চ্যাম্পিয়ন্স লিগ
সাম্প্রতিক ফর্মের নিক্তিতে, ইতিহাস-ঐতিহ্যের বিবেচনায় রেয়াল মাদ্রিদ এগিয়ে থাকলেও মরণ কামড় দিতে প্রস্তুত বায়ার্ন মিউনিখও।
Published : 07 May 2024, 08:07 PM
পারফরম্যান্সের আয়নায় কিংবা মুখোমুখি লড়াইয়ের ইতিহাসে ভর করে অনেকেই রেয়াল মাদ্রিদের গায়ে সেঁটে দিচ্ছে ফেভারিটের তকমা। কিন্তু দলগত শক্তির বিচারে, ইতিহাস, ঐতিহ্যের নিক্তিতে বায়ার্ন মিউনিখকে কি এতটুকু পিছিয়ে রাখার জো আছে? তাছাড়া চ্যাম্পিয়ন্স লিগের এতবড় মঞ্চে হাতছানি যখন ফাইনালেওঠার, কোনো দলের সামনেই যখন নেই জয়ের বিকল্প, সামান্য পা হড়কালেই যেখানে ঘটে যাবে মহাবিপদ, বেজে যাবে বিদায়ঘণ্টা, সেখানে ইতিহাস তো দূর, এক দিনের পুরোনো হিসেব-নিকেশও আসলে মূল্যহীন; মূখ্য কেবল বর্তমান। গুরুত্বপূর্ণ নির্দিষ্ট দিনের লড়াই।
মাঠে নেমে স্নায়ু চাপকে যে জয় করতে পারবে, পরিকল্পনার যথাযথ বাস্তবায়ন যারা করতে পারবে, সুযোগগুলো কাজে লাগাতে পারবে, তারাই করবে বাজিমাত। সেই প্রয়াসেই সেমি-ফাইনালের ফিরতি লেগে সান্তিয়াগো বের্নাবেউয়ে মুখোমুখি হতে যাচ্ছে দুই দল। হাইভোল্টেজ ম্যাচটি শুরু হবে বাংলাদেশ সময় বুধবার রাত একটায়।
লড়াইটা যখন ইউরোপের দুই ফুটবল পরাশক্তির, তখন আলোচনায় কত কিছুই না উঁকি দেয়। হ্যাঁ, এটা ঠিক যে, চলতি মৌসুমে বায়ার্ন একেবারেই ছন্দহীন। অচেনা। এ বছরে তাদের পারফরম্যান্স আরও যাচ্ছেতাই; বুন্ডেসলিগায় গত তিন মাসে যেমন পাঁচটি ম্যাচ হেরেছে তারা। মাঝে চ্যাম্পিয়ন্স লিগের শেষ ষোলোয়ও হেরেছিল লাৎসিওর মাঠে। ফিরতি লেগে ঘুরে দাঁড়ানো জয়ে দলটির আত্মবিশ্বাস জোড়া লেগেছে বটে, কিন্তু আগের হারের ক্ষত কিছুটা রয়ে গেছে ঠিকই।
তাছাড়া এইতো তিন দিন আগে লিগে সবশেষ ম্যাচে যেমন, আউক্সবুর্কের বিপক্ষে প্রথমে পিছিয়ে পড়ে দ্রুতই ঘুরে দাঁড়ায় বায়ার্ন; কিন্তু শেষ দিকে খেই হারিয়ে ১০ মিনিটে দুই গোল হজম করে হেরে বসে প্রতিযোগিতার রেকর্ড চ্যাম্পিয়নরা। উন্মোচিত হয়ে পড়ে বায়ার্নের দূর্গের দুর্বলতা। যেখানে আঘাত হানতে রেয়ালের পারদর্শিতা, সক্ষমতা প্রশ্নাতীত।
তবে, এত এত ব্যর্থতার মাঝেও ভুলে গেলে চলবে না যে, বায়ার্ন বুন্ডেসলিগায় গত ১১ মৌসুমের চ্যাম্পিয়ন। গত এক যুগে দুবার ইউরোপ সেরার মুকুট পরার স্মৃতিও আছে। ‘বাভারিয়ান’দের তাই হেলাফেলা করার সুযোগ কোথায়? বুন্ডেসলিগা, জার্মান কাপ-এই মৌসুম সব সুযোগ হারানো বায়ার্ন তাই মরণ কামড় দিতে প্রস্তুত।
সাম্প্রতিক পারফরম্যান্সের বিচারে রেয়াল দুর্বার। বায়ার্নের মতো পিছুটান নেই একটুও। দুর্দান্ত ছন্দে এগিয়ে চলেছে তারা। পুরো মৌসুমে হার মাত্র দুটি। দুটিই নগর প্রতিদ্বন্দ্বী আতলেতিকো মাদ্রিদের বিপক্ষে, লা লিগায় ও কোপা দেল রে’তে। চার ম্যাচ বাকি থাকতে লিগ শিরোপাজয়ও নিশ্চিত হয়ে গেছে। এখন তাদের ভাবনার ভরকেন্দ্রে কেবলই চ্যাম্পিয়ন্স লিগ।
যে প্রতিযোগিতাটি রেয়ালের সবচেয়ে প্রিয়, যেখানে লেখা রেকর্ড ১৪ বার শিরোপা জয়ের অবিশ্বাস্য গল্প, রেকর্ড ১৭ বার ফাইনাল খেলার উপাখ্যান- এই সব রেকর্ড সংখ্যাকে আরেক ধাপ বাড়িয়ে নেওয়াই এখন দলটির ধ্যান-জ্ঞান জুড়ে।
বায়ার্নের সঙ্গে মুখোমুখি লড়াইয়ে জয়ের পাল্লাও কিছুটা হেলে রেয়ালের দিকে, যা একটু হলেও দলটির আত্মবিশ্বাসের পালে বাড়তি হাওয়া দিতে পারে। একক ম্যাচ হিসেবে মোট ২৭ বার দেখা হয়েছে তাদের, যার ১২টি জিতেছে রেয়াল, ১১টি জয় বায়ার্নের, বাকি চারটি ড্র।
গত এক দশকের মুখোমুখি লড়াইয়ের হিসেবে তো একচেটিয়া এগিয়ে রেয়াল; এবারের আগে নকআউট পর্বে তিনবার দেখা হয়েছে দল দুটির, প্রতিবারই জয়ী মাদ্রিদের দলটি। আর একক ম্যাচ হিসেবে ওই তিনবারের ছয় ম্যাচে পাঁচটিতেই জয়ী তারা, অন্যটি ড্র।
ঘরের মাঠে বায়ার্নের বিপক্ষে স্পেনের সফলতম ক্লাবটির সাম্প্রতিক সাফল্য তো আরও দুর্দান্ত; সবশেষ সাতবারের লড়াইয়ে ছয়টিতেই জয়ী তারা, অন্যটি ড্র। গত সপ্তাহের প্রথম লেগে রেয়ালকে নিজেদের আঙিনায় পেয়েও হারাতে পারেনি বায়ার্ন; ম্যাচটি শেষ হয় ২-২ ড্রয়ে।
তাই, অতীত পরিসংখ্যানের দিকে তাকালে রেয়ালকে কিছুটা এগিয়ে রাখতেই হয়। সঙ্গে এবার তারা পাচ্ছে ঘরের মাঠে খেলার বাড়তি সুবিধা। রেয়ালের সমর্থকে ঠাসা ৮০ হাজার আসনবিশিষ্ট স্টেডিয়ামে স্বাগতিকদের রুখে দেওয়ার কাজটা যে কতটা কঠিন হবে, তা ফুটে উঠেছে সোমবার বায়ার্ন তারকা টমাস মুলারের কথায়ও।
একই সঙ্গে বিশ্বকাপজয়ী জার্মান তারকা প্রতিপক্ষের ডেরায় নেমেই দলের ব্যর্থতায় ভরা মৌসুমকে নতুন রং দেওয়ার প্রত্যয় ব্যক্ত করেছেন। চ্যালেঞ্জটা খুব কঠিন হবে জেনেও শুনিয়েছেন আশার বাণী, “লড়াইটা হবে সমানে সমান, যেখানে যেকোনো সময় যেকোনো কিছু হতে পারে।”
ছয়বারের ইউরোপ চ্যাম্পিয়ন বায়ার্ন ফাইনাল খেলেছে মোট ১১ বার। আরও একবার স্বপ্নের মঞ্চে উঠতে তাদের সামনে সবচেয়ে বড় বাধা হতে পারে ভিনিসিউস জুনিয়র। গতি আর ড্রিবলিংয়ে প্রতিপক্ষের রক্ষণ চোখের পলকে গুঁড়িয়ে দিতে যার জুড়ি মেলা ভার। গত সপ্তাহে মিউনিখে তার জোড়া গোলেই শঙ্কার মেঘ উড়িয়ে ড্র করে ফেরে রেয়াল।
এবারের আসরে ভিনিসিউস জালের দেখা পেয়েছেন পাঁচবার, অ্যাসিস্ট চারটি। ২০২১-২২ মৌসুমের শুরু থেকে চ্যাম্পিয়ন্স লিগে মোট ৩১টি গোলে সরাসরি জড়িয়ে এই ব্রাজিলিয়ান ফরোয়ার্ডের নাম (১৬টি গোল ও ১৫টি অ্যাসিস্ট), যেকোনো খেলোয়াড়ের চেয়ে বেশি।
বায়ার্নের আক্রমণভাগেও আছে ‘গোলমেশিন’ কেইন। চলতি মৌসুমের শুরুতে টটেনহ্যাম হটস্পার ছেড়ে বায়ার্নে পা রেখে গোলের পর গোল করে চলেছেন তিনি, গড়ছেন রেকর্ড। আসরে এখন পর্যন্ত সর্বোচ্চ গোলেও জড়িয়ে কেইনের নাম; কিলিয়ান এমবাপের সমান আটটি গোল করেছেন ইংলিশ স্ট্রাইকার। প্রতিযোগিতাটিতে এর আগে কখনোই এক আসরে এত গোল কেইন তে বটেই, অতীতেও করেনি কোনো ইংলিশ খেলোয়াড়। বায়ার্নের জার্সিতে চলতি মৌসুমে সব প্রতিযোগিতা মিলিয়ে তার গোলসংখ্যা ঈর্ষা করার মতো; ৪৩টি।
রেকর্ডের হাতছানি আছে বায়ার্নের ডাগআউটের কাণ্ডারির সামনে। আসছে ম্যাচে বাজিমাত করতে পারলে প্রথম কোচ হিসেবে ভিন্ন তিন দলের হয়ে চ্যাম্পিয়ন্স লিগের ফাইনালে ওঠার কীর্তি গড়বেন টমাস টুখেল। ২০১৯-২০ মৌসুমে পিএসজির হয়ে ফাইনালে এই বায়ার্নের বিপক্ষে হেরে যাওয়ার পরের বছরই চেলসিকে ইউরোপ চ্যাম্পিয়ন করান এই জার্মান।
প্রতিযোগিতাটির ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি (৫ বার) ফাইনাল খেলার রেকর্ডটি আগে থেকেই রেয়াল কোচ কার্লো আনচেলত্তির দখলে। সেটাকে আরও বাড়িয়ে নেওয়ার দারুণ সুযোগ তার সামনে।
সব মিলিয়ে মাঠের পরতে পরতে, ডাগআউটে চলবে নানামূখী লড়াই। রেকর্ড-পরিসংখ্যান ভুলে এখন কেবল সে লড়াইয়ের অপেক্ষা। এ ম্যাচ ঘিরে উত্তেজনার পারদ ইতোমধ্যে পৌঁছে গেছে তুঙ্গে; এখন অপেক্ষা উত্তর মেলার। রেয়াল নাকি বায়ার্ন-কে যাচ্ছে ফাইনালে?