১৯৫৪ বিশ্বকাপ: মিরাকল অব বার্ন

অমিত শক্তির হাঙ্গেরির হৃদয় ভেঙে শিরোপা জিতল পশ্চিম জার্মানি।

ইকবাল শাহরিয়ারবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 10 Nov 2022, 05:35 AM
Updated : 10 Nov 2022, 05:35 AM

বিশ্বকাপ ফুটবল ততদিনে হয়ে উঠেছে উৎসব। কিন্তু সেসময় খেলা দেখা যেত শুধু স্টেডিয়ামে গেলে। প্রথমবারের মত টেলিভিশনে খেলা সম্প্রচার করে গোটা বিশ্বকে এই আনন্দ উপভোগের ব্যবস্থা করে দেয় ১৯৫৪ সালে অনুষ্ঠিত বিশ্বকাপের সুইজারল্যান্ড আসর। এই আনন্দ উৎসব চলে ১৬ জুন থেকে ৪ জুলাই। বলা যায়, এই বিশ্বকাপ একই সুতায় বেঁধেছিল গোটা বিশ্বকে।

পঞ্চম বিশ্বকাপের মূলপর্বে অংশগ্রহণ করে ১৬ দেশ। স্বাগতিক সুইজারল্যান্ড ও শিরোপাধারী উরুগুয়ে জায়গা পায় সরাসরি। বাছাইপর্ব পেরিয়ে আসে বাকি ১৪ দেশ।

ইউরোপ থেকে অংশ নেয় ১২ দেশ- সুইজারল্যান্ড, অস্ট্রিয়া, বেলজিয়াম, ইংল্যান্ড, স্কটল্যান্ড, তুরস্ক, যুগোস্লাভিয়া,  ইতালি, হাঙ্গেরি, পশ্চিম জার্মানি, ফ্রান্স, চেকোস্লোভাকিয়া। লাতিন আমেরিকা থেকে মূল পর্বে আসে দুটি দেশ- ব্রাজিল ও উরুগুয়ে। তাদের সঙ্গী হয় উত্তর আমেরিকার মেক্সিকো ও এশিয়ার দক্ষিণ কোরিয়া। এই আসর দিয়ে বিশ্বকাপের মঞ্চে অভিষেক ঘটে স্কটল্যান্ড, তুরস্ক ও দক্ষিণ কোরিয়ার।

গ্রুপ পর্ব 

১৬ দেশকে চার গ্রুপে ভাগ করে শুরু হয় টুর্নামেন্ট। প্রতিটি গ্রুপে ছিল চারটি করে দেশ। বিস্ময়করভাবে গ্রুপের সব দল সব দলের বিপক্ষে খেলেনি। প্রত্যেক গ্রুপে ছিল দুটি বাছাই ও দুটি অবাছাই দল। বাছাই দেশগুলো খেলে অবাছাই দেশগুলোর সঙ্গে! ফলে প্রতিটি দেশের খেলা হয় দুটি করে। সেখান থেকে প্রতি গ্রুপের শীর্ষ দুটি দেশ পৌঁছায় কোয়ার্টার-ফাইনালে।  

গ্রুপ-১ (বাছাই দুই দল) ব্রাজিল, ফ্রান্স (অবাছাই দুই দল) যুগোস্লাভিয়া, মেক্সিকো

গ্রুপ-২ (বাছাই দুই দল) হাঙ্গেরি, তুরস্ক (অবাছাই দুই দল) পশ্চিম জার্মানি, দক্ষিণ কোরিয়া

গ্রুপ-৩ (বাছাই দুই দল) উরুগুয়ে, অস্ট্রিয়া (অবাছাই দুই দল) চেকোস্লোভাকিয়া, স্কটল্যান্ড

গ্রুপ-৪ (বাছাই দুই দল) ইংল্যান্ড, ইতালি (অবাছাই দুই দল) সুইজারল্যান্ড, বেলজিয়াম

গ্রুপ-১ থেকে ব্রাজিল ও যুগোস্লোভিয়ার পয়েন্ট ছিল ৩ করে। গোল পার্থক্যে এগিয়ে থেকে গ্রুপ সেরা হয় ব্রাজিল, রানার্সআপ যুগোস্লোভিয়া। এক জয়ে ২ পয়েন্ট পেয়ে তৃতীয় হয় ফ্রান্স। সব ম্যাচ হেরে তলানিতে ছিল মেক্সিকো।        

গ্রুপ-২ থেকে দুই জয়ে ৪ পয়েন্ট নিয়ে গ্রুপ চ্যাম্পিয়ন হয়ে শেষ আটে যায় টুর্নামেন্টের হট ফেভারিট হাঙ্গেরি। একটি করে জয় পাওয়া পশ্চিম জার্মানি ও তুরস্কের মধ্যে হয় প্লে-অফ ম্যাচ। সেখানে ৭-২ গোলে জিতে কোয়ার্টার-ফাইনালে জায়গা করে নেয় পশ্চিম জার্মানি। তৃতীয় হয় তুরস্ক। দুই ম্যাচেই হেরে শূন্য হাতে ফেরে দক্ষিণ কোরিয়া। 

এই গ্রুপের ৫ ম্যাচ মোট ৪ টি হ্যাট্রিক হয়! হাঙ্গেরির কিংবদন্তি স্ট্রাইকার সান্দর ককসিচ নিজেদের প্রথম ম্যাচে দক্ষিণ কোরিয়ার বিপক্ষে হ্যাটট্রিক করেন। পশ্চিম জার্মানির বিপক্ষে পরের ম্যাচে তিনি করেন চার গোল। দক্ষিণ কোরিয়ার বিপক্ষে হ্যাটট্রিক করেন তুরস্কর বুরহান সারগুন। রিপ্লে ম্যাচে তুরস্কের বিপক্ষে তিন গোল করেন পশ্চিম জার্মানির মাক্সিমিলিয়ান মরলক।

গ্রুপ-৩ থেকে দুটি  করে জয় পায় উরুগুয়ে ও অস্ট্রিয়া। গোল পার্থক্যে শীর্ষ স্থান পায় গত আসরের চ্যাম্পিয়ন উরুগুয়ে, অস্ট্রিয়া হয় রানার্সআপ। এই দুই দলের বিপক্ষেই হারে চেকোস্লোভাকিয়া ও স্কটল্যান্ড। এই গ্রপে স্কটল্যান্ডের বিপক্ষে হ্যাটট্রিক করেন উরুগুয়ের কার্লোস বোর্গেস এবং চেকোস্লোভাকিয়ার বিপক্ষে হ্যাটট্রিক করেন অস্ট্রিয়ার প্রবস্ট। 

গ্রুপ-৪ থেকে একটি করে জয় ও ড্রয়ে ৩ পয়েন্ট শেষ চারে যায় ইংল্যান্ড। একটি করে জয়ে পরের জায়গাটির জন্য লড়াই করে ইতালি ও সুইজারল্যান্ড। প্লে-অফ ম্যাচে দুইবারের বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন ইতালিকে ৪-১ গোলে হারিয়ে ইংল্যান্ডের সঙ্গী হয় সুইজারল্যান্ড। তলানির দল বেলজিয়ামের প্রাপ্তি ড্র থেকে ১ পয়েন্ট। 

কোয়ার্টার ফাইনাল 

২৬ জুন দুটি কোয়ার্টার-ফাইনালে মুখোমুখি হয় অস্ট্রিয়া-সুইজারল্যান্ড এবং উরুগুয়ে-ইংল্যান্ড। সুইজারল্যান্ডকে ৭-৫ গোলে হারায় অস্ট্রিয়া। এই ম্যাচে অস্ট্রিয়ার হয়ে থিওডার ওয়াগনার ও সুইজারল্যান্ডের হয়ে জোসেফ হুগি হ্যাটট্রিক করেন। অন্য ম্যাচে ইংল্যান্ডকে ৪-২ গোলে হারায় উরুগুয়ে।

২৭ জুন যুগোস্লোভিয়াকে ২-০ গোলে হারায় পশ্চিম জার্মানি। ব্রাজিলকে ৪-২ গোলে হারিয়ে শেষ চারে পৌঁছায় হাঙ্গেরি।

সেমি-ফাইনাল

৩০ জুন বাসেলে অস্ট্রিয়াকে ৬-১ গোলে উড়িয়ে দিয়ে ফাইনালে যায় পশ্চিম জার্মানি। দলের জয়ে গোল করেন ফ্রিৎজ ওয়াল্টার এবং অটমার ওয়াল্টার।

লুসানে অন্য সেমি-ফাইনালে হাঙ্গেরি-উরুগুয়ের ম্যাচ নির্ধারিত সময়ে ২-২ সমতায় শেষ হয়। অতিরিক্ত সময়ে ককসিচের জোড়া গোলে হাঙ্গেরি (৪-২) ম্যাচ জিতে ফাইনালে যায়।

৩ জুলাই তৃতীয় স্থান নির্ধারণী ম্যাচে (৩-১) গোলে উরুগুয়েকে হারিয়ে তৃতীয় হয় অস্ট্রিয়া।

ফাইনাল 

৪ জুলাই, ১৯৫৪। মহারণের জন্য প্রস্তুত বার্নের ওয়াঙ্কদর্ফ স্টেডিয়াম। উপস্থিত প্রায় ৬৩ হাজার দর্শক।

ম্যাচের প্রথম ৮ মিনিটেই জিবর ও পুসকাসের গোলে ২-০ ব্যবধানে এগিয়ে যায় হাঙ্গেরি। গ্রুপ পর্বে প্রথম দেখায় পশ্চিম জার্মানির জালে ৮ গোল দিয়েছিল দলটি। মনে হচ্ছিল আরেকটি গোল উৎসব করতে যাচ্ছে অমিত শক্তির হাঙ্গেরি।

সকলকে চমকে দিয়ে এরপরেই ঘুরে দাঁড়ায় পশ্চিম জার্মানি। মরলকের জোড়া গোলে ৩-২ ব্যবধানে হাঙ্গেরিকে হারিয়ে শেষ পর্যন্ত শিরোপাও জিতে নেয় দলটি। তারকা খচিত হাঙ্গেরির বিপক্ষে তাদের জয় এতই চমকপ্রদ যে, এই ফাইনাল ‘মিরাকল অফ বার্ন’ নামে বিখ্যাত হয়ে আছে।

পঞ্চম আসর ছিল রেকর্ডের বিশ্বকাপ। ২৬ ম্যাচে গোল হয় ১৪০টি! ম্যাচ প্রতি গোল সংখ্যা ৫.৩৮। এখন পর্যন্ত এটিই যেকোনো বিশ্বকাপে সর্বোচ্চ গোল গড়। আট হ্যাটট্রিক এখনও এক আসরে সর্বোচ্চ হ্যাটট্রিকের রেকর্ড।

পঞ্চম বিশ্বকাপ 

·        স্বাগতিকঃ সুইজারল্যান্ড

·        চ্যাম্পিয়নঃ পশ্চিম জার্মানি

·        রানার্সআপঃ হাঙ্গেরি

·        মোট ম্যাচঃ ২৬

·        মোট গোলঃ ১৪০

·        গোল গড়ঃ ৫.৩৮

·        সর্বোচ্চ গোলদাতাঃ সান্দর ককসিচ (হাঙ্গেরি)-১১ গোল

·        সেরা খেলোয়াড়ঃ ফেরেঙ্ক পুসকাস (হাঙ্গেরি) [আন অফিসিয়াল]