স্প্যানিশ ফুটবল
মৌসুমে যার মাঠে নামাই একটা সময়ে মনে হচ্ছিল প্রায় অসম্ভব, সেই থিবো কোর্তোয়া পাঁচ ম্যাচ খেলে সবগুলোতে অক্ষত রাখলেন জাল, রেয়াল মাদ্রিদের আরেকটি চ্যাম্পিয়ন্স লিগ জয়ে রাখলেন বড় অবদান।
Published : 02 Jun 2024, 10:40 PM
চোটে দীর্ঘ সময় বাইরে থাকার পর যখন মাঠে ফেরার অপেক্ষা, তখনই আরেক দফা চোটের ছোবল। গত মার্চে অশ্রুসিক্ত চোখে যখন অনুশীলন সেশন ছেড়ে যান থিবো কোর্তোয়া, মৌসুমে তার মাঠে নামা প্রায় অসম্ভব বলেই ধরে নেয় সবাই। তবে অবাক করে দিয়ে রেয়াল মাদ্রিদের মূল গোলকিপার ফিরলেন মাঠে। লা লিগায় দারুণ নৈপুণ্যে জাল অক্ষত রাখলেন চার ম্যাচে। এরপর, মৌসুমের সবচেয়ে বড় ম্যাচ চ্যাম্পিয়ন্স লিগ ফাইনালেও পোস্টে দাঁড়ানোর সুযোগ পেয়ে গেলেন। সেখানেও মেলে ধরলেন নিজের সেরাটা। ইউরোপ সেরার মঞ্চে দলের আরেকটি ট্রফি জয়ে রাখলেন বড় অবদান।
চোটের প্রথম দুঃসংবাদটা আসে গত ১০ অগাস্ট। মৌসুম শুরুর আগে অনুশীলনের সময় পায়ে চোট পান কোর্তোয়া। পরীক্ষায় তার বাম হাঁটুর এন্টিরিয়র ক্রুসিয়েট লিগামেন্টে (এসিএল) চিড় ধরা পড়ে। যেতে হয় চিকিৎসকের ছুরি-কাঁচির নিচে। এরপর চলে দীর্ঘ পুনর্বাসন।
ওই চোট কাটিয়ে গত মার্চে অনুশীলনে ফেরেন তিনি। এতে দ্রুত তার মাঠে ফেরার সম্ভাবনাও জোরাল হয়। কিন্তু বিধি বাম, ১৯ মার্চ অনুশীলনের সময় এবার ডান হাঁটুতে চোট পেয়ে কান্নাভেজা চোখে ট্রেনিং গ্রাউন্ড ছাড়েন কোর্তোয়া। এমআরআই স্ক্যানে তার ডান হাঁটুর মেনিসকাসে চিড় ধরা পড়ে। এবারও করাতে হয় অস্ত্রোপচার। বাকি মৌসুমে তার মাঠে ফেরার সম্ভাবনা তেমন একটা দেখা যাচ্ছিল না।
তবে খুব দ্রুত উন্নতি হতে থাকে তার। সেরে উঠে এপ্রিলের শেষ দিকে ফেরেন অনুশীলনে। ফিটনেসে ঘাটতি থাকায় মাঠে ফেরার অপেক্ষা যদিও বাড়তে থাকে। অবশেষে সেই সুযোগ আসে ৪ মে। লা লিগায় কাদিসের বিপক্ষে ম্যাচ দিয়ে ফিরেই নিজেকে দারুণভাবে মেলে ধরেন তিনি। দলের ৩-০ গোলে জয়ের ম্যাচে কয়েকটি দারুণ সেভ করেন বেলজিয়ান তারকা। নিজেদের জয় ও অন্য ম্যাচের ফল পক্ষে আসায় ওই দিনই রেয়ালের লিগ শিরোপা নিশ্চিত হয়ে যায় চার ম্যাচ হাতে রেখে।
লিগে দলের পরের দুই ম্যাচেও পুরোটা সময় খেলেন তিনি, গ্রানাদার বিপক্ষে ৪-০ ও আলাভেসের বিপক্ষে ৫-০ গোলে জেতে রেয়াল। চ্যাম্পিয়ন্স লিগ ফাইনালের প্রস্তুতির জন্য খেলোয়াড়দের ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে খেলাতে লিগে ভিয়ারেয়ালের বিপক্ষে কোর্তোয়াকে বেঞ্চে রেখে আন্দি লুনিনকে খেলান কোচ কার্লো আনচেলত্তি। এবার জাল অক্ষত রাখতে পারেনি রেয়াল। ম্যাচটি ড্র হয় ৪-৪ গোলে। লিগের শেষ রাউন্ডে রেয়াল বেতিসের বিপক্ষে সুযোগ পেয়ে আবার ‘ক্লিন শিট’ রাখেন কোর্তোয়া, ম্যাচ শেষ হয় গোলশূন্য ড্রয়ে।
কাদিস ম্যাচ দিয়ে কোর্তোয়ার ফেরার তিন দিন পরই চ্যাম্পিয়ন্স লিগ সেমি-ফাইনালের ফিরতি লেগে বায়ার্ন মিউনিখের বিপক্ষে খেলে রেয়াল। সেখানে গোলবার সামলান অবশ্য লুনিন, যিনি কোর্তোয়ার অনুপস্থিতিতে হয়ে ওঠেন দলের বড় ভরসা। হারের মুখ থেকে হোসেলুর শেষ দিকের দুই গোলে জিতে ফাইনালে জায়গা করে নেয় রেয়াল।
লুনিন রেয়ালে অনেকটা সময় ধরে মূলত রিজার্ভ গোলকিপার ছিলেন। কোর্তোয়া প্রথম দফা চোটে ছিটকে যাওয়ার পর উদ্বিগ্ন রেয়াল তাই চেলসি থেকে ধারে নিয়ে আসে গোলকিপার কেপা আরিসাবালাগাকে। শুরুতে লুনিন ও কেপাকে ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে খেলাচ্ছিলেন আনচেলত্তি। সেই সুযোগটাই দারুণভাবে কাজে লাগিয়ে দলের প্রথম পছন্দের গোলরক্ষক হয়ে ওঠেন লুনিন। দলের স্প্যানিশ সুপার কাপ, লা লিগা জয়ের পাশাপাশি চ্যাম্পিয়ন্স লিগেও দারুণ নৈপুণ্য দেখান তিনি।
তবে কোর্তোয়া ফেরায় আলোচনা শুরু হয়ে যায়- চ্যাম্পিয়ন্স লিগ ফাইনালে গোলবার সামলাবেন কে। আনচেলত্তি শুরু থেকে বলছিলেন, চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত ফাইনালের আগে নিতে চান তারা। ফাইনালের কয়েক দিন আগে লুনিন ভাইরাসজনিত জ্বরে পড়ে অনুশীলন করতে না পারায় সিদ্ধান্ত নেওয়ার কাজটা সহজ হয়ে যায় কোচের জন্য। কোর্তোয়ার ওপরই ভরসা রাখেন তিনি।
অবশ্য অভিজ্ঞতাও পক্ষে যায় কোর্তোয়ার। ২০২২ সালে রেয়ালের ১৪তম চ্যাম্পিয়ন্স লিগ জয়ের নায়ক ছিলেন তিনি। ফাইনালে লিভারপুলের বিপক্ষে ম্যাচজুড়ে দুর্দান্ত খেলে সেভ করেছিলেন মোট ৯টি। ভিনিসিউস জুনিয়রের একমাত্র গোলে রেয়াল জিতলেও ফাইনালের সেরা হয়েছিলেন কোর্তোয়াই।
একইভাবে তিনি নিজেকে মেলে ধরেন শনিবার ওয়েম্বলির ফাইনালে বরুশিয়া ডর্টমুন্ডের বিপক্ষেও। প্রথমার্ধে জার্মান দলটির আক্রমণের তোড়ে ভেসে যাওয়ার অবস্থা হয়েছিল রেয়ালের। দলকে বারবার রক্ষা করেন কোর্তোয়া। প্রথমার্ধে দারুণ দুটি সেভ করেন তিনি ঝাঁপিয়ে পড়ে। দ্বিতীয়ার্ধে সেভ করেন আরেকটি। এই অর্ধে দানি কারভাহাল ও ভিনিসিউসের গোলে রেয়াল শেষ পর্যন্ত ২-০ গোলে জিতলেও প্রথমার্ধে দলকে ম্যাচে রাখেন মূলত কোর্তোয়াই।
২০১৪ সালে চ্যাম্পিয়ন্স লিগ ফাইনালে রেয়ালের বিপক্ষে আতলেতিকো মাদ্রিদের হয়ে কোর্তোয়া হেরে গিয়েছিলেন। তারপর, রেয়ালের হয়েই এই প্রতিযোগিতায় তিনি জিতলেন দুটি শিরোপা।
এই দুই ফাইনাল মিলিয়ে গোলের জন্য লক্ষ্যে প্রতিপক্ষের শট ছিল ১২টি, সবগুলোই সেভ করেন কোর্তোয়া। হজম করেননি কোনো গোল।
২০২১-২২ মৌসুমে চ্যাম্পিয়ন্স লিগে ১৩ ম্যাচ খেলে ৫টিতে ‘ক্লিন শিট’ রেখেছিলেন তিনি। এবার ইউরোপ সেরার মঞ্চে স্রেফ একটি ম্যাচ খেলেই জাল অক্ষত রাখলেন, সেটিও আবার ফাইনালে।
কোর্তোয়াই ইতিহাসের একমাত্র গোলকিপার, যিনি চ্যাম্পিয়ন্স লিগের কোনো আসরে নিজের একমাত্র ম্যাচে শুরুর একাদশে থাকলেন ফাইনাল দিয়ে।
সব মিলিয়ে এই মৌসুমে পাঁচ ম্যাচে ৪২৩ মিনিট খেলে কোনো গোল হজম করেননি তিনি। সেভ করেছেন মোট ১৯টি। এর মধ্যে ১০টি সেভে প্রতিপক্ষের শট ছিল বক্সের ভেতর থেকে।
চোট কাটিয়ে লম্বা সময় পর মাঠে ফিরে এমন পারফরম্যান্সকে অবিশ্বাস্য বললেও কম হয়ে যায়! প্রশ্নটা তাই উঠেই যায়, এই মুহূর্তে কোর্তোয়াই কি তাহলে বিশ্বের সেরা গোলকিপার?
সেরা নির্বাচন করা সবসময়ই অবশ্য তর্কসাপেক্ষ ব্যাপার।
আসছে ইউরোপিয়ান চ্যাম্পিয়নশিপের বেলজিয়াম দলে অবশ্য রাখা হয়নি কোর্তোয়াকে। বড় টুর্নামেন্টে তিন-চার দিনে একটি করে ম্যাচ খেলার জন্য তার শরীর এখনও যথেষ্ট প্রস্তুত নয় বলে এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
তার অনুপস্থিতিতে রেয়ালের গোলবার যিনি দারুণভাবে সামলেছেন, সেই লুনিনের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানাতে অবশ্য ভুল করেননি ৩২ বছর বয়সী কোর্তোয়া, “সবকিছুর জন্য আন্দ্রি লুনিনকে ধন্যবাদ জানাতে হবে আমাদের।”