যুক্তরাষ্ট্রের ট্রফি-খরার অবসান হলো না এবারও, ফাইনালে টেইলর ফ্রিটসকে উড়িয়ে প্রথম ইতালিয়ান হিসেবে ইউএস ওপেন জিতলেন ইয়ানিক সিনার।
Published : 09 Sep 2024, 09:46 AM
দর্শকে ঠাসা গ্যালারি ম্যাচজুড়ে তুমুল সমর্থন দিয়ে গেল ঘরের ছেলে টেইলর ফ্রিটসকে। পপ মেগাস্টার টেইলর সুইফট গলা ফাটালেন, রক তারকা জন বন জোভি উৎসাহ জোগালেন। কিন্তু ফ্রিটসের প্রতিপক্ষ যে এ দিন ছিলেন অদম্য! ম্যাচজুড়ে অসাধারণ টেনিসের প্রদর্শনীতে আর্থার অ্যাশ স্টেডিয়ামের গ্যালারিকে হতাশ করে, গোটা যুক্তরাষ্ট্রের আশা পিষ্ট করে ইউএস ওপেনের শিরোপা জিতলেন ইয়ানিক সিনার।
টুর্নামেন্টজুড়ে দারুণ পারফর্ম করে আসা সিনার সেরাটা জমা রেখেছিলেন যেন ফাইনালের জন্যই। ফ্রিটসকে তিনি সেভাবে দাঁড়াতেই দেননি। প্রবল সমর্থন পাওয়া ঘরের ছেলেকে হারিয়ে দেন তিনি ৬-৩, ৬-৪, ৭-৫ গেমে। তার নাম খোদাই হয়ে যায় ইতিহাসেও।
ইউএস ওপেন জয় করা প্রথম ইতালিয়ান সিনারই। আরেকটি অনন্য কীর্তিও তিনি গড়েছেন, যেখানে তিনি ছাড়িয়ে গেছেন নিজ দেশের সীমানা। একই বছরে হার্ড কোর্টের দুটি গ্র্যান্ড স্ল্যামজয়ী সর্বকনিষ্ঠ খেলোয়াড় এখন ২৩ বছর বয়সী এই তারকাই। বছরের শুরুতে অস্ট্রেলিয়ান ওপেনও জিতেছিলেন তিনি।
ম্যাচ শেষ হতেই দু হাত উঁচিয়ে চোখ বন্ধ করে আকাশের দিকে মাথা উঁচু করে কিছুক্ষণ থাকেন সিনার। খুব খ্যাপাটে কিংবা বাঁধনহারা উদযাপন দেখা যায়নি। গ্যালারিতে গিয়ে সাপোর্ট স্টাফের সবাইকে আলিঙ্গনে জড়িয়ে অবশ্য উপভাগ করেন মুহূর্তটি। তার সঙ্গিনী রুশ টেনিস তারকা আনা কালিনস্কেয়ার ঠোঁটে এঁকে দেন চুম্বনচিহ্ন। গোটা স্টেডিয়াম তখন তাকে অভিবাদন জানায়, ‘ব্রাভো… ব্রাভো…’ গর্জনে।
ফ্রিটস তখন কোর্টের পাশে চেয়ারে বসে হতাশায় ভেঙে পেছন মাথা হাত দিয়ে। তার হারে আরও দীর্ঘায়িত হলো যুক্তরাষ্ট্রের অপেক্ষাও। সেই ২০০৩ সালে অ্যান্ডি রডিকের ইউএস ওপেন জয়ের পর আর কোনো গ্র্যান্ড স্ল্যাম জিততে পারেননি যুক্তরাষ্ট্রের কোনো পুরুষ খেলোয়াড়। হলো না এবারও।
মেয়েদের ফাইনালে আরিনা সাবালেঙ্কার কাছে জেসিকা পেগুলার হারের পর ছেলেদের ফাইনালে ফ্রিটসের এই পরাজয়ে ইউএস ওপেনের শেষটা যুক্তরাষ্ট্রের জন্য হলো হতাশাময়।
সিনার ফাইনালে নেমেছিলেন ফেভারিট হিসেবেই। র্যাঙ্কিংয়ের এক নম্বর তারকা তিনি। তবে ফাইনালে ফ্রিটসের পাশাপাশি তার প্রবল প্রতিপক্ষ ছিল গ্যালারিও। গ্র্যান্ড স্ল্যামে যুক্তরাষ্ট্রের ছেলেদের ২১ বছরের ট্রফি খরা অবসানের আশায় ভিড় করেছিলেন আমেরিকান সমর্থকেরা। তারা ঝলমলে গ্যালারিতে ছিলেন যুক্তরাষ্ট্রের সবশেষ গ্র্যান্ড স্ল্যাম জয়ী পুরুষ তারকা অ্যান্ডি রডিক থেকে শুরু করে ক্রীড়া, টিভি, সিনেমা, সঙ্গীতসহ নানা আঙিনার তারকারা। কিন্তু সিনারের পেশাদারিত্বের সামনে টিকতে পারেননি ফ্রিটস। ম্যাচ শেষে সেই দর্শকেরাই তুমুল করতালি আর বারবার ‘ব্রাভো ব্রাভো’ চিৎকারে সম্মান জানায় বিজয়ী নায়ক সিনারকে।
বরাবরই দুর্দান্ত সার্ভ, কোর্টের গতিময় বিচরণ আর রকেট-গতির ফোরহ্যান্ডের জন্য পরিচিত সিনার। ফাইনাল তিনি বেইজলাইনে দারুণ শক্তিশালী পারফরম্যান্সও মেলে ধরেন। প্রথম গেমেই ‘আনফোর্সড এরর’ করা ফ্রিটস পরে চষ্টা করেছিলেন ঘুরে দাঁড়াতে। কিন্তু সিনারের দাপটের সামনে টিকতে পারেননি।
বছরের শুরুতে অস্ট্রেলিয়ান ওপেন জিতে ক্যারিয়ারের প্রথম গ্র্যান্ড স্ল্যাম জয় করা সিনার পরে জিতে নেন মায়ামি ওপেনও। কিন্তু এর পরের সময়টায় বেশ ভুগেছেন নিতম্বের চোটে। অসুস্থতার জন্য নিজেকে সরিয়ে নেন তিনি প্যারিস অলিম্পিকস থেকেও। চোট কাটিয়ে ফেরার পর ইউএস ওপেনের প্রস্তুতিমূলক টুর্নামেন্ট বলে বিবেচিত সিনসিনাটি ওপেন জিতে ইঙ্গিত দেন ছন্দে ফেরার।
কিন্তু ইউএস ওপেনের আগে আবার বড় ধাক্কা আসে তার জন্য। দুই দফা ডোপ টেস্টে উতরাতে ব্যর্থ হওয়ার পুরোনো খবর প্রকাশ্যে বেরিয়ে আসে। এই টুর্নামেন্টে তার খেলা নিয়েও অনিশ্চয়তা তৈরি হয়। পরে অবশ্য সেই দায় থেকে মুক্তি পান তিনি। তবে মানসিক শক্তির চরম পরীক্ষা দিতে হয় তাকে এই ঘটনায় তুমুল আলোচনা-সমালোচনার মধ্যে।
টুর্নামেন্টের ট্রফি নিয়ে সংবাদ সম্মেলনে বসে সিনার বললেন, অনুশীলনের পাশাপাশি মানসিক শক্তির জোরেই তিনি শিরোপার স্বাদ পেয়েছেন। কৃতিত্ব দিলেন তিনি সাপোর্ট স্টাফের সবাইকে।
“প্রতিটি দিন আমরা চেষ্টা করেছি, ভালো করে অনুশীলন করেছি, এমনকি ছুটির দিনগুলিতেও… নিজেদের ওপর ভরসা রেখেছি, সবচেয়ে জরুরি যেটা। উপলব্ধি করতে পেরেছি, বিশেষ করে এই টুর্নামেন্টে যে, এই খেলায় মানসিক দিকটা কতটা গুরুত্বপূর্ণ।”
“আমার জন্য এই শিরোপা অনেক বড় কিছু, কারণ আমার ক্যারিয়ারের সবশেষ কিছু দিন খুব সহজ ছিল না। এই টুর্নামেন্টের আগের সময়টাও খুব ভালো ছিল না। কিন্তু এখানে এসে প্রতিটি ম্যাচের পর মনে হয়েছে যেন আরও পোক্ত হয়েছি। আত্মবিশ্বাসও ক্রমে বেড়েছে প্রতি দিন।”
উল্টো প্রান্তে ছিলেন ফ্রিটস। ম্যাচ শেষে আক্ষেপে পুড়ছিলেন তিনি। এবারের আগে চার দফায় বিভিন্ন গ্র্যান্ড স্ল্যামের কোয়ার্টার-ফাইনালে আটকে যাওয়ার পর এই প্রথম সেমি-ফাইনালে উঠে পরে ফাইনালের মঞ্চেও পা রাখেন। তাকে দিয়ে দীর্ঘ ট্রফি খরার অবসান হওয়ার স্বপ্ন দেখছিল যুক্তরাষ্ট্র। দেশের আশা পূরণ করতে না পারার আক্ষেপ প্রবলভাবেই ফুটে উঠল ২৬ বছর বয়সী খেলোয়াড়ের কণ্ঠে। পাশাপাশি অবশ্য নতুন শুরুর প্রত্যয়ও শোনালেন তিনি।
“এই মুহূর্তে অনেক কিছু নিয়েই আমি খুব হতাশ… কোর্টে যা কিছু করেছি, যেভাবে খেলেছি, কিছু শট যেভাবে মেরেছি… খুবই বাজে। আমি জানি, আমরা গোটা দেশ অনেক বছর ধরে অপেক্ষা করছি একজন চ্যাম্পিয়নকে পাওয়ার জন্য। আমেরিকান সমর্থকেরা অপেক্ষা করছে লম্বা সময় ধরে।”
“আমি জানি না… নিজের খেলায় খুবই বিপর্যস্ত আমি… মনে হচ্ছে যেন, জানি না আসলে… অনেক মানুষেরই মন ভেঙে দিয়েছি…। দুঃখিত, এবার আমি পারলাম না। তবে কষ্ট করে যাব এবং আশা করি, পরের বার পারব।”
ম্যাচ শেষে ট্রফি তুলে দেন দুটি ইউএস ওপেনসহ আটটি গ্র্যান্ড স্ল্যামজয়ী মার্কিন তারকা আন্দ্রে আগাসি। চ্যাম্পিয়ন সিনারের প্রাইজমানি ৩৬ লাখ ডলার, রানার্স আপ ফ্রিটসের প্রাপ্তি ১৮ লাখ ডলার।