“তদন্ত কমিটি হয়েছিল। আমরা তদন্ত প্রতিবেদন মন্ত্রণালয়ে জমাও দিয়ে দিয়েছি,” বলেন অতিরিক্ত সচিব হুমায়ুন কবীর।
Published : 25 Apr 2025, 01:39 AM
রানা প্লাজার ষষ্ঠ তলার ‘ইথারটেক্স লিমিটেড’ নামে একটি পোশাক কারখানার কর্মী ছিলেন শিলা বেগম। এক যুগ আগে ভবনটি যখন ধসে পড়ে, কর্মরত অবস্থায় অনেকের সঙ্গে চাপা পড়েন তিনিও। প্রায় ১৮ ঘণ্টা পরে রাত দেড়টার দিকে জীবিত উদ্ধার হলেও তখন থেকে পঙ্গুত্ব বয়ে চলছেন।
ভয়াবহ এ ভবন ধসের ঘটনার এক যুগ পেরিয়ে এসে খোঁজ নিতে গেলে শিলা বেগম বলছিলেন, “২৪ এপ্রিল আসলে আপনারা মিডিয়ারা একটু আসেন, সংগঠনগুলা আসে। এছাড়া আমাগো ঈদ যায়, কোরবানি যায়, আমাদের কেউ জিজ্ঞাসাও করে না যে জীবন কেমনে চলে?”
ভবনে চাপা পড়ে ডান হাত অচল হয়ে গেছে শিলার। মেরুদণ্ড ও পেটে গুরুতর আঘাত পেয়ে কোনোমতে চলাচল করা এই নারীর স্বামী মারা গেছেন ২০০২ সালে।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে এক কন্যা সন্তানের এই জননী বলেন, “ভবনের বিম পইড়া ছিল আমার পেটের উপর, মেরুদণ্ডও ভাইঙা গেছে। এহন লোহার খাঁচার মত একটা পইরা কোনোরকমে চলাচল করতেছি। ডান হাতটা আজীবনের জন্য অচল।
“মানুষের কাছ থেকে চাইয়া-চিন্তা চলতাছি। যুদ্ধ করতে করতে এই পর্যন্ত আইছি। আগের সরকার তো আমাদের কিছু দেয় নাই। নতুন সরকার আইছে, তারা আমাদের ক্ষতিপূরণটা দিয়া দিলে দুইটা ডালভাত খাইতে পারতাম।”
শুধু শিলা বেগমই নন, অসুস্থতা আর পঙ্গুত্বের কারণে রানা প্লাজার ঘটনায় আহতদের বেশিরভাগই এক যুগ ধরে বয়ে চলেছেন দুর্বিষহ এক জীবন। দীর্ঘ এই সময়েও ‘ঠিকঠাক’ ক্ষতিপূরণ না পাওয়ায় তার দুষছেন তৎকালীন সরকার ও প্রশাসনকে।
শ্রমিকনেতাদের পাশাপাশি আহতরাও বলছেন, ক্ষতিগ্রস্থদের জন্য তৎকালীন প্রধানমন্ত্রীর ‘ত্রাণ তহবিলে’ জমা হওয়া অর্থেরও সঠিক ব্যবহার হয়নি। বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার এ বিষয়ে ‘সদয় হবেন’ এমন আশা থাকলেও প্রায় আট মাসেও কোনো উদ্যোগ ‘নেওয়া হয়নি’ বলে অভিযোগ তাদের।
২০১৩ সালের ২৪ এপ্রিল সাভার বাসস্ট্যান্ড সংলগ্ন ১০ তলা রানা প্লাজা ভবন ধসে পড়ে। ওই ভবনে থাকা কয়েকটি পোশাক কারখানার ৫ হাজারের মত শ্রমিক ভবনের নিচে চাপা পড়েন।
কয়েকদিনের উদ্ধার তৎপরতায় ১ হাজার ১৩৬ জনের লাশ তুলে আনা হয়। ধ্বংসস্তূপের নিচ থেকে ২ হাজার ৪৩৮ জনকে জীবিত উদ্ধার করা হয়। তার মধ্যে প্রায় দুই হাজার শ্রমিক আহত ও পঙ্গু হন।
শত কোটি টাকার ত্রাণ তহবিল নিয়ে ‘রাখঢাক’
রানা প্লাজার মর্মান্তিক দুর্ঘটনার বর্ষপূর্তি উপলক্ষে ২০১৪ সালের ২৩ এপ্রিল প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে সংবাদ সম্মেলন করে জানানো হয়, রানা প্লাজা দুর্ঘটনায় ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য প্রধানমন্ত্রীর ত্রাণ ও কল্যাণ তহবিল থেকে এ পর্যন্ত ২২ কোটি ১৩ লাখ ৫৫ হাজার ৭২০ টাকা ব্যয় করা হয়েছে।
তবে রানা প্লাজার ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য প্রধানমন্ত্রীর ত্রাণ তহবিলে কত টাকা জমা পড়েছে তার কোনো তথ্য সেদিন দেওয়া হয়নি।
যদিও ২০১৩ সালের ১৪ জুলাই জাতীয় সংসদে কৃষিমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী বলেছিলেন, রানা প্লাজার ক্ষতিগ্রস্তদের সহায়তায় প্রধানমন্ত্রীর ত্রাণ তহবিলে জমা পড়েছে ১২৭ কোটি ৬৭ লাখ ৩৩ হাজার ৩৪৯ টাকা। সে দিন সরকার দলীয় সংসদ সদস্য মুহিবুর রহমান মানিকের এক প্রশ্নের জবাবে সংসদকে তিনি বলেন, বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তি এ অর্থ দিয়েছেন।
সে হিসেবে এক বছর পরেও রানা প্লাজার জন্য সংগৃহীত অর্থের প্রায় ১০৫ কোটি টাকা অব্যবহৃত থাকার কথা।
২০১৫ সালের ২১ এপ্রিল ‘তৈরি পোশাক খাতে সুশাসন বাস্তবায়নে গৃহীত পদক্ষেপ: গত এক বছরের অগ্রগতি পর্যালোচনা’ শীষর্ক এক গবেষণা প্রতিবেদনে’ ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ-টিআইবি দাবি করে, রানা প্লাজার জন্য সংগৃহীত প্রধানমন্ত্রীর ত্রাণ তহবিলের ১০৮ কোটি টাকাই অব্যবহৃত রয়েছে।
টিআইবির প্রতিবেদনে অব্যবহৃত অর্থ ৩ কোটি বাড়তি দেখালেও সেখানে প্রধানমন্ত্রীর ত্রাণ তহবিলে সংগৃহীত মোট অর্থ ১৬ মিলিয়ন মার্কিন ডলার (প্রায় ১২৭ কোটি টাকা) বলা হয়।
সংস্থাটির প্রতিবেদন অনুযায়ী, মোট অর্থ থেকে প্রায় ২ দশমিক ৪৮ মিলিয়ন ডলার ক্ষতিপূরণ দেওয়ার পর প্রায় ১৪ মিলিয়ন ডলার (১০৮ কোটি টাকা) অব্যবহৃত থেকে যায়।
এই প্রতিবেদন তৈরি করতে ‘প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ’ উৎস থেকে তথ্য সংগ্রহ করা হয়েছে জানিয়ে টিআইবি বলেছিল, “তৈরি পোশাক খাত সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন কর্তৃপক্ষের (কলকারখানা অধিদপ্তর, রাজউক, শ্রম পরিদপ্তর, ফায়ার সার্ভিস, গার্মেন্টস পালিক, শ্রমিক সংগঠন, বিজিএমইএ, বায়ার). ট্রেড ইউনিয় প্রতিনিধির নিকট হতে তথ্য সংগ্রহ করা হয়েছে।
“এছাড়া বিভিন্ন অংশীজনের ওয়েব সাইট, সরকারি প্রতিবেদন, আদালতের নির্দেশনা, গবেষণা প্রতিবেদন এবং প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় প্রকাশিত খবর ও প্রবন্ধ ইত্যাদি পরোক্ষ তথ্যের উৎস হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে।”
গবেষণাটি ওই বছরের মার্চ-এপ্রিল মাসে সম্পন্ন করা হয় বলেও উল্লেখ করা হয় প্রতিবেদনে।
তবে এর একদিন পরই ২৩ এপ্রিল প্রধানমন্ত্রীর দপ্তর এক বিবৃতিতে টিআইবির প্রতিবেদন ‘নাকচ’ করে দেওয়া হয়।
বিবৃতিতে টিআইবির বক্তব্যকে ‘বিভ্রান্তিকর’ মন্তব্য করে বলা হয়, “রানা প্লাজার নামে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে আলাদা কোনো তহবিল নেই।”
সেখানে ‘রানা প্লাজা দুর্ঘটনার পর প্রধানমন্ত্রীর ত্রাণ ও কল্যাণ তহবিলে অনুদান আসার’ বিষয়টি ‘স্বীকার’ করলেও কী পরিমাণ অর্থ জমা পড়েছে এবং সেখান থেকে কী পরিমাণ অর্থ রানা প্লাজার ঘটনায় হতাহতদের মধ্যে বিতরণ করা হয়েছে জানানো হয়নি।
আলাদা কোনো হিসাব নম্বর না থাকায় রানা প্লাজার ক্ষতিগ্রস্তদের নামে প্রধানমন্ত্রীর ‘ত্রাণ ও কল্যাণ তহবিলে’ জমা পড়ার ‘রেকর্ড নেই’ বলেও জানানো হয়। তবে কৃষিমন্ত্রীর মতিয়া চৌধুরীর দেওয়া ১২৭ কোটি টাকার তথ্যের বিষয়ে কিছু বলা হয়নি বিবৃতিতে।
রানা প্লাজা ধসের পরে দেশের সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে ক্ষতিগ্রস্তদের সহায়তার জন্য নগদ অর্থ জমা করা হয় প্রধানমন্ত্রীর তহবিলে। এর অনেক চেকই সরাসরি তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে সরাসরি হস্তান্তর করার খবরও আসে সংবাদমাধ্যমে।
পরদিন অপর এক বিবৃতিতে প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরকে ‘রানা প্লাজা দুর্ঘটনায় ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য সংগৃহীত, ব্যয়িত ও অব্যবহৃত অর্থ সম্পর্কে সকল তথ্য প্রকাশের’ আহবান জানায় টিআইবি।
কিন্তু পরে এ বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীর দপ্তর থেকে তার ত্রাণ তহবিলে জমা হওয়া অর্থের পরিমাণ ও সেখান থেকে শ্রমিকদের সহায়তার পরিমাণের বিষয়ে কোনো তথ্য জানানো হয়নি।
গার্মেন্টস শ্রমিক ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্রের সাধারণ সম্পাদক জলি তালুকদার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “সারা দেশের মানুষ ত্রাণ তহবিলে ১২৭ কোটি টাকা দিল, সেটার ২২ কোটি টাকা খরচ করল। বাকি টাকার হিসাবটা আমরা জানি না। এটার হিসাব আমরা বার বার চাইছি, কিন্তু দেওয়া হয়নি।”
একই সংগঠনের সহকারী সাধারণ সম্পাদক মঞ্জুর মঈন বলেন, “সে সময়ে প্রধানমন্ত্রীর ত্রাণ তহবিলে যে অনুদান জমা পড়ছিল, সেখানে সব ধরনের লোক পার্টিসিপেন্ট করছে। শুধু প্রতিষ্ঠান নয়, ব্যক্তি বিশেষও রানা প্লাজার শ্রমিকদের জন্য দান করছিল।
“কিন্তু এটা খুবই আনফরচুনেট, রানা প্লাজার সময়ে যে অনুদানগুলো জমা পড়ছে সেগুলো ক্ষতিগ্রস্তদের দেওয়া হয় নাই। তারা পরে বলল প্রধানমন্ত্রীর ত্রাণ তহবিল একটা ইউনিভার্সাল ব্যাপার।”
সেন্টার ফর ওয়ার্কার সলিডারিটির প্রতিষ্ঠাতা ও নির্বাহী পরিচালক কল্পনা আখতারের ভাষ্য, “সেই সময় যে টাকা তহবিলে জমা হয়েছিল, তার অল্পকিছু টাকা আহত-নিহত পরিবারের মধ্যে দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু বড় টাকাটাই কী করেছে জানা সম্ভব হয়নি।”
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “যখনই আমরা জানার চেষ্টা করছি, আমাদেরকে বলা হয়েছে এটা প্রধানমন্ত্রীর তহবিল, যেখানকার অর্থ বিভিন্ন দুর্যোগে ব্যবহার করা হয়। কিন্তু সেই সময়ে রানা প্লাজার চেয়ে বড় দুর্যোগ কী ছিল আমাদের জানা নেই।”
টিআইবি’র নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান তখনকার ‘প্রধানমন্ত্রীর ত্রাণ তহবিলে’ রানা প্লাজার জন্য জমা পড়া অর্থের বিষয়ে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “এটাতো জনস্বার্থে বিশেষ করে জাতীয়ভাবে এবং আন্তর্জাতিকভাবে ব্যাপক আলোচিত ট্র্যাজেডির পরিপ্রেক্ষিতে এই তহবিলের মধ্যে টাকাটা জমা হয়েছিল। এটা যে উদ্দেশ্যে দেওয়া হয়েছিল সেই উদ্দেশ্যেই ব্যয়িত হবে, সেটাই ছিল মানুষের প্রত্যাশা।
“সেটা স্বচ্ছতার সাথে বিতরণ করার কথা ছিল। সেটা করতে তৎকালীন সরকার ব্যর্থ হয়েছে, শুধু তাই না তারা যে দায়িত্বে অবহেলা করেছে, তাদের উপরে অর্পিত যে ম্যান্ডেট, সেই ম্যান্ডেটটা পদদলিত করেছে। অথচ সেই কারণে যাদের ক্ষতিপূরণ পাওয়াটা ছিল যাদের জন্য ন্যায্য, সেটা তারা পায়নি।”
“একই সাথে এই তহবিলের কী হল, সেই সম্পর্কে তৎকালীন সরকার কোনো তথ্য প্রকাশ করেনি”–এমন অভিযোগ এনে ইফতেখারুজ্জামান বলেন, “যদিও এটা জনগণের প্রত্যাশা ছিল, আমাদের পক্ষ থেকে সকলের দাবি ছিল। এটা একদিক থেকে হতাশাব্যঞ্জক। কিন্তু একদিক থেকে এটা মোটেও অবাক হওয়ার কিছু না। কারণ যে সরকার তখন ক্ষমতায় ছিল তাদের পক্ষে এটাই স্বাভাবিক ছিল।”
এখন এতোবছর পরেও এ বিষয়ে কোনো অগ্রগতি না থাকায় বর্তমান দায়িত্বশীলদের উদ্দেশ্য করে তিনি বলেন, “বর্তমানে পরিবর্তিত অবস্থায় অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের উচিত হবে বিষয়টা খতিয়ে দেখা। অবশ্যই সরকার চেষ্টা করলে কত টাকা জমা হয়েছে, কত টাকা কোন পারপাসে ব্যয় হয়েছে এবং সেটা কতখানি আইনসম্মত ও বিধিসম্মত, সেটি যেমন নিরূপণ করা সম্ভব, কেউ যদি ঘাপলা, নয়-ছয় বা অনিয়ম করে থাকে, যে উদ্দেশ্যে অর্থটা সংগৃহীত হয়েছে তার বাইরে অন্য কোন পারপাসে ব্যয়িত হয়ে থাকে সেগুলোর সাথে জড়িতদের জবাবদিহিতার আওতায়ও আনা যাবে।”
এ বিষয়ে বর্তমান প্রধান উপদেষ্টার দপ্তরে দায়িত্বরত একাধিক কর্মকর্তার সঙ্গে যোগাযোগ করে কোনো বক্তব্য পাওয়া যায়নি।
তদন্তে মন্ত্রণালয়ের কমিটি
অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব গ্রহণের পরে গত ২০ অগাস্ট সচিবালয়ে রানা প্লাজা ও তাজরীন ফ্যাসনস দুর্ঘটনায় ক্ষতিগ্রস্তদের সঙ্গে মতবিনিময় শেষে তৎকালীন শ্রম ও কর্মসংস্থান উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া রানা এ দুটি দুর্ঘটনায় হতাহতদের কতটুকু সহায়তা দেওয়া হয়েছে, তা ‘খতিয়ে দেখার’ কথা বলেছিলেন।
তিনি বলেছিলেন, “গত আওয়ামী লীগের আমলে রানা প্লাজা ও তাজরীন ফ্যাসনস দুর্ঘটনায় যারা ক্ষতিগ্রস্ত এবং নিহত হয়েছিল তাদের পরিবারের জন্য যে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছিল তা কতটুকু সুষ্ঠুভাবে বাস্তবায়ন করা হয়েছে এবং বাস্তবে আপনারা কতটুকু উপকার পেয়েছেন বা পাননি সে বিষয়ে তদন্ত করা হবে। এর জন্য আমরা একটা তদন্ত কমিটি গঠন করব এবং বাস্তব চিত্রটা সেই তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনের মাধ্যমে তুলে ধরব।”
মন্ত্রণালয়ের বর্তমান উপদেষ্টা এম সাখাওয়াত হোসেনকে ফোন করে তার বক্তব্য পাওয়া যায়নি।
শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের জনসংযোগ কর্মকর্তা আবদুল মালেকের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, “এ বিষয়ে আমি কিছু জানি না। আমি পরে দায়িত্ব নিয়েছি। শ্রম উইংয়ের সঙ্গে যোগাযোগ করে দেখতে পারেন।”
তদন্ত কমিটি হওয়ার তথ্য দিয়ে শ্রম অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মো. জাহাঙ্গীর হোসেন শ্রম মন্ত্রণালয়ের আর্ন্তজাতিক সংস্থা অনুবিভাগের অতিরিক্ত সচিব মো. হুমায়ুন কবীরের সঙ্গে কথা বলার পরামর্শ দেন।
পরে এ বিষয়ে মো. হুমায়ুন কবীর বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “তদন্ত কমিটি হয়েছিল। আমরা তদন্ত প্রতিবেদন মন্ত্রণালয়ে জমাও দিয়ে দিয়েছি।”
তবে কবে প্রতিবেদন জমা দিয়েছেন এবং প্রতিবেদনে কী সুপারিশ করা হয়েছে তাৎক্ষণিকভাবে বিস্তারিত জানাতে পারেননি তিনি।
সে সময়ের প্রধানমন্ত্রীর ত্রাণ তহবিল যা বর্তমানে প্রধান উপদেষ্টার ত্রাণ তহবিল, সেখানে রানা প্লাজা সম্পর্কিত কোনো অর্থ থাকলে ক্ষতিগ্রস্তদের মধ্যে বর্তমান সরকারের বিতরণ করা ‘উচিত’ বলে করেন টিআইবি’র নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান।
তিনি বলেন, “এখনতো এটা সুযোগ, অর্থটার যেটা এখনও আছে, ধারণা করা হয় আছে। এখন পর্যন্ত ক্ষতিগ্রস্তদের যারা তাদের ন্যয্য পাওনাটা পায় নাই, সুনির্দিষ্ট মানদণ্ড অনুযায়ী, নীতিমালা অনুযায়ী তাদের মধ্যে বিতরণ করা উচিত বলে মনে করি।”
কেমন আছেন আহতরা
রানা প্লাজার ধসের ঘটনায় ইথারটেক্স লিমিটেডের শ্রমিক কিশোরী ইয়ানুর আক্তারও চাপা পড়ে ছিলেন। ঘটনার দিন রাত ৩টার দিকে উদ্ধার হন ইয়ানুর। আর ১৪ দিন পর উপরের তলায় কর্মরত থাকা তার মা আনোয়ারা বেগমের মৃতদেহ উদ্ধার করা হয়।
এরপর দীর্ঘ চিকিৎসা চললেও ইয়ানুরের পা দুটি স্বাভাবিক হয়নি। ক্র্যাচে ভর করে চলাফেরা করা ইয়ানুর একাদশ শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশোনাও করেছেন। কাজ করতে অক্ষম হলেও কাজ পেতে চেষ্টা করেছেন, কিন্তু কোথাও কাজ না পেয়ে বেকার অবস্থায় পঙ্গু জীবন বয়ে বেড়াচ্ছেন।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে ইয়ানুর বলেন, “আমার দুইটা পা নাই, আমার মা মারা গেছে। কাজ নাই, চলার মত সামর্থ্য নাই।
“এভাবেই বাঁইচা আছি। কতদিন বাঁইচা থাকব? এইভাবে আর কতদিন? দেয়ালে পিঠ ঠেইকা গেলে যা হয়, তারচেয়েও খারাপ অবস্থায় আছি।”
দুর্ঘটনার পর বিয়ে হয় ইয়ানুরের। স্বামীর আয়ের উপর নির্ভর করে ‘খেয়ে না খেয়ে’ দিন চললেও নিজের চার বছরের সন্তানকে ‘ঠিকমতো’ খেতে দিতে না পারার আক্ষেপ তার।
“এই ১২ বছর কাজ যে নাই বলতেছি, এই কথাটা কেউ শুনছে? আমার আবেগের মূল্য কেউ দিছে? আমার কষ্টের কথা কেউ ফিল করছে? আসলে আমরা কি মানুষ? এখন একজন সুস্থ্ মানুষ আয় করে জীবিকা নির্বাহ করতে পারে না। সেই জায়গায় আমরা একজনের আয় দিয়ে বাঁইচা থাকতেছি। স্বামী ইনকাম করতেছে, সে ইনকাম না করতে পারলে না খেয়ে থাকতে হচ্ছে।”
সরকারি তহবিলের টাকাটাও তাদের ‘দেওয়া হয়নি’ অভিযোগ করে তিনি বলেন, “আমরা এই জীবনটা কি ডিজার্ভ করি? বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর আমাদের ডাকছে মন্ত্রণালয় থেকে। কিন্তু এখনও কিছু পাই নাই।
“আমরা ১২ বছর ধরে আন্দোলন করতেছি, মানুষের বিবেক নাই? দিবস আসলেই আমাদের সাথে কথা বলতে আসেন সবাই।”
ইয়ানুর বলেন, “একটা দেশ স্বাধীন করতে সময় লাগছে নয় মাস, আর আমরা এক যুগ ধরে একটা কথা বলতেছি। আমার পেটে ভাত নাই। এরচেয়ে লজ্জার কী হইতে পারে?”
রানা প্লাজার আট তলার একটি পোশাক কারখানায় কর্মরত থাকা বুলবুলি আক্তার ঘটনার দিন প্রায় ১২ ঘণ্টা পর রাত ৮টার দিকে উদ্ধার হলেও মেরুদণ্ড ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
তিনি বলেন, “১২টা বছর জীবনের সাথে যুদ্ধ করতাছি। যার জীবন পঙ্গু তার কিছুই থাকে না। আমিতো আমার মার ঘর থেইকা পঙ্গু হইয়া আসি নাই। কিন্তু আজকে না পারতাছি একটা চাকরি কইরা খাইতে, না পারতাছি ভালো করে বাঁচতে।
“এক বড়ভাইরে ধরছি, ছয় মাস মানুষের দ্বারে দ্বারে ঘুরছি। গেন্ডা বাজারে ফুটপাতে একটা চায়ের দোকান দিছি এই এক মাস ধরে। কিন্তু এই এক মাসের মধ্যেও তিনবার ভাইঙ্গা দিছে দোকানটা। তাহলে বুঝেন আমাদের জীবন কোন জায়গায় গিয়ে দাঁড়াইছে?”
এক যুগ ধরে কর্মহীন থাকা বুলবুলিও তৎকালীন সরকারের তহবিল নিয়ে প্রশ্ন তুলে বলেন, “পাওয়ার ভেতরে আমি ৫০ হাজার টাকা পাইছিলাম। পাওয়া বলতে ওইটাই শেষ, ওইটাই শুরু। এর বাইরে কিছু পাই নাই। আমাদের নামে ১২৭ কোটি টাকা আসছিল শুনছি, ২২ কোটি নাকি ব্যয় করছে। ১০৫ কোটি টাকা সরকারি ফান্ডে আমাদের নামে নাকি রাখছে। কিন্তু ওই টাকা কী করল আইজও আমাদের দিল না, খোঁজও করল না।”
“যেহেতু নতুন সরকার আইল, আমাদের ডাইকা নিয়া বলছিল। আমাদের আশ্বাস দিছিল, আশ্বাস পর্যন্তই আছে এখনও।”
গার্মেন্টস শ্রমিক ঐক্য ফোরামের সভাপতি মোশরেফা মিশু বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “সেখানে যে গার্মেন্টস কারখানাগুলো ছিল, সেগুলোর মালিকদের বিচার হওয়ার কথা ছিল। শুধু ভবন মালিক সোহেল রানা নয়, মালিকদেরও বিচার হওয়ার উচিত ছিল। কিন্তু তারা সবাই জামিনে মুক্ত আছে। এক যুগেও এখনও কারোরই কোনো বিচারই হল না।”
ভারতে পালিয়ে যাওয়ার সময় ২০১৩ সালের ২৯ এপ্রিল বেনাপোল থেকে ভবন মালিক সোহেল রানাকে গ্রেপ্তার করে র্যাব। এর পর থেকে তিনি কারাগারে রয়েছেন। বাকি আসামিদের মধ্যে কেউ পলাতক এবং কেউ জামিনে রয়েছেন। এ ঘটনায় করা হত্যা ও ইমারত নির্মাণ আইনের মামলা এখনো বিচারাধীন রয়েছে।