কুয়েতকে কাঁপিয়ে দিয়ে নতুন দিনের আগমণী বার্তা যেন দিয়ে রাখল হাভিয়ের কাবরেরার দল।
Published : 02 Jul 2023, 12:25 AM
স্বপ্নভঙ্গের বেদনা আছে, কিন্তু স্বপ্ন দেখার সাহসটাও যে তৈরি হয়ে গেছে! এবারের বঙ্গবন্ধু সাফ চ্যাম্পিয়নশিপে বাংলাদেশের পথচলা শেষের পর তাই এমন মিশ্র অনুভূতির লুকোচুরি খেলা কোচ, খেলোয়াড়দের মনে। টুর্নামেন্ট শুরুর আগে কে ভেবেছিল ব্যর্থতার বৃত্ত ভেঙে সেমি-ফাইনাল খেলবেন জামাল-জিকোরা। ফাইনালে ওঠার লড়াইয়ে হেরে গেলেও অবিশ্বাস্য, অভাবনীয় ফুটবলের পাসরা মেলে কুয়েতকে কাঁপিয়ে দেবে দল?
এই তো গত মার্চের কথা, বৈশ্বিক ফুটবলের মানচিত্রে পেছনে থাকা দল সিশেলসের বিপক্ষেও ঘরের মাঠে সেভাবে নিজেদের মেলে ধরতে পারেনি বাংলাদেশ। দুই ম্যাচের সিরিজে প্রথমটি ১-০ গোলের জয় এলো যদিও, পরের ম্যাচে একই ব্যবধানে হারল দল। সমালোচনার তির ধেয়ে এলো হাভিয়ের কাবরেরার দিকে। সাফে দলের প্রতি বাজি ধরার লোকের সংখ্যাও গেল কমে।
কাবরেরা নিজের ছকে ছিলেন অবিচল, আস্থা রেখেছিলেন শিষ্যদের উপর। সাফ মিশনে বেঙ্গালুরুতে আসার আগে গেলেন কম্বোডিয়ায়। সেখানে টিফফি আর্মির বিপক্ষে প্রস্তুতি ম্যাচে এবং কম্বোডিয়ার বিপক্ষে প্রীতি ম্যাচে জয় এলো ন্যুনতম ব্যবধানে। টিফফির বিপক্ষে মোহাম্মদ সোহেল রানা এবং কম্বোডিয়ার ম্যাচে জালের দেখা পেলেন মজিবুর রহমান জনি।
টানা দুই জয়ের বাড়তি আত্মবিশ্বাস নিয়ে সাফ মিশনের শুরুতে হোঁচট খেল বাংলাদেশের। রক্ষণ জমাট রেখে শক্তিশালী লেবাননকে ৮০ মিনিট পর্যন্ত আটকে রাখল দল। শেষ দিকে রক্ষণের নির্ভরতা কাজী তারিক রায়হানের ভুলেই হজম করল গোল। শেষ পর্যন্ত দল হেরে গেল ২-০ গোলে। মালদ্বীপ ম্যাচে রূপ নিল সাফে টিকে থাকার ম্যাচে।
দ্বীপ দেশটির বিপক্ষে ম্যাচের শুরুটাও শঙ্কার দোলুনি দিয়ে। সপ্তদশ মিনিটে খেলার ধারার বিপরীতে হামজা মোহাম্মদ লক্ষ্যভেদ করলে অনিশ্চয়তার মেঘ উঁকি দিল প্রবলভাবে। দারুণভাবে তা উড়িয়েও দিল দল। একে একে রাকিব হোসেন, তারিক ও শেখ মোরসালিনের গোলে কাঙ্খিত জয়ের দেখা পেল বাংলাদেশ। টিকে গেল সাফে।
ভুটান ম্যাচের চিত্রনাট্যও একই। যদিও এবার গোল খেয়ে বসা মালদ্বীপ ম্যাচের চেয়েও পাঁচ মিনিটে আগে, দ্বাদশ মিনিটে, খেলার ধারার বিপরীতে তিসেন্দা দর্জি পরাস্ত করলেন আনিসুর রহমান জিকোকে। দলটির একটি প্রচেষ্টা প্রতিহত হলো ক্রসবারে। বিপদ আঁচ করে এরপর বাংলাদেশের জেগে ওঠা। মোরসালিন সমতা ফেরানোর পর জামাল-বিশ্বনাথদের চাপে নাকাল ভুটান হলো আত্মঘাতী।
৩৬তম মিনিটে রাকিব লক্ষ্যভেদ করলে ৩-১ ব্যবধানে এগিয়ে বিরতিতে গেল দল। পরের আর ব্যবধান বাড়াতে ছিল না মরিয়া। ওই ব্যবধান ধরে রেখে ১৪ বছর পর সাফের সেমি-ফাইনালে উঠল বাংলাদেশ। শুরু হলো আরও বড় স্বপ্ন দেখার পালা; ২০০৫ সালের পর উঠতে হবে ফাইনালে। কিন্তু প্রতিপক্ষ যে এবারের টুর্নামেন্টের সবচেয়ে শক্তিশালী দল কুয়েত!
ম্যাচের আগের দিনের সংবাদ সম্মেলনে, প্রস্তুতিতে আত্মবিশ্বাসী এক বাংলাদেশের দেখাই মেলে। কোচ দিয়েছিলেন তীব্র লড়াইয়ের ঘোষণা, অধিনায়ক জামাল বলেছিলেন নিজেদের সামর্থ্যে আস্থা রাখার কথা। প্রতিশ্রুতির প্রতিফলনের ইঙ্গিত মিলে যায় শুরুতেই।
মালদ্বীপ ও ভুটান ম্যাচে শুরুতে পিছিয়ে পড়া বাংলাদেশ এ ম্যাচের দ্বিতীয় মিনিটেই পেয়ে যায় এগিয়ে যাওয়ার সুযোগ! রাকিবের নিখুঁত আড়াআড়ি ক্রসে বল এক ডিফেন্ডারের পায়ে ফাঁক গলে বেরিয়ে গেল মোরসালিনের পায়ে। একটু ঠাণ্ডা মাথায় ডানে-বায়ে শট নিলেই বল লুটোপুটি খেত জালে, কিন্তু এই তরুণ মেরে বসলেন গোলরক্ষকের গায়ে! ফিরতি বল পায়ে পেলেও পারেননি মোরসালিন।
এমন সুবর্ণ সুযোগ নষ্টে কিছুটা নড়বড়ে হলো আত্মবিশ্বাস। সপ্তম মিনিটে পিছিয়েও পড়তে পারত দল। কিন্তু গোল লাইন থেকে সালমান মোহাম্মদের হেড ফিরিয়ে দলের ত্রাতা আরেক তরুণ ইসা ফয়সাল। পোস্টের নিচে পাহাড়সমান দৃঢ়তা নিয়ে দাঁড়িয়ে গেলেন জিকোও। ইদ আল রশিদের একের পর এক শট মুখ থুবড়ে পড়তে লাগল তার সামনে।
রক্ষণে তপু বর্মন, তারিক, ইসা ও বিশ্বনাথ কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে বজ্রআঁটুনি দিয়ে রাখলেন। মাঝমাঠে দুই সোহেল রানাকে নিয়ে অধিনায়ক জামাল ভূঁইয়ার ছিলেন দারুণ সক্রিয়। তাতে রাকিবের সামনে তেড়েফুঁড়ে আক্রমণের পথ তৈরি হয়। সুযোগও আসে এই ফরোয়ার্ডের সামনে, কিন্তু ৫৪তম মিনিটে তার দূরপাল্লার শট উড়ে যায় ক্রসবার ঘেঁষে। ছয় মিনিট পর হতাশা বাড়ে আরও, এবার রাকিবের শট ফিরে ক্রসবার কাঁপিয়ে।
লম্বা সময় ধরে কখনই বাংলাদেশকে কোণঠাসা করে রাখতে পারেনি কুয়েত। নির্ধারিত ৯০ মিনিটের খেলাও শেষ হয় গোলশূন্য সমতায়। অতিরিক্ত সময়ের প্রথম পর্বের শেষ দিকে কুয়েত পায় হাফ-চান্স এবং আব্দুল্লাহ আল বোলৌশি তা কাজেও লাগান। এই ডিফেন্ডারকে শুরুতে কেউ চার্জ করেনি, সবশেষ পথ আগলে দাঁড়ান অভিজ্ঞ তপু। কিন্তু ঠাণ্ডা মাথায় তপুর দুই পায়ের ফাঁক দিয়ে নিখুঁত শট নেন বোলৌশি, তপু হতভম্ব, জিকো কিছু বুঝে ওঠার আগেই দূরের পোস্ট দিয়ে বল জালে!
দেড় যুগ পর ফাইনালে খেলার স্বপ্ন দুলে ওঠায় মরিয়া হয়ে উঠল বাংলাদেশ। প্রচণ্ড চাপও দিল। কিন্তু দূরূহ কোণ থেকে নেওয়া রাকিবের শট আটকে দিলেন গোলরক্ষ, বদলি নামা আরেক ফরোয়ার্ড সুমন রেজার শট এক ডিফেন্ডারের পায়ে লেগে হলো কর্নার, এরপর রবিউলের কর্নারও ক্লিয়ার হওয়ার পর রেফারির শেষের বাঁশিতে বেজে ওঠে বাংলাদেশের বিদায়ের রাগিনীও।
১৪ বছর পর ফাইনালে খেলার স্বপ্ন থাকল অপূর্ণ। কিন্তু মালদ্বীপ ও ভুটানের বিপক্ষে জয়, লেবানন ও কাতারের বিপক্ষে তীব্র লড়াইয়ে কাবরেরার দল ঠিকই ছাপ রেখে গেল এবারের সাফে। মিক্সড জোনে খেলোয়াড়দের সঙ্গে আলাপচারিতায় তাই ‘দুর্ভাগ্যের’ কথার পাশাপাশি শোনা গেল নতুন দিনের আগমণী সুরও।