আক্রমণভাগে নয়, মাঠে মঈনুল ইসলাম মঈনের মূল দায়িত্ব প্লেমেকারের ভূমিকায়। তবে তিনি শুধু দলের আক্রমণ গড়ে দেওয়ায় নয়, গোল করাতেও দারুণ পারদর্শী। বাংলাদেশ চ্যাম্পিয়নশিপ লিগে তার সাবেক দলের ভরাডুবি হলেও তিনি সেখানে আপন আলোয় উজ্জ্বল; ১৮ গোল করে টুর্নামেন্টের সর্বোচ্চ গোলদাতা। নজর কেড়ে যোগ দিয়েছেন মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাবে। ঐতিহ্যবাহী ক্লাবটির জার্সিতে এবার প্রিমিয়ার লিগে আলো ছড়াতে মুখিয়ে আছেন ১৭ বছর বয়সী অ্যাটাকিং মিডফিল্ডার।
Published : 14 Jun 2022, 10:24 PM
বড় মঞ্চে খেলার রোমাঞ্চ নিয়ে দিন গুণছেন মঈন। বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের সঙ্গে আলাপচারিতায় বললেন সেই স্বপ্নের কথা।
সম্ভাবনাময় অ্যাটাকিং মিডফিল্ডার
বয়সভিত্তিক ফুটবলে খেলা অবস্থায় গত বছর পেশাদার ফুটবল লিগের দ্বিতীয় স্তর চ্যাম্পিয়নশিপ লিগে নাম লেখান মঈন। তাকে দলে ভেড়ায় উত্তরা এফসি। মিডফিল্ড পজিশনে খেলে ওই আসরে দুটি গোলও করেন তিনি।
“এবার শুরু থেকেই লক্ষ্য ছিল ভালো কিছু করব। ভালো পারফরম্যান্স দেখাব, (প্রিমিয়ার লিগের)ে লিগের কোনো দলে সুযোগ পাব- এ রকম উদ্দেশ্য নিয়ে শুরু করেছিলাম। আমার সতীর্থরা যেভাবে সাহায্য করেছে, এজন্যই আমি সহজভাবে এতোগুলো গোল করতে পেরেছি। গোল করতে সবাই আমাকে খুব সাহায্য করেছে।”
“ইচ্ছে ছিল প্রতি ম্যাচে গোল থাকতে হবে। যখনই সুযোগ আসবে কাজে লাগাব। মিস হবে, কিন্তু সমস্যা নেই। আবার সুযোগ আসবে, সেটা কাজে লাগাব। মনের মধ্যে গোলের এই ক্ষুধা কাজ করত। এ জন্যই আল্লাহর রহমতে গোলগুলো পেয়েছি।”
সদ্য শেষ হওয়া চ্যাম্পিয়নশিপ লিগে উত্তরা ফুটবল ক্লাবের হয়ে ২১ ম্যাচে ১৮ গোল করে লক্ষ্য পূরণ করেছেন মঈন। যদিও দলীয় লক্ষ্য পূরণ হয়নি, বিসিএলে উত্তরা সপ্তম হওয়ায় স্বাভাবিকভাবেই হতাশ তিনি।
“এই ফলাফলে আমরা খুশি না। প্রথম লেগে আমরা দ্বিতীয় অবস্থানে ছিলাম। পরে সেটা আমরা ধরে রাখতে পারিনি। (মধ্যবর্তী দলবদলে) কিছু সিনিয়র খেলোয়াড় নিলে হয়তো ভালো হতো।”
“অন্য সব দলই খেলোয়াড় চেঞ্জ করেছে। তবে আমাদের দলে অফিসিয়ালরা আমাদের ওপরই ভরসা রেখেছিলেন। কিন্তু আমরা সেই প্রত্যাশা অনুযায়ী রেজাল্ট দিতে পারেনি। এটা নিয়ে অবশ্যই খারাপ লাগা আছে। আমাদের টার্গেট ছিল দ্বিতীয় বা তৃতীয় হওয়া।”
চ্যাম্পিয়নশিপ লিগে পাওয়া ব্যক্তিগত সাফল্যের স্রোতে ভেসে যেতে চান না মঈন। তার বরং মনে হচ্ছে, সামনের পথটা বড্ড কঠিন।
“চ্যাম্পিয়নশিপ লিগে সর্বোচ্চ গোলদাতা হওয়া আমার কাছে বড় কোনো সাফল্য নয়। আসলে সফল হতে হবে বিপিএল ও জাতীয় দলে। এটা তাই আমার জন্য কিছু না।”
আসছে এএফসি অনূর্ধ্ব-২০ ফুটবলের বাছাইয়ের জন্যও ক্যাম্পে রয়েছেন মঈন। বয়সভিত্তিক দলের গণ্ডি পেরিয়ে এখন সিনিয়র জাতীয় দলে খেলার স্বপ্ন উঁকি দিচ্ছে তার মনে। আর এ জন্য মোহামেডানের হয়ে প্রিমিয়ার লিগের মঞ্চে প্রমাণ দিতে চান নিজেকে।
“অবশ্যই লক্ষ্য থাকবে এখান (মোহামেডান) থেকে জাতীয় দলে ডাক পাওয়া। চ্যাম্পিয়নশিপ লিগ ও প্রিমিয়ার লিগের মধ্যে অবশ্যই অনেক পার্থক্য। এখানে জাতীয় দলের খেলোয়াড় ও অনেক ভালো মানের বিদেশি খেলোয়াড় খেলে। এখানে অনেক যুদ্ধ করে আমাকে দলে সুযোগ পেতে হবে।”
জাতীয় দলে গোল খরা অনেক দিন ধরেই বড় সমস্যা। মঈন স্বপ্ন দেখেন একদিন এই সমস্যা মেটাতে পারবেন তিনি।
“ফুটবলে আসার পর থেকেই দেখছি, জাতীয় দলে গোল করার লোকের অভাব। এজন্য নিজেকে সেভাবেই তৈরি করছি। আল্লাহ যদি জাতীয় দলে নেয়, তাহলে যেন ওই ঘাটতিটা না থাকে। সবাই যদি এভাবে নিজেকে তৈরি করে তাহলে এর ঘাটতি থাকবে না আশা করি।”
“আমি নিজেকে বাংলাদেশের সর্বোচ্চ পর্যায়ে দেখতে চাই এবং বাংলাদেশ জাতীয় দলে খেলে দেশের জন্য কিছু করতে চাই। বাংলাদেশ যেন এতো পিছিয়ে না থাকে, সবাই মিলে আরও সামনের দিকে নিয়ে যেতে চাই দেশকে।”
জাতীয় দলে এখন বরিশাল থেকে খেলছেন রাকিব হোসেন। দেশি ফুটবলারদের মধ্যে মঈনের পছন্দের ফুটবলার তিনি। বিদেশিদের মধ্যে তার পছন্দ ম্যানচেস্টার সিটির বেলজিয়ান তারকা কেভিন ডে ব্রুইনে।
“বাংলাদেশে আমার প্রিয় খেলোয়াড় রাকিব ভাই। আর বিদেশে কেভিন ডে ব্রুইনে। ও যে পজিশনটায় খেলে, আমিও সেই পজিশনে খেলি। সব সময় দেখি ও গোল করে এবং করায়। দলের জন্য খুবই কার্যকরী। অন্যান্য খেলোয়াড়দের চেয়ে অনেক বেশি এফোর্ড দেয়। এ জন্য ওর খেলাটা আমার ভালো লাগে।”
মঈনের জন্ম ২০০৫ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি, বরিশালের মুলাদীতে। বাবা ব্যবসায়ী। মা গৃহিণী। দুই ভাই এক বোনের মধ্যে বড় মঈন এ বছরই এইচএসসি পাশ করেছেন। পরিবারের কেউ খেলাধুলার সঙ্গে জড়িত না থাকলেও তাদের কাছ থেকে অনুপ্রেরণা পেয়েছেন মঈন। ফুটবলে হাতেখড়ি মুলাদী ফুটবল একাডেমিতে। স্কুল পর্যায় ও স্থানীয় বিভিন্ন টুর্নামেন্টে খেলতে খেলতেই সুযোগ পেয়ে যান অনূর্ধ্ব-১৫ জাতীয় দলের ক্যাম্পে।
“ফুটবল ছোটবেলা থেকেই ভালো লাগত। পড়ালেখার পাশাপাশি মুলাদী একাডেমিতে খেলা দেখতে যেতাম। সেখানে যেতে যেতেই ফুটবলের প্রতি আকর্ষণ তৈরি হয়, প্র্যাকটিস করার ইচ্ছে জাগে।”
“আমার কোচ জিয়াউল আহসান খান ছোট থেকেই গাইড করেছেন। উনার কাছ থেকে অনেক কিছু শিখেছি। এভাবেই শুরু। স্কুল টুর্নামেন্ট খেলেছি। সেখান থেকে বয়সভিত্তিক দলের ক্যাম্পে আসার জন্য ডেভেলপমেন্ট কাপের ক্যাম্প করেছিলাম। সেখান থেকে ট্রায়ালে পাঠানো হলে আমি টিকে যাই।”
২০১৮ সালে নেপালে হওয়া অনূর্ধ্ব-১৫ সাফ চ্যাম্পিয়নশিপে শিরোপা জেতে বাংলাদেশ। সেই দলের অংশ ছিলেন মঈন। যদিও ওই আসরে কোনো ম্যাচ খেলার সুযোগ পাননি। এ নিয়ে জেদ ছিল মনে। নিজেকে চেনানোর তাড়না থেকে ২০১৯ সালে ঘরের মাঠে হওয়া উয়েফা এএফসির আয়োজনে চার জাতি অনূর্ধ্ব-১৬ টুর্নামেন্টে হন সর্বোচ্চ গোলদাতা।
পরের বছর বঙ্গবন্ধু গোল্ডকাপ অনূর্ধ্ব-১৭ টুর্নামেন্টে দারুণ পারফরম্যান্স করেন। বরিশাল দলের হয়ে খেলে জিতে নেন সেরা খেলোয়াড়ের পুরস্কার। কাতারে এএফসি অনূর্ধ্ব-১৬ ফুটবলের বাছাইয়ে খেলেন। খেলেন থাইল্যান্ডে আরও একটি বয়সভিত্তিক টুর্নামেন্টে। ২০২০ সালে ক্লিয়ার ম্যানের আয়োজনে অনূর্ধ্ব-১৭ স্কুল ফুটবলে আলো কেড়ে ম্যানচেস্টার সিটিতে অনুশীলনের সুযোগও মেলে। তবে করোনাভাইরাসের কারণে আর যাওয়া হয়নি। কিন্তু স্বপ্ন পূরণের পথে ছুটে চলা থেমে থাকেনি মঈনের।
চ্যাম্পিয়নশিপ লিগে বাজিমাত করে সেটা দেখিয়েও দিলেন তিনি। এবার চ্যালেঞ্জ আরও বড়, কঠিন। তবে মঈন আত্মবিশ্বাসী। শোনালেন সামর্থ্যের সবটুকু দিয়ে চ্যালেঞ্জ জয়ের প্রত্যয়।