বিক্রেতা প্রতিষ্ঠানগুলোর দাবি, দাম সমন্বয় করা হয়েছে ‘যৌক্তিকভাবেই’।
Published : 27 Apr 2025, 01:52 AM
শুরুটা হয়েছিল গেল বছরের নভেম্বরে। ওই সময় ব্র্যাক এন্টারপ্রাইজের ব্র্যান্ড ‘আড়ং’ হুট করেই তাদের প্যাকেটজাত তরল দুধের দাম বাড়িয়ে দেয়। তখন প্রতি লিটার তরল দুধের দাম ১০ টাকা ও ৫০০ গ্রামের দুধের দাম পাঁচ টাকা বাড়ায়।
পরে প্রাণসহ অন্যান্য ব্র্যান্ডের তরল দুধের দামও একইভাবে বাড়ানো হয়। এই ধারাবাহিকতায় সবশেষ গত ২১ মার্চ রাষ্ট্রীয় দুগ্ধ উৎপাদনকারী সমবায় ইউনিয়ন লিমিটেড– মিল্কভিটাও তাদের তরল দুধের দাম বাড়ায়।
বাজার ঘুরে দেখা গেছে, আড়ংয়ের স্ট্যান্ডার্ডাইজড (সম্পূর্ণ প্রক্রিয়াজাত নয়) দুধ আধা লিটারের প্যাকেট ৫৫ টাকা, এক লিটার ১০০ টাকা, পাস্তুরিত (পুরোপুরি প্রক্রিয়াজাত) দুধ আধা লিটার প্যাকেট ৬০ টাকা এবং এক লিটার ১০৫ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে।
একই ব্র্যানেডর ২৫০ গ্রামের দুধের প্যাকেটের দাম বেড়ে ২৫ থেকে বেড়ে ৩০ টাকা হয়েছে। অন্যান্য ব্র্যান্ডের দুধের দামও প্রায় একই রকম বেড়েছে।
মিল্কভিটার আধা লিটার প্যাকেটের দাম ৫০ থেকে বাড়িয়ে ৫৫ টাকা এবং এক লিটার প্যাকেটের দাম ৯০ থেকে বাড়িয়ে ১০০ টাকা করা হয়েছে।
পুষ্টি চাহিদা পূরণে সববয়সী মানুষের খাদ্যতালিকার প্রয়োজনীয় অনুষঙ্গ দুধের দাম বেড়ে যাওয়ায় কেনা কমিয়ে দেওয়ার কথা বলেছেন অনেক ভোক্তা। খুচরা বিক্রেতারাও বেচাবিক্রি কমার তথ্য দিয়েছেন।
তবে বিক্রেতা প্রতিষ্ঠানগুলোর দাবি, দাম সমন্বয় করা হয়েছে ‘যৌক্তিকভাবেই’।
দেশে ২০১৮ সালে এক লিটার পাস্তুরিত তরল দুধের দাম ছিল ৬০ থেকে ৬৫ টাকা। ২০২১ সালেও দাম ছিল ৭০ থেকে ৭৫ টাকার মধ্যে।
সর্বশেষ মূল্যবৃদ্ধির আগে প্রতি লিটারের দাম ছিল ৯০ টাকা। অর্থাৎ, বছর না ঘুরতেই তরল দুধের দাম লিটারে ১০ থেকে ১৫ টাকা বেড়েছে। আগের দফাতেও এক লাফে ১০ থেকে ১৫ টাকা বাড়ানো হয়েছিল।
কোম্পানিগুলো যা বলছে
লোকসানের মুখে মন্ত্রণালয়ের অনুমতি নিয়েই দাম বাড়ানোর পথে হেঁটেছে মিল্কভিটা, এমনটাই দাবি এর ব্যব্স্থাপনা পরিচালক জাহিদুল ইসলামের।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “২০২২ সালে আমরা দুধ এবং দুগ্ধজাত পণ্যের দাম সমন্বয় করেছিলাম। আমরা কৃষকদের কাছ থেকে এগুলো কিনে প্রস্তুত করি। এই দুই বছরে খামারি পর্যায়ে চার বারে ১৩ টাকা ক্রয়মূল্য বাড়িয়েছি।”
এখন খামারিরা কত দাম পান, জানতে চাইলে তিনি বলেন, “ফ্যাট পার্সেন্ট ৩ থেকে ৭ শতাংশের ওপর নির্ভর করে দাম বাড়ে। গড়ে ৪ শতাংশ ফ্যাট যদি থাকে, সে দুধের দাম আমরা দিই ৫৮ টাকা প্রতি লিটার। এর সঙ্গে যেসব সমবায়ীরা দূর থেকে দুধ নিয়ে আসে তাদের আমরা প্রতি লিটারে পরিবহন খরচ দিই, যেটা ৩ টাকার বেশি। যার ফলে, ৪ শতাংশ ফ্যাট থাকা দুধের ক্রয়মূল্য পড়ে ৬১ টাকার বেশি। এরপর আমাদের কারখানায় যে খরচ সেটা যোগ করে দেখলাম ক্রয়মূল্য পড়ে ৮২ টাকার ওপর। আমরা পরিবেশককে দিচ্ছি ৭৮ টাকায়।
“এ অবস্থায় আমরা বেসরকারি কোম্পানিগুলোর দামের উদাহরণ দিয়ে রোজার দুই তিন মাসে আগে মন্ত্রণালয়ে দাম বাড়ানোর প্রস্তাব দিয়েছিলাম। প্রথমে মন্ত্রণালয় অনুমোদন না করায় ২ থেকে আড়াই কোটি টাকা প্রতি মাসে লোকসান দিতে হচ্ছিল। পরে মন্ত্রণালয় রাজি হওয়ায় আমরা দাম বাড়িয়েছি।”
দুধের দাম বাড়ানোর কারণ জানতে চাইলে প্রাণের বিপণন পরিচালক কামরুজ্জামান কামালের ভাষ্য, “খামারি পর্যায়ে উৎপাদন খরচ বাড়ার কারণে দুধের দাম বাড়াতে হয়েছে। যেটা আমরা ভোক্তা পর্যায়ে বাড়িয়েছি। খামারিদের দাবি ছিল, গো-খাদ্যের দাম বেড়ে গেছে, সেজন্য তাদের লোকসান হচ্ছে। তারা বাড়তি দাম চাচ্ছিলেন, যে কারণে আমাদেরও বিক্রির দাম বাড়াতে হয়েছে।”
দুধের দাম বাড়ার কারণ জানতে ব্র্যাক এন্টারপ্রাইজের ঊর্ধ্বতন পরিচালক আনিসুর রহমানকে বেশ কয়েকবার ফোন করে এবং ক্ষুদেবার্তা পাঠিয়েও সাড়া পাওয়া যায়নি।
উৎপাদন কেমন, চাহিদা কত
প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের তথ্যানুযায়ী, বর্তমানে বাংলাদেশে দুগ্ধ খামারির সংখ্যা প্রায় ২০ লাখ। ২০১২-১৩ অর্থবছরে দেশে দুধ উৎপাদন হত প্রায় ৫০ লাখ ৭০ হাজার মেট্রিক টন। এরপরের তিন অর্থবছরে সেটি বেড়ে ৭২ লাখ মেট্রিক টনের বেশি হয়।
২০১৬-১৭ অর্থবছরে উৎপাদন বেড়ে হয় ৯২ লাখ মেট্রিক টন। ২০২১-২২ অর্থবছরে দুধের উৎপাদন ছিল ১ কোটি ৩০ লাখ ৭৪ হাজার মেট্রিক টন। ২০২২-২৩ অর্থবছরে সেটি বেড়ে প্রায় ১ কোটি ৪০ লাখ মেট্রিক টন আর ২০২৪ সালে ১ কোটি ৫২ লাখ ৫২ হাজার টন হয়েছে।
বিপরীতে দেশে বছরে তরল দুধের চাহিদা ১ কোটি ৫৬ লাখ ৬৮ হাজার মেট্রিক টনের বেশি। বাকি চাহিদা মেটানো হয় গুঁড়ো দুধ আমদানি করে।
বিভিন্ন কোম্পানি ৮ থেকে ৯ লাখ টন দুধ প্রক্রিয়াজাত করে বিভিন্ন দুগ্ধজাত পণ্য প্রস্তুত করছে। আর, বাকি দুধ খামারিরা বিভিন্ন মিষ্টি তৈরির দোকান এবং খোলাবাজারে বিক্রি করেন।
মহাখালীর সাততলা বাজারে বোতলে করে দুধ বিক্রি করতে এসেছিলেন মো. জাহিদ নামের এক বিক্রেতা।
দাম নিয়ে জানতে চাইলে এই বিক্রেতা বললেন, “আফতাবনগর এলাকার এক খামারির কাছ থেকে দুধ কিনে এনে বিক্রি করি আমি। বাজারের ওঠানামা বুঝে ৭০ থেকে ৮০ টাকা প্রতি লিটার বিক্রি হয়।”
দাম নিয়ে জানতে চাইলে সিরাজগঞ্জের শাহজাদপুরের আতিক ডেইরি ফার্মের সত্ত্বাধিকারী আল মাহমুদ বলেন, “আমরা মিল্কভিটাকে দুধ সরবরাহ করি। আমার খামারে দৈনিক ২০০ থেকে সাড়ে ৩০০ লিটার দুধ পাই। এগুলো ৫৮ থেকে ৬১ টাকার মধ্যেই সাধারণত বিক্রি করি। তবে, বাজার কখনো-কখনো নেমেও যায়।”
বাজার ‘নেমে যাওয়ার' কারণ জানতে চাইলে বলতে পারেননি এই খামারি।
দাম বাড়ায় ভোক্তারা কিনছেন কম
নিকেতন বাজার গেইট এলাকার ‘শাকিল স্টোর’ নামে একটি কনফেকশনারি দোকানে সোমবার রাতে দুধ কিনতে এসেছিলেন গৃহিণী জেসমিন বেগম। মিল্কভিটার দুধ কেনেন তিনি। দুধের দাম বাড়ার তথ্য জানা ছিল না তার। পরে তিন লিটারের জায়গায় দুই লিটার দুধ কিনে ফিরে যান তিনি।
এই গৃহিণী বলেন, “আমি এক লিটার দুধ কিনতাম ৯০ টাকা করে তিন প্যাকেট। আজ এসে দেখি ১০০ টাকা দাম হয়ে গেছে। তাই কম কিনলাম। সব কিছুরই দাম শুধু বাড়ে।”
এই দোকানের বিক্রেতা শাকিল হোসেন বলেন, বাজারে বর্তমানে বিভিন্ন ব্র্যান্ডের প্রতি কেজি গুঁড়ো দুধ গড়ে ৬৫০ থেকে ৮৫০ টাকা করে বিক্রি হচ্ছে।
“গেল বছরের ডিসেম্বরের দিকে খুচরা পর্যায়ে গুঁড়ো দুধের দাম কেজিতে ২৫ থেকে ৩০ টাকার মতো বাড়িয়েছিল প্রায় সবগুলো কোম্পানি। এরপর আর গুঁড়ো দুধের দাম বাড়েনি। দাম বাড়ায় দুধ আগের তুলনায় কম বিক্রি হচ্ছে। আগে অনেকগুলো কোম্পানির দুধ রাখলেও এখন শুধু দুটি কোম্পানির দুধ বিক্রি করি।”
মহাখালীর সাততলা বাজারের মুদি দোকানি ফারুক হোসেনের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, এক বছরে ৪০০ গ্রাম ওজনের টিনজাত দুধের দামও ১৫০ থেকে ২০০ টাকা পর্যন্ত বেড়েছে। সেই সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বেড়েছে দুগ্ধজাত পণ্যের দামও।
বাজার ঘুরে দেখা গেছে, আধা কেজি মিষ্টি দইয়ের দাম এখন গড়ে ১৩০ থেকে ১৫০ টাকা, যা ২০২১ সালেও গড়ে ছিল ৮০ টাকা। আর, ২০১৮ সালে এই দাম ছিল ৬৫ টাকা। মিষ্টি, আইসক্রিম, মাখন, লাবাং, ফ্লেভারড মিল্কসহ প্রায় সব পণ্যের দামই বেড়েছে।
গ্রহণের পরিমাণ কমলে পুষ্টিহীনতার শঙ্কা
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) মানদণ্ড অনুযায়ী, একজন মানুষের পরিপূর্ণ পুষ্টি চাহিদা পূরণে দৈনিক ২৫০ মিলিলিটার দুধ পান করা দরকার। শিশুদের দৈহিক বৃদ্ধির জন্য তো বটেই, গর্ভবতী, পূর্ণবয়স্ক আর বয়োবৃদ্ধ মানুষের খাদ্য তালিকায়ও দুধ থাকা উচিত বলে মনে করেন পুষ্টিবিদরা।
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ লেলিন চৌধুরী বলেন, “দুধকে বলা হয় পূর্ণ খাদ্য। কারণ, দুধে প্রোটিন, ক্যালসিয়ামসহ এমন কিছু উপাদান থাকে যেটি মানুষের শরীরের জন্য সব সময় দরকার। বিশেষ করে শিশুর বাড়ন্ত বয়স পর্যন্ত এবং গর্ভবতী নারীর জন্য এটি গুরুত্বপূর্ণ খাদ্যের অংশ। নিয়মিত এক গ্লাস দুধ পান করলে গর্ভকালীন সময়ে তার শরীরে যে ক্যালসিয়ামের ঘাটতি হয়, সেটি পূর্ণ হয়। দুধ প্রোটিনেরও পরিপূরক হিসেবে কাজ করে।
“আমাদের খাবারে মৌলিক যে কয়টি পুষ্টি উপাদান দরকার, তার একটি অংশ দুধ পূরণ করে। দুধের দাম বেড়ে গেলে, দুধ খাওয়া লোকের গ্রহণের পরিমাণ কমে যায়, ফলে পুষ্টিতে একটি ভারসাম্যহীনতা তৈরি হতে পারে।”