পেলে-মারাদোনা-জিদান ও আসর মাতানো অন্য যারা

বিশ্বকাপ ফুটবলে বিভিন্ন আসর আলোকিত হয়েছে যাদের অসাধারণ পারফরম্যান্সের আলোয়।

আরিফুল ইসলাম রনিআরিফুল ইসলাম রনিবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 18 Nov 2022, 06:34 AM
Updated : 18 Nov 2022, 06:34 AM

যুগে যুগে কত তারার আলোয় আলোকিত হয়েছে বিশ্বকাপের আকাশ! তাদের মধ্যেও কোনো কোনো আসরে কেউ কেউ হয়ে উঠেছেন ধ্রুবতারা। সেই সংখ্যাটিও নেহায়েত কম নয়। তাদের মধ্য থেকেই বাছাই করা হলো মুগ্ধতা জাগানিয়া ১০ সেরাকে।  

সান্দর কচিশ – ১৯৫৪ 

ওই বিশ্বকাপের হাঙ্গেরি দল ছিল ফুটবল ইতিহাসের সেরা দলগুলির একটি। দলের সবচেয়ে বড় তারকা ছিলেন ফেরেঙ্ক পুসকাস। ওই সময়ের বিশ্বের সেরা ফুটবলার মনে করা হতো তাকে। তবে বিশ্বকাপে সবাইকে ছাড়িয়ে যান সান্দর কচিশ। 

শূন্যে থাকা বলে অবিশ্বাস্য দক্ষতার জন্য তাকে বলা হতো ‘দা গোল্ডেন হেড।’ ওই বিশ্বকাপে হয়ে ওঠেন তিনি ‘গোল্ডেন বয়।’ 

পুসকাস-কচিশদের সঙ্গে আরও একগাদা দুর্দান্ত ফুটবলার নিয়ে গড়া দলটিতে বলা হতো ‘ম্যাজিকাল ম্যাগিয়ার্স।’ সময়ের চেয়ে অনেক এগিয়ে থাকা ফুটবল খেলে বিশ্বকাপের আগে থেকেই দুনিয়া মাত করে দলটি। টানা প্রায় ৪ বছর অপরাজিত থেকে বিশ্বকাপে আসে ফেভারিট হিসেবে। বিশ্ব আসরেও শুরু থেকে উড়িয়ে দিতে থাকে সব প্রতিপক্ষকে। সেখানে অগ্রণী কচিশ। 

দক্ষিণ কোরিয়াকে ৯-০ গোলে উড়িয়ে দেওয়ার ম্যাচে কচিশ করেন হ্যাটট্রিক। পশ্চিম জার্মানিতে ৮-৩ গোলে বিধ্বস্ত করার ম্যাচে আরও এক ধাপ এগিয়ে তিনি করেন চার গোল! 

ব্রাজিলের বিপক্ষে কোয়ার্টার-ফাইনালে গোল একটু কমে আসে। দল করে চার গোল, কচিশ দুটি। সেমি-ফাইনালে বেশ পরীক্ষায় পড়তে হয় তাদের। দুই গোলে এগিয়ে যাওয়ার পর উরুগুয়ে শোধ করে দেয় দুটিই। তবে অতিরিক্ত সময়ে দুই গোলে কচিশ আবার দলের নায়ক।

ফাইনালে হাঙ্গেরির জয়টাকে মনে করা হচ্ছিল স্রেফ সময়ের ব্যাপার। কিন্তু বিশ্বকাপ ইতিহাসের সবচেয়ে বড় অঘটনগুলির একটির জন্ম হয় সেদিন। পশ্চিম জার্মানির কাছে ৩-২ গোলে হেরে স্বপ্নভঙ্গ হয় হাঙ্গেরির। ফাইনালে গোল করতে পারেননি কচিশ। 

তার পরও ১১ গোল নিয়ে শেষ করেন টুর্নামেন্ট, তখনও পর্যন্ত এক আসরে সবচেয়ে বেশি গোলের রেকর্ড। 

পেলে – ১৯৫৮ 

এই বিশ্বকাপ থেকেই প্রতিটি ম্যাচ সরাসরি টিভি সম্প্রচার শুরু হয়। নিজেকে জানান দেওয়ার এর চেয়ে আদর্শ সুযোগ আর কী হতে পারে! এদসন আরান্তেস দো নাসিমেন্তো নামের ১৭ বছর বয়সী এক ব্রাজিলিয়ান তার অবিশ্বাস্য প্রতিভার ঝলক দেখানোর জন্য বেছে নেন এই মঞ্চ। লোকে যাকে ‘পেলে’ নামে চিনতে শুরু করে এক নামে। 

টুর্নামেন্ট শুরুর আগে থেকেই কিছুটা আলোচনা ছিল তাকে নিয়ে। সেই প্রত্যাশা পূরণ নয় শুধু, পেলে যান ছাপিয়ে। মহাতারকা হয়ে ওঠার পথে, সর্বকালের সেরাদের একজন হয়ে ওঠার পথে, বিংশ শতাব্দীর সবচেয়ে পরিচিত অ্যাথলেট হয়ে ওঠার পথে তার যাত্রা শুরু এই আসর আলোকিত করে। টুর্নামেন্টে ৬ গোল করেন তিনি। এর মধ্যে ৫টিই করেন আসল দুই ম্যাচে। সেমি-ফাইনালে ফ্রান্সকে উড়িয়ে দেওয়ার পথে করে হ্যাটট্রিক, ফাইনালে সুইডেনকে বিধ্বস্ত করার পথে দুটি। 

তবে শুধু গোলই নয়, বল পায়ে নানা কারিকুরি আর দুর্দান্ত সব স্কিল দেখিয়ে তাক লাগিয়ে দেন পেলে। এই আসরেই ‘জোগো বোনিতো’ বা ‘সুন্দর ফুটবল’ দিয়ে গোটা ব্রাজিল দল বিশ্বজুড়ে ফুটবল অনুসারীদের মন জয় করে নেয়। সেই দলের হয়েই নিজেকে আলাদা করে ফুটিয়ে তোলেন পেলে। 

জুস্ত ফঁতেন – ১৯৫৮ 

৬ ম্যাচ, ১৩ গোল। ব্যস, ইতিহাসে অমর জুস্ত ফঁতেন। স্রেফ এক আসরের বিবেচনায় সম্ভবত বিশ্বকাপ ইতিহাসের সবচেয়ে চমকপ্রদ পারফরম্যান্স। এক আসরে সবচেয়ে বেশি গোলের এই রেকর্ড টিকে আছে ৬৪ বছর ধরে। কেউ এটি কখনও ছাড়িয়ে যেতে পারবে না বলেই মনে করা হয়। 

ফ্রান্স জাতীয় দলের হয়ে স্রেফ ২১ ম্যাচ খেলেছেন ফঁতেন। গোল করেছেন ৩০টি। এর মধ্যে আছে ১৯৫৮ বিশ্বকাপের ওই অতি মানবীয় পারফরম্যান্স। 

প্যারাগুয়ের বিপক্ষে হ্যাটট্রিক দিয়ে ফঁতেন শুরু করেন তার স্বপ্নযাত্রা। দল জেতে ৭-৩ গোলে। পরের ম্যাচে যুগোশ্লাভিয়ার বিপক্ষে ৩-২ গোলে হেরে যায় ফ্রান্স। সেখানে দুটি গোলই ফঁতেনের। গ্রুপের শেষ ম্যাচে স্কটল্যান্ডের বিপক্ষে ২-১ গোলের জয়ে গোল করেন একটি। 

গ্রুপ পর্বের ফর্ম নক আউট পর্বেও ধরে রেখে কোয়ার্টার-ফাইনালে নর্দান আয়ারল্যান্ডের বিপক্ষে করেন ২ গোল। তবে সেমি-ফাইনালে ব্রাজিলের অসাধারণ ফুটবলের সামনে লড়াই জমাতেই পারেনি ফ্রান্স। ৫-২ গোলের হারে ফঁতেনের একটি গোল ছিল যথারীতি। 

শেষ নয় ওখানেই। তৃতীয় স্থান নির্ধারণী ম্যাচে পশ্চিম জার্মানির মতো শক্তিশালী দলের বিপক্ষে একাই করেন ৪ গোল! 

ফুটবল ইতিহাসের সেরাদের তালিকায় ফঁতেনের জায়গা হয় না এমনিতে। কিন্তু এই এক কীর্তিতেই ইতিহাসে চিরস্থায়ী জায়গা পেয়ে গেছেন তিনি। 

গারিঞ্চা – ১৯৬২ 

ব্রাজিলে অনেকে পেলের চেয়েও এগিয়ে রাখতেন গারিঞ্চাকে। ১৯৬২ বিশ্বকাপে যখন চোট পেয়ে ছিটকে গেলেন পেলে, নিজের মাহাত্ম বোঝানোর সুযোগ এলো গারিঞ্চার সামনে। তিনি যা করলেন, তাতে তাকে সেরা মনে করা লোকদের যুক্তিগুলোই শক্ত হলো আরও। 

১৯৫৮ বিশ্বকাপেও দারুণ খেলেন গারিঞ্চা। তবে ১৯৬২ আসরে পেলে বাইরে চলে যাওয়ার পর বলা যায় পুরো দায়িত্ব তিনি নিজের কাঁধে তুলে নেন। ফুটবল ইতিহাসের সেরা রাইট উইঙ্গারদের একজন মনে করা হয় তাকে। অনেকের মতে, তিনিই অবিসংবাদিত সেরা। ওই বিশ্বকাপে তা মেলে ধরেন পুরোপুরি। অসাধারণ সব স্কিল, ড্রিবলের জাদু দেখিয়ে মোহিত করেন বিশ্বকে। 

শুধু বল পায়ে কারিকুরিই নয়, গুরুত্বপূর্ণ গোলও করেন তিনি। কোয়ার্টার-ফাইনালে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে করেন ২ গোল, সেমি-ফাইনালে স্বাগতিক চিলির বিপক্ষেও দুটি। ফাইনালে গোল না পেলেও জ্বর নিয়ে মাঠে নেমেও দুর্দান্ত খেলেন। চিলির প্রত্রিকা ‘এল মারকুরিও’ বিশাল শিরোনাম করে, “গারিঞ্চা কোন গ্রহ থেকে এসেছে!’ 

ইউসেবিও – ১৯৬৬ 

একটি বিশ্বকাপই খেলতে পেরেছেন ইউসেবিও। নিজের জাত চিনিয়ে রেখেছেন একমাত্র সেই আসর দিয়েই। ওই আসর দিয়েই বিশ্বকাপ অভিষেক হয় পর্তুগালের। প্রথম আসরেই তারা তাক লাগিয়ে দেয় তৃতীয় হয়ে। দারুণ প্রতিভাবান ও বিপজ্জনক দলটির প্রাণভ্রোমরা ছিলেন ইউসেবিও। 

তাকে ডাকা হতো ‘দা ব্ল্যাক প্যান্থার’ নামে। তার মতো ক্ষিপ্রগতির ফুটবলার ইতিহাসেই আর খুব বেশি আসেনি বলে মনে করা হয়। তবে শুধু গতিই নয়, স্কিল ও প্রাণশক্তির প্রদর্শনী দেখিয়ে ঝড় তোলেন তিনি বিশ্বকাপে। 

প্রথম ম্যাচে হাঙ্গেরির বিপক্ষে গোল পাননি। পরে সময় যত গড়ায়, ততই তিনি নিজেকে ছাড়িয়ে যেতে থাকেন। বুলগেরিয়ার বিপক্ষে করেন এক গোল, ব্রাজিলের বিপক্ষে দুটি। এরপর কোয়ার্টার-ফাইনাল, ওই আসরের আরেক চমক উত্তর কোরিয়ার বিপক্ষে। 

ওই ম্যাচে ইউসেবিওর পারফরম্যান্সকে মনে করা হয় বিশ্বকাপের কোনো এক ম্যাচে কারও সেরা পারফরম্যান্স। ২৫ মিনিটের মধ্যেই ৩ গোল করে উত্তর কোরিয়া এগিয়ে যায় অনেকটা। কিন্তু তাতে দমে না গিয়ে পর্তুগাল যা দেখায়, ফুটবল ইতিহাসে ঘুরে দাঁড়ানোর অধ্যায়গুলোর মধ্যে তা থাকে সবচেয়ে স্মরণীয়গুলোর মধ্যে। সেই অদম্য লড়াইয়ের নায়ক ইউসেবিও। 

প্রথমার্ধেই দুটি গোল করে পর্তুগাল। দুটিই করেন ইউসেবিও। দ্বিতীয়ার্ধের শুরুর দিকে তিনি গোল করেন আরও দুটি। এক ম্যাচেই চার গোল। পর্তুগাল শেষ পর্যন্ত ম্যাচ জিতে নেয় ৫-৩ গোলে। 

সেমি-ফাইনালে ইংল্যান্ডের সঙ্গে পেরে ওঠেনি পর্তুগাল। তবে ২-১ গোলের হারে একমাত্র গোলটি ইউসেবিওর। তৃতীয় স্থান নির্ধারণী ম্যাচেও একটি গোল আসে তার পা থেকে। সব মিলিয়ে ৯ গোল নিয়ে শেষ করেন আসর। 

জার্ড মুলার – ১৯৭০ 

বায়ার্ন মিউনিখ ও পশ্চিম জার্মানির হয়ে তার রেকর্ড অবিশ্বাস্য। তার পরও ১৯৭০ আসরে তার পারফরম্যান্স ছিল চমকপ্রদ। ওই বিশ্বকাপে আলো ছড়ান তিনি ১০ গোল করে। 

মরক্কোর বিপক্ষে পশ্চিম জার্মানির ২-১ গোলের জয়ে ১টি গোল করে আসর শুরু করেন মুলার। পরের দুই ম্যাচেই বুলগেরিয়া ও পেরুর বিপক্ষে টানা দুটি হ্যাটট্রিক! কোয়ার্টার-ফাইনালে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে তার অতিরিক্ত সময়ের গোল ম্যাচের ভাগ্য গড়ে দেয়। সেমি-ফাইনালেও দুটি গোল করেন তিনি অতিরিক্ত সময়ে। তবে তা যথেষ্ট হয়নি। তুমুল উত্তেজনাপূর্ণ ম্যাচে ইতালির কাছে ৪-৩ গোলে হেরে যায় পশ্চিম জার্মানি। 

ওই বিশ্বকাপের পারফরম্যান্সেই ‘বোম্বার’ নামে খ্যাতি পেয়ে যান তিনি, যা তার পরিচিতি হয়ে রয় আজীবন। 

পাওলো রস্সি- ১৯৮২ 

১৯৮২ বিশ্বকাপের পাওলো রস্সি যেন রূপকথার চরিত্র। বাস্তবে এমন চিত্রনাট্য লেখা যে অসম্ভব! 

ওই বিশ্বকাপে তার খেলারই কথা ছিল না। ম্যাচ গড়াপেটায় নাম আসায় তিন বছরের জন্য নিষিদ্ধ করা হয় তাকে। বিশ্বকাপও এর মধ্যেই পড়ে যায়। পরে তিনি আবেদন করে শাস্তি এক বছর কমাতে পারেন। বিশ্বকাপ খেলার সুযোগ তাতে মেলে। কিন্তু দুই বছর খেলার বাইরে থাকায় মুটিয়ে যাওয়া, ছন্দহীন স্ট্রাইকারকে বিশ্বকাপ দলে নেওয়া নিয়েও বিতর্ক হয় তুমুল। 

সেই বিতর্ক আরও উচ্চকিত হয় বিশ্বকাপ শুরুর পর। ইতালি এগোতে থাকে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে, রস্সি মাঠে হয়ে থাকেন প্রায় অদৃশ্য। গ্রপ পর্বে ৩ ড্র নিয়ে কোনোরকমে পরের ধাপে যেতে পারে ইতালি। সেখানে আরেক গ্রুপ রাউন্ডে প্রপিক্ষ আর্জেন্টিনা ও ব্রাজিল। ইতালির বিদায়কে মনে করা হচ্ছিল স্রেফ সময়ের ব্যাপার। কিন্তু রস্সির চমকে বদলে যায় সবকিছু। 

এখানেও প্রথম ম্যাচে গোল পাননি রস্সি। তবে আর্জেন্টিনাকে ২-১ গোলে হারাতে পারে ইতালি। এরপরই নায়কের জেগে ওঠার পালা। যে দলটি ছিল ওই বিশ্বকাপের ফেভারিট, এখনও যে দলকে মনে করা হয় ফুটবল ইতিহাসের সেরা দলগুলির একটি, সেই ব্রাজিলকে স্তম্ভিত করে দেন রস্সি। তার হ্যাটট্রিকে ৩-২ গোলের জয়ে ইতালি পা রাখে সেমি-ফাইনালে। 

রস্সি তখন ছুটতে শুরু করেছেন, ইতালিকে আর থামায় কে! সেমিতে পোলান্ডের সঙ্গে রস্সি জাল খুঁজে পান দুই দফায়। পশ্চিম জার্মানির বিপক্ষে ফাইনালে প্রথমার্ধ গোলশূন্য থাকার পর দ্বিতীয়ার্ধে তার গোলেই এগিয়ে যায় ইতালি। 

শেষ পর্যন্ত ৩-১ গোলে জিতে ৪৪ বছরের বিশ্বকাপ ট্রফির খরা কাটায় ইতালি। তিন ম্যাচের পারফরম্যান্সেই ‘গোল্ডেন বুট’ পেয়ে যান রস্সি। ঘুরে দাঁড়ানোর স্মরণীয় এক অধ্যায় রচনা করে নিজের নাম খোদাই করে রাখেন বিশ্বকাপ ইতিহাসে। 

দিয়েগো মারাদোনা – ১৯৮৬ 

অনেকে গোল করে রাঙিয়েছেন বিশ্বকাপের নানা আসর, অনেকে দেখিয়েছেন বল পায়ে স্কিলের জাদু। দুটির সমন্বয় দিয়েগো মারাদোনার মতো করে আর মনে হয় কেউ পারেননি। একজন ফুটবলার সর্বোচ্চ যা করতে পারেন এবং একা দলকে যতটা টানতে পারেন, সেটির আদর্শ মানদণ্ড বলা যায় ১৯৮৬ বিশ্বকাপের মারাদোনা। 

ওই আসরের মারাদোনা গোল করেছেন ৫টি। প্রতিটিই দুর্দান্ত। কোয়ার্টার-ফাইনালে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে সেই বিতর্কিত ‘হ্যান্ড অব গড’ গোল যেমন করেন, এর চার মিনিট পরই করেন একক নৈপুণ্যে অবিশ্বাস্য এক গোল, যা অমর হয়ে আছে ‘গোল অব দা সেঞ্চুরি’ নামে। এই গোলের মতোই আরেকটি অসাধারণ গোল করেন সেমি-ফাইনালে। বেলজিয়ামে বিপক্ষে শেষ চারের সেই লড়াইয়ে আর্জেন্টিনার দুটি গোলই তার। 

তবু শুধু গোলের কথা বললে এই বিশ্বকাপের মারাদোনাকে নিয়ে বলা হয় না কিছুই। জাদুকরি সব স্কিল, পায়ের কারিকুরি, মাঠময় ছুটে বেড়ানো, দাপট, কর্তৃত্ব, সব মিলিয়ে পূর্ণতার সর্বোচ্চ চূড়া যেন তিনি স্পর্শ করেন এই আসরে। এই বিশ্বকাপের পারফরম্যান্সে বিশ্বজুড়ে তার বিপুল জনপ্রিয়তা ও উন্মাদনা ছড়িয়ে পড়ে। ফাইনালে তিনি গোল করেননি, দলকে দলকে চ্যাম্পিয়ন করানোর প্রায় একক কৃতিত্ব দেওয়া হয় তাকে। 

জিনেদিন জিদান – ১৯৯৮ 

ওই বিশ্বকাপের সর্বোচ্চ গোলস্কোরার তিনি ছিলেন না, সেরা খেলোয়াড়ও নন। বরং গ্রুপ পর্বে লাল কার্ড দেখে মাঠ ছাড়েন। তারপরও ওই বিশ্বকাপের জিনেদিন জিদানকে আলাদা করে মনে রাখতেই হবে। জিদান ছিলেন বলেই ঘরের মাঠে সেবার বিশ্বকাপ জয়ের স্বাদ পেয়েছিল ফ্রান্স। 

প্রথম ম্যাচে দক্ষিণ আফ্রিকা বিপক্ষে একটি গোল বানিয়ে দেন তিনি। সৌদি আরবের বিপক্ষে একটি গোলে তিনি রাখেন অবদান। তবে সেই ম্যাচেই ফুয়াদ আনোয়ারকে পা দিয়ে মাড়িয়ে লাল কার্ড দেখেন। ফ্রান্সের কোনো ফুটবলারের প্রথম লাল কার্ড ছিল সেটি বিশ্বকাপে। দুই ম্যাচের জন্য নিষিদ্ধ হন তিনি। 

কোয়ার্টার-ফাইনালে ফিরে বেশ ভালো খেলেন ইতালির বিপক্ষে। গোল যদিও পাননি। তবে গোলশূন্য ম্যাচে টাইব্রেকারে দলের প্রথম শট নিয়ে গোল করেন। সেমি-ফাইনালেও ভালো খেলে অবদান রাখেন দলের জয়ে। তবে অপেক্ষা ছিল অসাধারণ কিছুর, যা তিনি উপহার দেন ফাইনালে। ব্রাজিলের বিপক্ষে প্রায় কর্নার থেকে প্রায় একইরকম দুটি হেডে গোল করেন। সেই ধাক্কা আর ব্রাজিল সয়ে উঠতে পারেনি। 

তারকা ছিলেন তিনি আগে থেকেই। ওই দুই গোলের পর হয়ে ওঠেন মহাতারকা। ওই বছর ব্যালন ডি’অর, ফিফা বর্ষসেরার খেতাবও জেতেন তিনিই। 

রোনালদো -২০০২ 

এই বিশ্বকাপ ছিল রোনালদোর জন্য অপূর্ণতা ঘোচানোর অভিযান। প্রত্যাশা পূরণ আর ঋণ শোধ করার চ্যালেঞ্জ। আগের আসরের ফাইনালের হারের আক্ষেপ মেটানোর পালা। অসাধারণ পারফরম্যান্সে তিনি সবটুকু আদায় করে নেন এবং নিজেকে নিয়ে যান অনন্য উচ্চতায়। 

প্রথম ম্যাচে তুরস্কের বিপক্ষে গোল দিয়ে শুরু। এরপর চীনের বিপক্ষে করেন এক গোল, কোস্টা রিকার বিপক্ষে দুটি। দ্বিতীয় রাউন্ডে বেলজিয়ামের বিপক্ষে শেষ দিকে গোল করে তিনি নিশ্চিত করে দেন দলের জয়। সেমি-ফাইনালে দলের একমাত্র গোল তারই। 

এরপর ফাইনাল-যেটির অপেক্ষায় ছিলেন চার বছর ধরে। জার্মান গোলকিপার অলিভার কানের সঙ্গে রোনালদোর দ্বৈরথ নিয়ে বেশ উত্তেজনা ছড়ায় ফাইনালের আগে। সেই লড়াইয়ে ব্রাজিলিয়ান তারকা একতরফা জয়ী। ফাইনালে দুই গোল করে দলকে এনে দেন শিরোপা। ৮ গোল করে নিজে জিতে নেন ‘গোল্ডেন বুট।’ 

বক্সের ভেতর তার দক্ষতা, ম্যাচের পর ম্যাচে গোল, অদ্ভুতুড়ে চুল, সব মিলিয়েই ওই বিশ্বকাপে আলোড়ন তোলেন তিনি।