এই উইঙ্গার কাতারে নোঙর ফেলবেন অস্ট্রেলিয়ার জার্সি গায়ে জড়িয়ে।
Published : 10 Nov 2022, 06:22 PM
এখন তার পায়ে শোভা পায় নতুন নতুন জুতো। এখন তিনি মসৃণ, সবুজ মাঠের উইং ধরে ছুটে চলেন, আক্রমণ শাণান। সতীর্থদের আক্রমণের সুর বেঁধে দেন, নিজেও করেন গোল। আইবা মাবিলের দিনগুলো এখন এমনই আলো ঝলমলে। অথচ তার জীবনটা একসময় ছিল শঙ্কায়, দোটানায় ভরা। যে জীবন যুদ্ধ-বিধ্বস্ত দক্ষিণ সুদান ও কেনিয়ার আশ্রয়শিবিরে কাটানো অনিশ্চিত দিন-রাতের গল্পে ঠাসা!
১৯৯৪ সালের কথা। তখন জন্মও হয়নি মাবিলের। যুদ্ধ-বিধ্বস্ত দক্ষিণ সুদানের এক দম্পতির ঠাঁই হলো কেনিয়ার কাকুমা শহরের শরনার্থী শিবিরে। জাতিসংঘ পরিচালিত ওই আশ্রয় শিবিরে এক বছর কাটানোর পর এই দম্পতির কোলজুড়ে এলো শিশুটি। জীবন সেখানে বড্ড কঠিন এবং চরম অনিশ্চয়তা সঙ্গে করে বেড়ে উঠতে থাকল শিশুটি। নোংরা মাঠে, নগ্ন পায়ে যেটা নিয়ে শিশুটি সারাক্ষণ মেতে থাকত, সেটাকে ফুটবল না বলাই ভালো। সেটি ছিল একগাদা প্লাস্টিকের ব্যাগ মুড়িয়ে-পেচিয়ে বানানো বস্তু!
শরণার্থী শিবিরে দশটি বছর পার করা সেই কিশোরই আজকের ২৭ বছর বয়সী মাবিল। বৃহস্পতিবার রাতে যিনি কাদিসের জার্সি গায়ে চাপিয়ে স্প্যানিশ ও ইউরোপিয়ারন চ্যাম্পিয়ন রিয়াল মাদ্রিদের বিপক্ষে খেলবেন। কদিন পর অস্ট্রেলিয়ার হয়ে কাতার বিশ্বকাপে খেলতে সওয়ার হবেন উড়ানে। মেঘের ভেতর দিয়ে ভাসতে ভাসতে কী তার মনে পড়বে না পেছনের সেই দিনগুলো?
জীবনের অনেকটা সময় শরণার্থী শিবিরে কাটনোর পর মাবিলরা এলেন অস্ট্রেলিয়ার অ্যাডিলেইডে। এরপর দ্রুতই সবকিছু বদলে যেতে লাগল। শৈশবের ভালোবাসা ফুটবলের পেছনে ছুটলেন নতুন করে এবং যথাযথভাবে। মানে, এবার আর চট, গ্লাস্টিক ব্যাগের দলা নয়, সত্যিকারের ফুটবল নিয়ে এবং খালি পায়ে নয়, বুট পরে শুরু হলো খেলা। যদিও শুরুর দিকে অস্ট্রেলিয়ায় ভাষাগত সমস্যায় ভুগতে হয়েছিল বেশ।
একটু একটু করে ভাষাগত সমস্যা কাটিয়ে উঠলেন মাবিল। বল পায়ে আলো ছড়াতে লাগলেন। স্থানীয় কয়েকটি যুব দলে গোলস্কোরার উইঙ্গার হিসেবে খেলার পর যোগ দেন আধা-পেশাদার দল ক্যাম্পবেলটাউন সিটিতে। দলটির হয়ে মাত্র ১৬ বছর বয়সে অভিষেকও হয় তার। বেশ কিছু ম্যাচে এমন ঝলকই দেখালেন, তার সামনে দ্রুতই খুলে গেল অ্যাডিলেইড ইউনাইটেডের দরজা।
আর পেছন ফিরে তাকানো নয়, এ-লিগেও আলো ছড়াতে থাকলেন ধারাবাহিকভাবে। উইং ধরে গতি ও স্কিল, বক্সে নিখুঁত ক্রস বাড়ানোর দক্ষতা এবং গোল করার সামর্থ্য দিয়ে মুগ্ধতা ছড়াতে থাকলেন। ২০১৪-১৫ মৌসুমে ২৪ ম্যাচে সাতবার প্রতিপক্ষের জালের দেখাও পেলেন টিনএজার মাবিল।
২০১৫ সালে ডেনমার্কের দল মিতউইলানে যোগ দেওয়ার পর গেম টাইম পাওয়ার জন্য তাকে বেশ সংগ্রাম করতে হচ্ছিল। পরে ধারে যোগ দিলেন আরেক ডেনিশ ক্লাব ইসপিয়ায়। এরপর নতুন ঠিকানা হলো পর্তুগালের দল পাকোস দে ফেরেইরায়; সেখানেও গেলেন ধারে।
এদিক-ওদিক ছুটে বেড়ানো বন্ধ হলো ২০১৮ সালে, মিতউইলানে ফিরলেন মাবিল এবং সেরা একাদশে সুযোগ পেতে থাকলেন নিয়মিত। একদিন ডাকও পেয়ে গেলেন অস্ট্রেলিয়া দলে। কুয়েতের বিপক্ষে অভিষেক রাঙালেন গোল করে!
এখন মাবিল ক্লাব, জাতীয় দল সবখানেই গুরুত্বপূর্ণ। ২০১৯ সালে মিতউইলানকে ডেনিশ কাপ ও ২০২০ সালে লিগ শিরোপা জেতানো এই উইঙ্গার খেলেছেন চ্যাম্পিয়ন্স লিগেও। ৮ গোল ও ৬টি অ্যাসিস্ট করে অবদান রাখেন তিনি।
মাঠের বাইরে মাবিলের অন্যরকম জীবন আছে। তিনি এখন শরণার্থী শিবিরে বেড়ে ওঠা, পিছিয়ে থাকা মানুষগুলোর জন্য অনুপ্রেরণা, উদাহরণ। আশার প্রদ্বীপও। এরই মধ্যে ভাইয়ের সঙ্গে ‘দা বেয়ারফুট টু বুটস চ্যারিটি’ গড়ে তুলেছেন। উদ্বাস্তুদের স্বাভাবিক জীবনে ফেরাতে কাজ করছে সংগঠনটি। এটি পরিচালিত হয় কাকুমায়, একসময় যেটা ছিল তার ‘বাড়ি’, বেড়ে ওঠার একমাত্র আঙিনা!
ফুটবল নিয়ে তো বটেই, এই সংগঠনটি শিক্ষা, শিশুস্বাস্থ্য, লিঙ্গসমতা নিয়েও কাজ করে। ২০১৮ সালে মাবিল পান ফিফপ্রো মেরিট অ্যাওয়ার্ড। এই চ্যারিটির প্রধান ইয়ান স্মিথ, যিনি মাবিলের সাবকে ক্লাব অ্যাডিলেইড ইউনাইটেডের বোর্ড সদস্য। মাবিলের এই প্রচেষ্টাকে তিনি দেখেন পিছিয়ে থাকাদের এগিয়ে যাওয়ার পাথেয় হিসেবে। অস্ট্রেলিয়ার টেলিভিশন নেটওয়ার্ক ‘এসবিএস’-এ দেওয়া সাক্ষাৎকারে একবার তেমনটাই বলেছিলেন তিনি।
“যখন তারা মাবিলের মতো একজন তরুণকে এগুলো অর্জন করতে দেখে, তখন তাদের স্বপ্নও বাস্তবে ধরা দেয়। ভালোভাবে বাঁচার এটা একটা উপায়, এগিয়ে যাওয়ার পথ। এর গুরুত্ব ছোট করে দেখা যায় না। মাবিল অনন্যসাধারণ একজন তরুণ। সিংহের মতো সাহস আর তার হৃদয়টা দেবদূতের মতো।”
বল পায়ে মাবিল স্মরণীয় সাফল্য দেখান জুনে। অস্ট্রেলিয়া যখন বাছাইয়ে আন্তঃমহাদেশীয় প্লে-অফে পেরুর মুখোমুখি হয়েছিল, কাতার বিশ্বকাপের টিকেট পাওয়া নিয়ে পড়েছিল দুঃশ্চিন্তায়, সেই ম্যাচে।
গোলশূন্য ম্যাচটি গড়াল টাইব্রেকারের সাডেন ডেথে। মাবিল ঠাণ্ডা মাথায় লক্ষ্যভেদ করার পর পেরুর আলেক্স ভালেরার শট গোলরক্ষক অ্যান্ড্রু রেডমেইনে রুখে দিলে নিশ্চিত হয়ে যায় অস্ট্রেলিয়ার কাতার বিশ্বকাপে খেলা।
এর সপ্তাহ দুয়েক পর বড় এক লাফ দিলেন মাবিল। চার বছরের চুক্তিতে যোগ দিলেন কাদিসে। গত মৌসুমে শেষ দিনে কোনোমতে অবনমন এড়ানো ক্লাবটি দল পুন:গঠনের প্রচেষ্টায় ছিল।
লা লিগায় অবশ্য মাবিলের শুরুটা সহজ ছিল না। মৌসুমের প্রথম কয়েক সপ্তাহে নিয়মিত খেলার সুযোগ পেলেন তিনি, কিন্তু কাদিস হারল প্রথম পাঁচ ম্যাচে। দলে নতুন আসা ব্রায়ান ওকাম্পো ও থিও বোঙ্গোন্দার পেছনে পড়ে গেলেন তিনি।
গত সেপ্টেম্বরের পর একবারই বদলি হিসেবে খেলার সুযোগ পেয়েছেন মাবিল।
হতে পারে রিয়ালের বিপক্ষে আজ সান্তিয়াগো বের্নাবেউয়ে খেলার সুযোগই পাচ্ছেন না মাবিল। তবে এর উল্টো পাশে ভালো দিকও আছে। এখন অন্তত তার কোনো ক্লান্তি থাকবে না। সতেজ, ফিট হয়ে কাতার বিশ্বকাপে অস্ট্রেলিয়ার জন্য ঝাঁপিয়ে পড়তে পারবেন। তার জীবনের গল্পটাই হৃদয়গ্রাহী, সেখানে হয়ত যোগ করতে পারবেন আরেকটি পাতা। যে পাতায় করুণ রস নয়, বরং থাকবে সাফল্যের সুর।