১৯৬২ বিশ্বকাপ: ব্রাজিলের ‘দ্বিতীয়’

চিলি আসরে জিতে উরুগুয়ে ও ইতালির পাশে বসে ব্রাজিল।

ইকবাল শাহরিয়ারবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 11 Nov 2022, 06:37 AM
Updated : 11 Nov 2022, 06:37 AM

এক যুগ পর বিশ্বকাপের আসর ফেরে লাতিন আমেরিকায়। ফিফা কংগ্রেসে ভোটে আর্জেন্টিনাকে পেছনে ফেলে আয়োজনের দায়িত্ব পায় চিলি। তৎকালীন চেকোস্লোভাকিয়াকে হারিয়ে টানা দ্বিতীয়বারের মতো শিরোপা জেতে ব্রাজিল। 

১৯৬০ সালে চিলিতে ভয়ঙ্কর এক ভূমিকম্পের জন্য আয়োজন নিয়ে শঙ্কা জাগে। তবে সবাইকে ভুল প্রমাণ করে ১৯৬২ সালের ৩০ মে থেকে ১৭ জুন পর্যন্ত সাফল্যের সঙ্গেই টুর্নামেন্ট আয়োজন করে দেশটি। 

সুইডেন আসরের মতো একই ফরম্যাটে হয় চিলি বিশ্বকাপ। চূড়ান্ত পর্বে অংশ নেয় ১৬ দল। সরাসরি খেলে স্বাগতিক চিলি ও গত আসরের চ্যাম্পিয়ন ব্রাজিল। এই দুই দল ছাড়া লাতিন আমেরিকার প্রতিনিধি ছিল আর্জেন্টিনা, উরুগুয়ে ও কলম্বিয়া।   

ইউরোপ থেকে অংশ নেয় ১০ দেশ- বুলগেরিয়া, চেকোস্লোভাকিয়া, পশ্চিম জার্মানি, সোভিয়েত ইউনিয়ন, স্পেন, ইতালি, হাঙ্গেরি, ইংল্যান্ড, সুইজারল্যান্ড ও যুগোস্লাভিয়া। এর বাইরে ছিল কেবল উত্তর আমেরিকা থেকে মেক্সিকো। এই আসর দিয়েই বিশ্বকাপে অভিষেক হয় কলম্বিয়া ও বুলগেরিয়ার।

গ্রুপ পর্ব 

চারটি গ্রুপে চারটি করে দল অংশ নেয়। গ্রুপের প্রতিটি দল রাউন্ড রবিন লিগ পদ্ধতিতে খেলে পরস্পরের বিপক্ষে। সেরা দুটি করে দল যায় কোয়ার্টার-ফাইনালে। 

গ্রুপ ১: সোভিয়েত ইউনিয়ন, উরুগুয়ে, যুগোস্লাভিয়া, কলম্বিয়া

গ্রুপ ২: পশ্চিম জার্মানি, ইতালি, চিলি, সুইজারল্যান্ড

গ্রুপ ৩: ব্রাজিল, চেকোস্লোভাকিয়া, স্পেন, মেক্সিকো

গ্রুপ ৪: হাঙ্গেরি, ইংল্যান্ড, আর্জেন্টিনা, বুলগেরিয়া

গ্রুপ ১ থেকে পরের ধাপে যায় সোভিয়েত ইউনিয়ন ও যুগোস্লাভিয়া। দুই জয় ও এক ড্রয়ে ৫ পয়েন্ট নিয়ে গ্রুপ সেরা হয় সোভিয়েত ইউনিয়ন। দুই জয়ে চার পয়েন্ট নিয়ে রানার্সআপ হয় যুগোস্লাভিয়া। এক জয়ে ২ পয়েন্ট নিয়ে তৃতীয় হয় উরুগুয়ে। নিজেদের প্রথম বিশ্বকাপে কলম্বিয়ার অর্জন ড্র থেকে ১ পয়েন্ট। 

গ্রুপ ২ থেকে কোয়ার্টার-ফাইনালে যায় পশ্চিম জার্মানি ও চিলি। দুই জয় ও এক ড্রয়ে ৫ পয়েন্ট নিয়ে গ্রুপ সেরা হয় পশ্চিম জার্মানি। দুই জয়ে ৪ পয়েন্ট নিয়ে রানার্সআপ চিলি। একটি করে জয় ও ড্রয়ে ৩ পয়েন্ট নিয়ে তৃতীয় হয়ে গ্রুপ পর্ব থেকেই বিদায় নেয় ইতালি। তিন হারে শূন্য হাতে ফেরে সুইজারল্যান্ড। 

২ জুন, ১৯৬২। এদিন চিলির মুখোমুখি হয় সাবেক বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন ইতালি। ইতিহাসের পাতায় ম্যাচটি ঠাঁই করে নিয়েছে ‘ব্যাটেল অফ সান্তিয়াগো’ নামে। আক্ষরিক অর্থেই যেন মাঠে যুদ্ধ হয়েছিল সেদিন। মাঠে দুই দলের খেলোয়াড়রা বারবার জড়িয়ে পড়ছিলেন সংঘর্ষে। পরিস্থিতি এতটাই নাজুক ছিল যে, ফুটবলারদের শান্ত করতে তিনবার মাঠে পুলিশ প্রবেশ করে! ফুটবল ইতিহাসে যার নজির খুব বিরল।

গ্রুপ ৩ থেকে নক আউট পর্বে যায় ব্রাজিল ও চেকোস্লোভাকিয়া। দুই জয় ও এক ড্রয়ে ৫ পয়েন্ট নিয়ে গ্রুপ সেরা হয় শিরোপাধারী ব্রাজিল। একটি করে জয় ও ড্রয়ে ৩ পয়েন্ট নিয়ে রানার্সআপ হয় চেকোস্লোভাকিয়া। একটি করে জয়ে ২ পয়েন্ট করে পায় মেক্সিকো ও স্পেন। গোল অনুপাতে এগিয়ে থেকে তৃতীয় হয় মেক্সিকো। 

গ্রুপ ৪ থেকে পরের ধাপে যায় হাঙ্গেরি ও ইংল্যান্ড। দুটি জয় ও একটি ড্রয়ে ৫ পয়েন্ট নিয়ে গ্রুপ সেরা হয় হাঙ্গেরি। একটি করে জয় ও ড্রয়ে ৩ পয়েন্ট করে পরের জায়গাটির জন্য লড়াইয়ে নামে ইংল্যান্ড ও আর্জেন্টিনা। গোল অনুপাতে এগিয়ে থাকায় কোয়ার্টার-ফাইনালে যায় ইংল্যান্ড, বিদায় নেয় আর্জেন্টিনা। এক ড্রয়ে বুলগেরিয়ার অর্জন ১ পয়েন্ট। আসরের একমাত্র হ্যাটট্রিক হয় এই দলটির বিপক্ষেই; ৬-১ গোলের জয়ে যা করেন হাঙ্গেরির ফ্লোরিয়ান আলবের্ত।

কোয়ার্টার-ফাইনাল 

শেষ আটের লাইনআপ ছিল এমন: ব্রাজিল-ইংল্যান্ড, চিলি-সোভিয়েত ইউনিয়ন, পশ্চিম জার্মানি- যুগোস্লাভিয়া, হাঙ্গেরি- চেকোস্লোভাকিয়া। 

ইংল্যান্ডকে ৩-১ গোলে হারিয়ে সেমি-ফাইনালে পৌঁছায় ব্রাজিল। তৎকালীন ইউরোপিয়ান চ্যাম্পিয়ন সোভিয়েত ইউনিয়নকে ২-১ গোলে হারিয়ে তাদের সঙ্গী হয় চিলি। 

‘অল ইউরোপিয়ান’ দুটি কোয়ার্টার-ফাইনালে হাঙ্গেরিকে ১-০ গোলে হারায় চেকোস্লোভাকিয়া। একই ব্যবধানে পশ্চিম জার্মানির বিপক্ষে জেতে যুগোস্লাভিয়া।

সেমিফাইনাল 

১৩ জুন ভিনা দেল মারে ফাইনালে যাওয়ার লড়াইয়ে সেমি-ফাইনালে যুগোস্লাভিয়াকে ৩-১ গোলে হারায় চেকোস্লোভাকিয়া। জোড়া গোল করেন এডলফ শিয়েরার, অন্যটি ইউসেফ কাদ্রাবা। যুগোস্লাভিয়ার একমাত্র গোলটি করে দ্রাজান জেরকোভিচ। 

সান্তিয়াগোতে অন্য সেমি-ফাইনালে চিলিকে ৪-২ গোলে হারিয়ে ফাইনালে যায় ব্রাজিল। জোড়া গোল করেন গারিঞ্চা ও ভাভা। স্বাগতিকদের গোল দুটি করে হোর্হে লুইস তোরো ও লিওনেল সানচেস। 

এই ম্যাচে লাল কার্ড দেখেন গারিঞ্চা। ফাইনালে তার খেলার কথা ছিল না। কিন্তু ফিফার মাধ্যমে তারর নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করান ব্রাজিলের তখনকার প্রধানমন্ত্রী তানক্রেদো নেভেস। 

২৬শে জুন তৃতীয় স্থান নির্ধারনী ম্যাচে এলাদিও আলবের্তো রোহাস দিয়াসের একমাত্র গোলে যুগোস্লাভিয়াকে ১-০ গোলে হারিয়ে তৃতীয় হয় চিলি। এখন পর্যন্ত বিশ্বকাপে যা তাদের সেরা অর্জন।

ফাইনাল

১৭ জুন, ১৯৬২। প্রায় ৬৯ হাজার দর্শকের উপস্থিতিতে সান্তিয়াগোর স্তাদিও নাসিওনালে শুরু হয় ব্রাজিল ও চেকোস্লোভাকিয়ার শিরোপা লড়াই। পিছিয়ে পড়ার পর দারুণভাবে ঘুরে দাঁড়িয়ে শিরোপা ধরে রাখে ব্রাজিল। ফাইনালে জেতে ৩-১ গোলে। 

ফাইনালে ব্রাজিলের হয়ে একটি করে গোল করেন আমারিলদো, জিতো ও ভাভা। পঞ্চদশ মিনিটে চেকোস্লোভাকিয়াকে এগিয়ে নিয়েছিলেন ইউসেফ মাসোপুস্ত।  

দ্বিতীয় দল হিসেবে শিরোপা ধরে রাখার কীর্তি গড়ে ব্রাজিল। তৃতীয় দল হিসেবে জেতে দুটি শিরোপা।

সপ্তম বিশ্বকাপ 

·                    স্বাগতিকঃ চিলি

·                    চ্যাম্পিয়নঃ ব্রাজিল

·                    রানার আপঃ চেকোস্লোভাকিয়া

·                    মোট ম্যাচঃ ৩২

·                    মোট গোলঃ ৮৯

·                    গোল গড়ঃ ২.৭৮

·                    ফ্লোরিয়ান আলবের্ত (হাঙ্গেরি), গারিঞ্চা (ব্রাজিল), ভালেন্তিন ইভানভ (সোভিয়েত ইউনিয়ন), দ্রাজান জেরকোভিচ (যুগোস্লোভিয়া), লিওনেল সানচেস (চিলি), ভাভা (ব্রাজিল) [সবাই ৪ টি করে গোল]

·                    সেরা খেলোয়াড়ঃ গারিঞ্চা  (ব্রাজিল) [আন অফিসিয়াল]