ফুটবল ইতিহাসের সেরা খেলোয়াড়দের সংক্ষিপ্ত তালিকায় রাখা হয় জিনেদিন জিদানকে। খেলোয়াড় কিংবা কোচ হিসেবে, সাফল্যে টইটুম্বুর তার ক্যারিয়ার। ফ্রান্সের হয়ে জিতেছেন বিশ্বকাপ, ইউরোপিয়ান চ্যাম্পিয়নশিপ। বর্ণিল ক্লাব ক্যারিয়ারে সেরি আর দল ইউভেন্তুস, স্পেনের সফলতম ক্লাব রিয়াল মাদ্রিদের হয়ে আলো ছড়িয়েছেন। জিতেছেন ভুরিভুরি শিরোপা। চ্যাম্পিয়ন্স লিগের ইতিহাসে প্রথম কোচ হিসেবে টানা তিন শিরোপা এনে দিয়েছেন মাদ্রিদের দলটিকে। এখন আপাতত তিনি ‘বেকার’ সময় পার করছেন।
Published : 23 Jun 2022, 09:30 PM
জীবনের বসন্তে ফরাসি কিংবদন্তি ৫০ বছর পূর্ণ করলেন বৃহস্পতিবার। বিশেষ দিন উপলক্ষে ফরাসি ক্রীড়া দৈনিক লেকিপেকে বিশদ সাক্ষাৎকার দিয়েছেন তিনি। কথা বলেছেন খেলোয়াড়ী জীবন, কোচিং, ভবিষ্যৎসহ অনেক বিষয় নিয়ে।
ইউভেন্তুস থেকে রিয়ালে
দেশের জার্সিতে ও ইউভেন্তুসের হয়ে আলো ছড়িয়ে ততদিনে জিদান পাদপ্রদীপের আলোয়। ইতালিয়ান দলটির হয়ে দুবার চ্যাম্পিয়ন্স লিগের ফাইনালে হারলেও দুটি সেরি আ-সহ জেতেন বেশ কিছু শিরোপা। নতুন চ্যালেঞ্জের খোঁজে ট্রান্সফার ফির বিশ্ব রেকর্ড গড়ে ২০০১ সালে তিনি পাড়ি জমান রিয়ালে। তুলে ধরলেন তার সেই সময়ের অনুভূতি।
“অদ্ভুত অনুভূতি কাজ করছিল। (ট্রান্সফার ফির) অঙ্কটা ছিল প্রায় ৭ কোটি ৭৬ লাখ ইউরো। অবিশ্বাস্য। আমার হাতে বলতে গেলে কোনো বিকল্প ছিল না। ইউভেন্তুস যা চেয়েছিল, তা তাদের অধিকার ছিল। আর অর্থটা দিতে হতো রিয়াল মাদ্রিদকে।“
“আমি সবেমাত্র ২৯ বছরে পা দিয়েছি তখন। আমার কিছুটা অভিজ্ঞতা ছিল। একটা পর্যায়ে আমার ক্যারিয়ার উন্নত করার জন্য আমাকে যেতে হতো। আমি পাঁচ বছর ইউভেন্তুসে ছিলাম, সেখানে চ্যাম্পিয়ন্স লিগ ছাড়া সব জিতেছিলাম। চ্যাম্পিয়ন্স লিগ ফাইনালে আমরা দুইবার হেরেছিলাম। তাই আমার নতুন চ্যালেঞ্জটা দরকার ছিল।”
কাগজের ন্যাপকিনে প্রস্তাব
রিয়াল মাদ্রিদ সভাপতি ফ্লোরেন্তিনো পেরেসের সঙ্গে প্রথম দেখা হওয়ার কথা স্পষ্ট মনে আছে জিদানের। সেটি ঘিরে আছে চমকপ্রদ এক গল্পও, যা মনে পড়লে এখনও হাসি পায় জিদানের।
“অবশ্যই আমার মনে আছে (পেরেসের সঙ্গে প্রথম সাক্ষাৎ)। এটি ছিল মোনাকোতে। প্রথমবার যখন আমাদের দেখা হলো তখনই সবকিছু সারা হয়েছিল। এজন্য দ্বিতীয় বা তৃতীয় কোনো বৈঠক হয়নি। প্রথমবারই সব ঠিক হয়ে গিয়েছিল। ফ্লোরেন্তিনো পেরেস এমন একজন ব্যক্তি, যিনি কখনও গড়মিল করেন না। যখন তিনি বলেন ‘চলো এটা করি’, তখন তিনি তা করেনই। এমনকি একটি ঘটনা আছে, যা আজও আমাকে হাসায়।”
“আমরা মোনাকোতে গালা ডিনারের জন্য বড় একটি টেবিলে ছিলাম। আমরা একে অপরের মুখোমুখি ছিলাম না। আমাকে একটি পুরস্কার গ্রহণের জন্য সেখানে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল। তিনি আমার হাতে একটি ন্যাপকিন দিলেন। ভেতরে লেখা ছিল ‘তুমি কি আসতে চাও?’। এবং আমিও কাগজের ন্যাপকিনের টুকরোতে উত্তর দিলাম, ‘হ্যাঁ’।…সেই থেকেই সব শুরু হয়েছিল। এরপর আমি রিয়ালে পাঁচ বছর খেললাম। এটাই আমার সংখ্যা, যে সংখ্যাটা পরেও আমার ক্যারিয়ারে জড়িয়ে ছিল।“
জিদানের ক্যারিয়ারে ৫ নম্বর সংখ্যাটি জড়িয়ে আছে ওতপ্রোতভাবে। রিয়ালে গিয়ে ৫ নম্বর জার্সি বেছে নেওয়ার কারণ তুলে ধরলেন তিনি।
“ইউভেন্তুসে আমি পাঁচ বছর ছিলাম, রিয়ালেও পাঁচ বছর। যদি কোনো দিন কেউ আমার জীবনে পাঁচ নম্বরের ভূমিকার কথা ভাবে, তাহলে তারা সেটা খুঁজতে পারে, কিছু অবিশ্বাস্য ব্যাপার আছে। যেমন, আমি রিয়াল মাদ্রিদের হয়ে পাঁচটি চ্যাম্পিয়ন্স লিগ জয়ের সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলাম; একবার খেলোয়াড় হিসেবে (২০০২), একবার কার্লোর (আনচেলত্তি) সহকারী হিসেবে (২০১৪), এবং তিনবার প্রধান কোচ হিসেবে (২০১৬, ২০১৭, ২০১৮)।”
“মাদ্রিদে যখন আমি চুক্তিতে সই করি তখন ফ্লোরেন্তিনো পেরেস আমাকে বলেছিলেন, ‘আমার দলে সংখ্যা ১ থেকে ১১ পর্যন্ত। এখানে ৩৫ বা ৪০ নম্বর নেই।’ তিনি বলেছিলেন, ‘কেবল খালি আছে ৫ নম্বর। আমি উত্তর দিয়েছিলাম, ‘কোনো সমস্যা নেই, আমি এটিই নেব।’ সেই ৫ নম্বর আমাকে অনেক কিছু দিয়েছে।”
চ্যাম্পিয়ন্স লিগ ফাইনালে সেই গোল
রিয়ালে প্রথম মৌসুমেই জিদান পান চ্যাম্পিয়ন্স লিগ জয়ের স্বাদ। ২০০২ সালে গ্লাসগোর হ্যাম্পডেন পার্কে সেই ফাইনালের নায়ক ছিলেন তিনিই। বায়ার লেভারকুজেনের বিপক্ষে রাউলের গোলে অষ্টম মিনিটে এগিয়ে যায় রিয়াল। ত্রয়োদশ মিনিটেই সেটি শোধ দিয়ে দেয় জার্মান ক্লাবটি। প্রথমার্ধের শেষ মিনিটে জিদানের করা গোল শেষ পর্যন্ত গড়ে দেয় ব্যবধান। স্মরণ করলেন সেই গোলের কথা।
"সবচেয়ে সুন্দর মুহূর্ত, আমি জানি না, আমি জানি না। আমারও তাই মনে হয়। কিন্তু সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ একটি, হ্যাঁ। আমার প্রথম চ্যাম্পিয়ন্স লিগ জেতার জন্য গোলটা দরকার ছিল। বড় ফাইনালে মাদ্রিদের হয়ে আমার ফল নির্ধারক হতেও গোলটা দরকার ছিল। ফরাসি জাতীয় দলের হয়ে আমি এটা করে দেখিয়েছি, ইউভেন্তুসের হয়ে অন্যান্য ট্রফির জন্য করেছি, রিয়ালের হয়ে আমার প্রথম মৌসুমে গোল করা দরকার ছিল। গোলটি করার পর স্বস্তি পাচ্ছিলাম। ওটা জেতার আগে আমি তিনটি ইউরোপিয়ান ফাইনালে হেরেছিলাম। বোর্দোর হয়ে একবার উয়েফা কাপে (১৯৯৬ সালে বায়ার্ন মিউনিখের বিপক্ষে দুই লেগের ফাইনালে ২-০ ও ৩-১ গোলে হার) এবং ইউভেন্তুসের হয়ে দুটি চ্যাম্পিয়ন্স লিগে।”
“সেটা ছিল চতুর্থ ফাইনাল, আমি ওটাকে আর হাত ফসকে যেতে দিতে পারতাম না। গোলটির আক্রমণের শুরু হয়েছিল রবের্তো কার্লোসের ক্রস থেকে...জঘন্য! তবে শেষ পর্যন্ত, তার সেই ক্রসটা সুন্দরই ছিল। আমরা একসঙ্গে অনেকবার এটা নিয়ে কথা বলেছি। সবাই তাকে বলল: ‘কী বাজে ক্রসটাই না তুমি দিলে! সে হেসে বলল: ‘এটি আমার দেওয়া সেরা ক্রস! ফলাফল দেখো...আমি যদি তোমাকে সেই পাস না দিতাম, চমৎকার গোলটি তুমি করতে পারতে না।’ সে ঠিক বলেছিল।”
খেলোয়াড় ও কোচ হিসেবে চ্যাম্পিয়ন্স লিগ জয়ের পার্থক্য
একটি চ্যাম্পিয়ন্স লিগ শিরোপা ছাড়া ক্যারিয়ার শেষ হয়ে গেছে অনেক গ্রেট ফুটবলারের। সেখানে জিদান খেলোয়াড় হিসেবে একবার তো এটি জিতেছেনই, কোচ হিসেবে জিতেছেন টানা তিন মৌসুমে। দুইয়ের মধ্যে পার্থক্য তিনি দেখেন অনেক।
“অনুভূতিটা ভিন্ন। তবে দুটিই সুন্দর। একজন কোচ হিসেবে আপনি ২৫ জন খেলোয়াড়ের জন্য দায়বদ্ধ। শুধু তাই নয়, একটি ক্লাবের জন্য, রিয়াল মাদ্রিদের মতো একটি নামের জন্য এবং একটি প্রতিষ্ঠানের জন্য দায়বদ্ধ। এটির ওজন অনেক, একজন খেলোয়াড়ের কাঁধে একইরকম ভার থাকে না। এই শিরোপা জিতলে এবং সেটা পরপর তিনবার হলে, পুরো ক্লাবের জন্য সব দায়িত্ব পালন করার অনুভূতি কাজ করবে। চ্যাম্পিয়ন্স লিগ জেতা কখনোই ভাগ্যের বিষয় নয়। এটা কঠিন কাজ। বিশেষ করে পরপর তিনবার। আমি পাগলের মতো কাজ করেছিলাম। আমরা সবাই কঠোর পরিশ্রম করেছিলাম। আমার খেলোয়াড়রা আমাকে বিশ্বাস করেছিল এবং আমি তাদের বিশ্বাস করেছিলাম। আমরা একসঙ্গে চেষ্টা করেছিলাম। আমার স্টাফদের সঙ্গে অনেক পরিশ্রমের ফল ছিল ওই সাফল্য।”
“একজন খেলোয়াড় হিসেবে জেতা একইরকম বিষয় নয়। খেলোয়াড় হিসেবে আমি সকাল ৯টায় অনুশীলনে যেতাম। দুপুর ১টায় শেষ করে বাড়ি ফিরতাম। আর একজন কোচ হিসেবে আমি সকাল ৮টায় যেতাম এবং প্রায়ই রাত ১১টা পর্যন্ত থাকতাম। বিষয়গুলো একইরকম চাপের নয়। কোচ হিসেবে কাজটা কেবল নিজের জন্য নয় এবং এটা কখনও শেষও হয় না। কখনও কখনও এমন হতো যে আমি বাড়িতে আছি কিন্তু আমার ভাবনা তখনও স্টেডিয়ামেই রয়ে গেছে। তখন আমি পরের দিন অনুশীলনের কথা ভাবতাম, একজন খেলোয়াড়কে আমার কী বলতে হবে।”
ভক্ত-সমর্থকদের কাছে জিজু নামেই বেশি পরিচিত জিদান। কীভাবে এলো এই নাম?
“(জিদানের প্রথম ক্লাব) কান-এ (কোচ) হলোঁ কোহবি আমাকে এই নামে ডাকতে শুরু করেছিলেন। প্রথমে, সংবাদমাধ্যমে আমাকে ইয়াজিদ, তারপর জিনেদিন এবং অবশেষে জিদান নামে ডাকা হয়, এভাবেই আমার নামকরণ হয়েছিল।”
ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা
জিদানের ইচ্ছা আপাতত কোচিং চালিয়ে যাওয়া। এরপর আরেকটি পরিকল্পনা আছে তার। সেটিও তুলে ধরলেন ১৯৯৮ সালের ব্যালন ডি’অর জয়ী।
“কোচিং চালিয়ে যেতে চাই। এখনও আমি এটি করতে চাই। এরপর কেন এমন একটি প্রকল্পে থাকব না যেখানে আমিই হবো নেতা...উদাহরণস্বরূপ একটি ক্লাবের প্রেসিডেন্ট বা একটি কোম্পানির ম্যানেজার। আমি ইতোমধ্যে জেড৫ গ্রুপের সঙ্গে কাজ শুরু করেছি, যেটি আমরা একটি পরিবার হিসেবে শুরু করেছি, আমার ভাই ফরিদ, নর্দিন, জেমস এবং আমার বোন লীলার সঙ্গে। কিন্তু আমরা এখনও সেই পর্যায়ে পৌঁছাইনি। আমি আমার পছন্দের মানুষদের সঙ্গে একটি প্রকল্প করতে চাই, যারা যোগ্য এবং বিশ্বস্ত।”
পিএসজির কোচ হওয়ার সম্ভাবনা নিয়ে
কদিন আগে ফুটবল বিশ্বে রটে গিয়েছিল, পিএসজির কোচের দায়িত্ব নিচ্ছেন জিদান। পরে আবার খবর ছড়ায়, জিদান প্রত্যাখ্যান করেছেন প্রস্তাব। ফরাসি দৈনিক লো পারিজিয়াকে গত মঙ্গলবার দেওয়া সাক্ষাৎকারে পিএসজির সভাপতি নাসের আল-খেলাইফি অবশ্য দাবি করেন, জিদানের সঙ্গে কোনো কথাই হয়নি তাদের। যদিও ফরাসি সংবাদমাধ্যমের খবর, তাদের মধ্যে যোগাযোগ হয়েছে। পিএসজিকে কোচিং করানোর সম্ভাবনা নিয়ে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল জিদানকে।
“কখনোই একেবারে না বলে দেওয়া যায় না, বিশেষ করে একজন কোচ হিসেবে। যখন আমি খেলোয়াড় ছিলাম, আমার পছন্দ ছিল প্রায় প্রতিটি ক্লাব। একজন কোচ হিসেবে পঞ্চাশটি ক্লাব নেই, যেখানে আমি যেতে পারি। দুই বা তিনটির সম্ভাবনা আছে।”
চোখ জাতীয় দলের কোচিংয়ে
ফ্রান্সকে ১৯৯৮ বিশ্বকাপ জেতানো জিদানের ইচ্ছা, একদিন ফ্রান্স জাতীয় দলের কোচ হওয়া, একটা চক্র পূরণ করার।
“(ফ্রান্স দল) লে ব্লু’দের সঙ্গে আমার কাজ শেষ হয়নি। আমি অবশ্যই এটা করতে চাই। আশা করি, আমি (ফ্রান্স কোচ) হবো, কোনো একদিন। কখন? এটা আমার ওপর নেই।”
“তবে আমি ফরাসি জাতীয় দলের হয়ে চক্র পূরণ করতে চাই। আমি খেলোয়াড় হিসেবে এই ফরাসি দলের সঙ্গে থেকেছি। আমার জীবনে যেটা সবচেয়ে সেরা ঘটনা!”