উপায় পাচ্ছিল না মোহামেডান।
২৯তম মিনিটে সতীর্থের পা ঘুরে বল পেয়ে যান ফাহিম। এবার তার জোরাল শট আটকান গোলরক্ষক সুজন হোসেন। ৩৭তম মিনিটে কলিনদ্রেসের আড়াআড়ি ক্রসে মাথা ছোঁয়াতে পারেননি কেউ।
৪৩তম মিনিটে দ্বিগুণ হয় ব্যবধান। হৃদয়ের লং পাস নিয়ন্ত্রণ নেওয়া কলিনদ্রেসকে আটকাতে পারেননি মোহমেডানের ডিফেন্ডার হাসান মুরাদ। ডান পায়ের দারুণ শটে সুজনকে পরাস্ত করেন কোস্টা রিকার ফরোয়ার্ড।
যোগ করা সময়ে কলিনদ্রেসের ফ্রি কিক আঙুলের টোকায় ক্রসবারের উপর দিয়ে বের করে দেন গোলরক্ষক। ম্যাচের নিয়ন্ত্রণ মুঠোয় নিয়ে বিরতিতে যায় প্রতিযোগিতার রেকর্ড চ্যাম্পিয়নরা।
দ্বিতীয়ার্ধে জাদুকরী দিয়াবাতে
দেয়ালে পিঠ ঠেকে যাওয়া মোহামেডান দ্বিতীয়ার্ধে জেগে ওঠে আড়মোড়া ভেঙে। প্রথম অর্ধে ছায়া হয়ে থাকা আক্রমণভাগের মূল সেনানী সুলেমানে দিয়াবাতে ফেরেন চেনা বিধ্বংসী রূপে। মোহামেডানও চার মিনিটের মধ্যে দুই গোলে জমিয়ে তোলে ঐতিহ্যবাহী ডার্বি।
৫৬তম মিনিটে মাঝমাঠ থেকে কামরুলের লং পাসে উড়ে আসা বল আলমগীর ক্লিয়ার করতে পারেননি। বরং তার হেডে বল চলে যায় দিয়াবাতের পায়ে। চোখের পলকে দারুণ ভলিতে ব্যবধান কমান মোহামেডান অধিনায়ক।
৬০তম মিনিটে দিয়াবাতের হেডেই সমতা ফেরে ম্যাচে। মুজাফ্ফর মুজাফ্ফরভের জোরাল দূরপাল্লার শট শহীদুল আলম সোহেল আটকানোর পর বল পেয়ে যান বাঁ দিকে থাকা জাফর ইকবাল। তার আড়াআড়ি ক্রসে হেডে লক্ষ্যভেদ করেন দিয়াবাতে।
এমেকার গোলে আবার এগিয়ে যায় আবাহনী
দ্বিতীয়ার্ধে জমে ওঠা ম্যাচে রঙ বদলাতে থাকে ক্ষণে ক্ষণে। পোস্টের বাঁধায় গোল বঞ্চিত হওয়ার একটু পরই এমেকা ওগবাহর অপেক্ষা ফুরোয়। ৬৬তম মিনিটে রহমতের ক্রসে হেডে লক্ষ্যভেদ করেন এই নাইজেরিয়ান ফরোয়ার্ড। ফের এগিয়ে যায় আবাহনী।
দিয়াবাতের হ্যাটট্রিক পূরণ
পুনরায় জেঁকে বসা শঙ্কার মেঘ ৮৩তম মিনিটে আবারও সরিয়ে দেন অধিনায়ক দিয়াবাতে। কামরুলের কর্নারে তার হেড দূরের পোস্ট দিয়ে লুটোপুটি খায় জালে। গোলরক্ষক শহীদুলের কিছুই করার ছিল না।
দ্বিতীয়ার্ধের যোগ করা সময়ে রাফায়েলের শট বদলি রাজীবের পায়ে লেগে ক্রসবারের উপর দিয়ে বেরিয়ে যায়। ম্যাচ গড়ায় অতিরিক্ত সময়ে।
পেনাল্টিতে দিয়াবাতের গোল
অতিরিক্ত সময়ের শুরুতেই রাফায়েলের শট কর্নারের বিনিময়ে আটকান সুজন। এরপর কর্নারে বাবলুর হেড ফিরিয়ে মোহামেডানের ত্রাতা এই গোলরক্ষক।
১০৫তম মিনিটে বক্সের ভেতর ওয়ান-অন-ওয়ান পজিশনে দিয়াবাতে কাটিয়ে যান শহিদুলকে। তখন আর ফাউল করা ছাড়া আর কোনো উপায় ছিল না আবাহনীর গোলরক্ষকের। রেফারি বাজান পেনাল্টির বাঁশি।
স্পট কিকের আগে দিয়াবাতের সঙ্গে মনস্তাত্ত্বিক লড়াই শুরু করলেন শহীদুল, কিন্তু তাতেও লাভ হয়নি। সোজাসুজি শটে বল জালে জড়ান তিনি। চলতি আসরে ফাইনালের আগে তার গোল ছিল চারটি। ফাইনালে করলেন চারটি।
চোটে মাঠ ছাড়লেন সুজন
১১১তম মিনিটে বক্সের অনেক বাইরে থেকে রয়েলের ভলি লাফিয়ে ক্লিয়ার করতে গিয়ে ব্যাথা পান সুজন। কাঁদতে কাঁদতে মাঠ ছাড়েন ম্যাচ জুড়ে মোহামেডানকে দারুণ বিশ্বস্ততায় আগলে রাখা এই গোলরক্ষক। বদলি নামেন আহসান হাবিব বিপু।
রহমতের গোলে সমতা
মাথায় ব্যথা পেলেও মাঠ ছাড়েননি রহমত মিয়া। ব্যান্ডেজ নিয়ে খেলা চালিয়ে যান এই ডিফেন্ডার। ১১৭তম মিনিটে নিবেদনের প্রতিদানও পেয়ে যান তিনি। দুর্দান্ত শটে বিপুকে পরাস্ত করেন। প্রাণ ফিরে পায় আবাহনীর শিরোপা স্বপ্নও। শেষ পর্যন্ত ম্যাচের ভাগ্য গড়ায় শ্বাসরুদ্ধকর টাইব্রেকারে। সেখানেই বাজিমাত করে মোহামেডান।
দিয়াবাতের জয়জয়কার
কেবল শিরোপা নয়, ব্যক্তিগতভাবেও মুঠোভরে পেলেন দিয়াবাতে। ফাইনালের সেরা খেলোয়াড় হন মোহামেডান অধিনায়ক। সর্বোচ্চ গোলদাতার (৮টি) পুরস্কারও ওঠে তার হাতেই। প্রতিযোগিতার সেরা খেলোয়াড়ও তিনিই।