টেবিল টেনিসে সম্ভাবনা আছে অনেক, সাম্প্রতিক সময়ে এসেছে বেশ কিছু সাফল্যও, কিন্তু কঠিন বাস্তবতার জালে রুদ্ধ খেলোয়াড়দের সামনে এগোনোর পথ।
Published : 15 Aug 2023, 10:10 AM
সাম্প্রতিক সময়ে সাউথ এশিয়ান জুনিয়র অ্যান্ড ক্যাডেট টেবিল টেনিস চ্যাম্পিয়নশিপে দারুণ সাফল্য পেয়েছে বাংলাদেশ। গত মে মাসে ভারতের অরুণাচলে এই প্রতিযোগিতা থেকে মিলেছে দুই রুপা ও সাত ব্রোঞ্জ মিলিয়ে ৯টি পদক। মালদ্বীপের গত আসরে এসেছিল একটি সোনা ও পাঁচটি ব্রোঞ্জ। এই প্রাপ্তির রেশ মেখে আরও সামনে ছুটতে চান উঠতি খেলোয়াড়রা। কিন্তু বড় সংশয় ও প্রশ্ন তাদের সঙ্গী-জ্বালানির জোগান দিতে পারবে তো ফেডারেশন!
কদিন আগে চট্টগ্রামে শেষ হয়েছে জাতীয় টেবিল টেনিস চ্যাম্পিয়নশিপ। মেয়েদের এককে সেরা হয়েছেন সাদিয়া রহমান মৌ। ছেলেদের প্রতিযোগিতায় বালক ও সিনিয়র এককে একইসঙ্গে সেরা হয়ে অনন্য কীর্তি গড়েছেন রামহিম লিয়ান বম। এই দুই উঠতি খেলোয়াড়ের পাশাপাশি ফেডারেশনের কর্তা, কোচের কথা শুনেছে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম। প্রথম দুই পর্বে ছিল মৌ ও রামহিমের গল্প। শেষ পর্বে থাকছে খেলোয়াড়দের দাবি-দাওয়া পূরণে ফেডারেশনের কর্তা ও কোচদের উদ্যোগ, সীমাবদ্ধতার দিকগুলো।
সাম্প্রতিক সাফল্য
২০২১ সালে কাতারের দোহায় এশিয়ান টেবিল টেনিস চ্যাম্পিয়নশিপে অংশ নেয় বাংলাদেশ। এশিয়ান টেবিল টেনিসের ‘বিশ্বকাপ’ বলে পরিচিত এই প্রতিযোগিতায় ৪৩ দেশের মধ্যে বাংলাদেশ হয় ২০তম। সেই সুবাদে সুযোগ মেলে ২০২২ বার্মিংহাম কমনওয়েলথ গেমসে সরাসরি খেলার। বার্মিংহামে ছেলেদের দলগত বিভাগে প্রথমবারের মতো কোয়ার্টার-ফাইনালের মঞ্চে ওঠে। সেখানে স্বাগতিক ইংল্যান্ডের কাছে হেরে থেমে যায় পথচলা।
ওই বছর তুরস্কের কোনিয়াতে ইসলামিক সলিডিটি গেমসে ছেলেদের দলগত বিভাগে কোয়ার্টার-ফাইনালে ওঠে বাংলাদেশ। মেয়েদের এককে জিবুতি ও পাকিস্তানের প্রতিযোগীকে হারিয়ে সেরা আটে জায়গা করে নেন মৌ।
গত বছর মালদ্বীপের মালেতে সাউথ এশিয়ান জুনিয়র ও ক্যাডেট চ্যাম্পিয়নশিপের অনূর্ধ্ব-১৯ জুনিয়র দলগত বিভাগে সোনা জয় করে বাংলাদেশ। টেবিল টেনিসে এটিই প্রথম আন্তর্জাতিক পর্যায়ে সোনা জয়ের কীর্তি। এ বছর এই আসরে অরুণাচলে সোনার পদক খোয়ালেও মোট পদকসংখ্যা ৬ থেকে বেড়ে হয়েছে ৯টি।
যদিও দক্ষিণ এশিয়ান গেমসের (এসএ গেমস) আঙিনায় বাংলাদেশের অর্জন বড্ড মলিন। এ পর্যন্ত ১০টি পদক এসেছে, সবগুলোই ব্রোঞ্জ। ২০১৯ সালে নেপালের কাঠমান্ডু-পোখারার আসরে ব্যর্থতার বৃত্ত থেকে বেরিয়ে আসার প্রবল আকাঙ্ক্ষা ছিল। কিন্তু প্রত্যাশার সাথে পারফরম্যান্সের মেলাতে না পারায় অধরা থেকে গেছে রুপা-সোনার হাসি।
খেলোয়াড়দের উপলব্ধি, ‘পারতেই হবে’
জাতীয় চ্যাম্পিয়নশিপের দুই সেরা মৌ এবং রামহিম দুজনেই একমত, তাদেরকে সাফল্যের পথ ধরেই ছুটতে হবে। পৃষ্ঠপোষকের অভাব, খেলোয়াড়দের আর্থিক নিরাপত্তাহীনতা-এমন সব সীমাবদ্ধতা মেনে নিয়েই এগোতে হবে। মৌ যেমন নিজে থেকেই টেনে আনলেন আর্চারির প্রসঙ্গ।
“ক্রিকেট, ফুটবল জনপ্রিয় খেলা হয়ে উঠেছে, এগুলো মানুষের কাছে প্রাধান্য পাচ্ছে। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান, স্পন্সররা তাদেরকে গুরুত্ব দিচ্ছে। আমাদের খেলাগুলো হয়ে গেছে ইনডোর এবং গড়পড়তা খেলার মতো। ওই পর্যায়ে যেতে আমাদের অনেক প্রচেষ্টা লাগবে। যখন আমরা ভালো ফল করব, তখন হয়তো স্পন্সররা আসবে।”
“যেমন ধরুন আর্চারি, কদিন আগেও ওদেরকে কজন ওভাবে জানত! কিন্তু ওরা ভালো ফল করার পর ওরা পৃষ্ঠপোষক পেয়েছে ও পরিচিতি পেয়েছে। ওই পর্যায়ে অর্জন করেছে বলেই পৃষ্ঠপোষকতা পেয়েছে।”
টেবিল টেনিসে তারা যে ধরণের সমর্থন পাচ্ছেন, সেটির দুটি দিকও তুলে ধরলেন মৌ।
“সার্ভিসেস দলগুলো আমাদের যতটা সমর্থন দিচ্ছে, এটা এক দিক থেকে অনেক কিছু, অন্য দিক থেকে বেশি কিছু নয়। সব মিলিয়ে টেবিল টেনিস পেশা হিসেবে নেওয়ার মতো খেলা হয়ে ওঠেনি। কেউ কেউ হয়ত পড়াশোনা ছেড়ে দিয়ে খেলা নিয়ে ছিল, কিন্তু এখন তাদেরকে অন্যদের খেলা শিখিয়ে জীবিকা নির্বাহ করতে হচ্ছে।”
তবু ক্যাম্পে চলছে স্বপ্নের চাষ
টেবিল টেনিসকে পেশা হিসেবে নেওয়ার বাস্তবতা নেই, তবে স্বপ্ন দেখাও থেমে নেই। পল্টনের শহীদ তাজউদ্দিন আহমেদ ইনডোর স্টেডিয়ামে প্রায় দুই বছর ধরে চলছে আবাসিক ক্যাম্প। সবসময় গড়ে ২৮ থেকে ৩০ জন খেলোয়াড়ের থাকেন এই ক্যাম্পে। তাদের খাবার, প্রস্তুতির রুটিন, চোট পেলে চিকিৎসার ব্যবস্থা, সবকিছুর বিস্তারিত জানালেন কোচ মোহাম্মদ আলি।
“ভোরের প্রার্থনার পর চা-নাস্তা সেরে কিছুক্ষণ বিশ্রাম। আধ ঘণ্টা পর টেবিলে নামে ওরা; প্রস্তুতি শুরু হয়। সকালে ৩ ঘণ্টা, বিকালে ৩ ঘণ্টা। ক্যাম্পে পাঁচ বেলা খাওয়া দেওয়া হয়। সকালে ডিম, পরোটা, সবজি। অনুশীলনের মাঝে একটা স্যালাইন, একটা কলা, একটা ডিম। দুপুরে চারটা আইটেম-ভাত, সবজি, ডাল-ভর্তা, মাছ বা মাংস। বিকালে দুধ-পাউরুটি, কলা, কখনও স্যুপ জাতীয় কিছু থাকে। ছোলা, বাদাম, খেজুরও থাকে। রাতেও চার পদের খাবার। লেবু ও আদা খাওয়ানো হয় নিয়মিত। একটি হাসপাতালের সাথে চুক্তি আছে। যে কেউ চোট পেলে, অসুস্থ হওয়া মাত্রই তারা দেখে দেবে। মানসিক শক্তি বৃদ্ধির জন্য মেডিটেশনও করানো হয় ক্যাম্পে।”
লেখাপড়ার জন্য রাখা আছে শিক্ষক। রামহিম, খৈ খৈ, ঐশি, লতা, সিগমা, রেশমি, ইমনরা খেলার পাশাপাশি পড়াশোনাও চালিয়ে যাচ্ছেন। এবারের জাতীয় চ্যাম্পিয়নশিপে রামহিম ও মৌ-এই দুই তরুণের সাফল্য, খৈ খৈ-সিগমাদের উঠে আসা ফেডারেশনের কর্তাদের আশাবাদী করে তুলছে আরও।
‘নেই আর নেই’ যেখানে বাস্তবতা
খেলোয়াড়রা স্বপ্নের আকাশে ডানা মেললেও কঠিন বাস্তবতার জমিনে আছড়ে পড়ার শঙ্কাও কম নেই। ক্রীড়াঙ্গনের জন্য গত বছরের বরাদ্দকৃত বাজেট থেকে টেবিল টেনিস ফেডারেশন পেয়েছিল ১২ লাখ টাকা। স্টাফদের বেতন দিতেই এই অর্থ ‘চলে যায়’ বলে জানালেন সহ-সভাপতি খোন্দকার হাসান মুনীর। নির্ভর করার মতো পৃষ্ঠপোষক আজও জোগাড় করতে পারেনি ফেডারেশন। সংস্থাটির চেয়ারে কর্তা-ব্যক্তিদের অদল-বদল হয়, কিন্তু কোষাগারের জীর্ণদশা বদলায় না।
ঘরোয়া প্রতিযোগিতাগুলোর আয়োজন, ক্যাম্প, সবকিছুই জোড়াতালি দিয়ে চলছে বলে জানালেন মুনীর।
“এই ক্যাম্পের জন্য আমরা অনেক দৌড়েছিলাম, কিন্তু পৃষ্ঠপোষকদের তেমন সাড়া পেলাম না। পরে যুব ও ক্রীড়া প্রতিমন্ত্রী মহোদয়ের কাছে গেলাম…যখন দুই-তিন মাস ক্যাম্প চালানোর পর দ্বারে দ্বারে ঘুরছিলাম, কাউকেই কাছে পাইনি। তখন যুব ও ক্রীড়া প্রতিমন্ত্রী (জাহিদ আহসান রাসেল) মজা করেই বললেন, ‘ক্যাম্প চালানোর ব্যবস্থা আমি করছি, কিন্তু আপনি লিখে দেন রেজাল্ট আসবে।’ একদিন লিখেই দিলাম, ‘আগের চেয়ে ভালো পারফরম্যান্স করব।’ তিনি সহযোগিতা করলেন; এরপর সাউথ এশিয়ান জুনিয়র অ্যান্ড ক্যাডেট চ্যাম্পিয়নশিপে ভালো ফল করলাম আমরা “
“পুলিশে শোয়েব রিয়াজ আলম নামে আমাদের বন্ধু-ব্যাচমেট আছে, ও ব্যক্তিগত উদ্যোগে প্রথম ফাণ্ড এনে দিয়েছিল ক্যাম্প শুরুর সময়, ৬ লাখ টাকার মতো ব্যবস্থা করে দিয়েছিল। এরপর বাংলাদেশ আনসারও কমনওয়েলথ গেমসের আগে সহযোগিতা করল। বাংলাদেশ সেনাবাহিনীও সহযোগিতা করেছে ক্যাম্প চালিয়ে নিতে।”
ক্যাম্প চলছে বটে, কিন্তু নেই আন্তর্জাতিক মানের কোচ। খেলোয়াড়রা নিয়মিত পান না অনুশীলন সঙ্গী, টেবিল টেনিসে যেটি ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ। বছর জুড়ে ভারত থেকে অর্পন, সোমদ্বীপ, অভিষেক, অয়ন, হৈমন্তীকে ঘুরে ফিরে ‘প্র্যাকটিস পার্টনার’ হিসেবে আনা হয়, কিন্তু নিয়মিত তাদেরকে আনা সম্ভব হয় না আর্থিক অস্বচ্ছলতায়।
বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড, সেনাবাহিনী থেকে সহযোগিতা পাওয়া গেলেও তা চাহিদার তুলনায় পর্যাপ্ত নয় বলে জানালেন মুনীর। এ প্রসঙ্গে টানলেন তিনি প্রতিবেশী ভারতের উদাহরণও।
“ভারতের শীর্ষ পর্যায়ের এক বা দুই জন খেলোয়াড় যা খরচ করে, সেখানে আমাদের ফেডারেশন সারা বছরও সেই পরিমাণ অর্থ খরচ করে না। ওদের একটা প্রদেশের খেলোয়াড়ও জানে, সে শীর্ষ আট বা দশে থাকলে তার চাকরি নিশ্চিত। এই নিশ্চয়তাটুকু আমাদের ভীষণ দরকার।”
“এক দল কোচিং স্টাফ–দুজন ভালো আন্তর্জাতিক মানের কোচ, কমপক্ষে চার জন প্র্যাকটিস পার্টনার, এরসঙ্গে ২০২৬ সালের কমনওয়েলথ গেমস পর্যন্ত একটা দিনও যেন এগুলো নিয়ে চিন্তা না করতে হয়, এগুলো দরকার। আমাদের নতুন সভাপতি মেজবাহ উদ্দিন সাহেব চেষ্টা করছেন। ক্রিকেট বোর্ডের পাপন ভাইয়ের কাছে ( বিসিবি সভাপতি নাজমুল হাসান) একজন কোচের এক বছরের বেতন ৫ হাজার ডলার আর সেনাবাহিনী প্রধানের কাছ থেকে ছয় মাসের জন্য একজন প্র্যাকটিস পার্টনারের ৩ হাজার ডলার পেয়েছিলাম। তাতে কমনওয়েলথে ভালো করেছিলাম। আমি চাই এগুলো ২০২৬ সাল পর্যন্ত যেন পাওয়া যায়।”
যে দুই স্লোগান নিয়ে চলছে ক্যাম্প, তা পূরণ হয় এগুলো পেলেই। ক্যাম্পের দুই স্লোগানও বেশ চমক জাগানিয়া। প্রথমটি, ‘হারলে হারো, দুই দিকে মারো’, দ্বিতীয়টি ভারতকে ‘লক্ষ্য’ বানিয়ে কেজিএফ সিনেমার সংলাপ-‘ঘারমে ঘুচঁকে মারো।’