নেতাকর্মীরা বলছেন, বছরের পর বছর এ অবস্থা চলায় সংগঠনের কার্যক্রম স্থবির হয়ে পড়ছে। কিন্তু নতুন সম্মেলনের কোনো আশা তারা দেখছেন না।
Published : 26 Jun 2024, 01:48 AM
বাংলাদেশ ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক শেখ ওয়ালী আসিফ ইনানের নিজের শহর বরিশালে এক বছরের বেশি সময় ধরে কোনো কমিটি নেই।
আর বরিশাল জেলার দুই বছর মেয়াদি কমিটি চলছে ১৭ বছর ধরে। এই কমিটির কেউ কেউ আওয়ামী লীগের দায়িত্বেও চলে এসেছেন।
ছাত্রলীগের তৃণমূল পর্যায়ের নেতাকর্মীরা বলছেন, বছরের পর বছর এ অবস্থা চলায় সংগঠনের কার্যক্রম স্থবির হয়ে পড়ছে। কিন্তু নতুন সম্মেলনের কোনো আশা তারা দেখছেন না।
নগরীতে ছাত্রলীগের কোনো কার্যালয়ও নেই। বিবির পুকুর পাড়ে আওয়ামী লীগের কার্যালয়েই ছাত্রলীগের নেতারা যাওয়া-আসা করেন।
জেলা ও মহানগর পর্যায়ের অন্তত ১০ জন এবং প্রাক্তন ছয়-সাতজন নেতা-কর্মীর সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বরিশালে ছাত্রলীগ এখন অনেকটা বিভক্ত। কমিটি করতে গেলে সবাই নিজেদের সমর্থকদের আধিপত্য বজায় রাখতে চান। কেউ কাউকে ছাড় দিতে রাজি না। মূলত এ কারণে দায়িত্ব নেওয়ার মত নেতৃত্ব থাকার পরও কমিটি গঠন প্রক্রিয়া শুরু করা যাচ্ছে না।
ক্ষমতাসীন দলটির নেতাকর্মীরা জানান, এখানে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা বিভক্ত মূলত তিনটি ধারায়। সিটি করপোরেশনের সাবেক মেয়র ও মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সেরনিয়াবাত সাদিক আব্দুল্লাহ, সাবেক পানিসম্পদ প্রতিমন্ত্রী ও স্থানীয় সংসদ সদস্য জাহিদ ফারুক শামীম এবং সিটি করপোরেশনের মেয়র আবুল খায়ের আব্দুল্লাহ খোকন সেরনিয়াবাতের পক্ষে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা কাজ করেন।
দীর্ঘ সময় ধরে জেলা ও মহানগর কমিটিতে সেরনিয়াবাত সাদিক আব্দুল্লাহ অনুসারীদের প্রাধান্য থাকলেও গত বছর সিটি করপোরেশনের নির্বাচনের আগ মুহূর্ত থেকে অন্য দুই পক্ষের সমর্থকদের দাপটও বাড়তে থাকে। নির্বাচনে সেরনিয়াবাত সাদিক আব্দুল্লাহ মনোনয়ন না পেলে সেসময় থেকে অনেকেই খোকন সেরনিয়াবাতের পক্ষে অবস্থান নেন।
খোকন সেরনিয়াবাত সাবেক মেয়র সাদিক আব্দুল্লাহর আপন চাচা। এই দুই পরিবারের রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব বরিশালের রাজনীতিতে বহুল চর্চিত বিষয়। অনেকে মনে করেন, এই দুই পক্ষের রাজনৈতিক দ্বন্দ্বের বহিঃপ্রকাশ বরিশালের অন্য অনেক সংগঠনের মত ছাত্রলীগেও পড়েছে।
বরিশাল সদর উপজেলা ছাত্রলীগের এক নম্বর যুগ্ম আহ্বায়ক ইমরান হোসেন রিয়াজ সংসদ সদস্য জাহিদ ফারুক শামীমের অনুসারী হিসেবেই পরিচিত। সম্মেলন কেন হচ্ছে না জানতে চাইলে তিনি বলেন, “ভাই, এখানে তো কেউ কাউকে ছাড় দিতে রাজি না। এখানে ছাত্রলীগের রাজনীতিতে ‘ত্রি-স্পর্শ’ লেগেছে।”
জেলা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক আব্দুর রাজ্জাক বলেন, “আমাদের কমিটি ১৭ বছর রানিং। কমিটির সভাপতি হেমায়েত উদ্দিন সেরনিয়াবাত সুমন চার বছর ধরে মহানগর আওয়ামী লীগের দপ্তর সম্পাদক পদে আছেন।”
কমিটির মেয়াদ এত আগে শেষ হলেও সম্মেলন কেন করছেন না- এ প্রশ্নের উত্তরে আব্দুর রাজ্জাক বলেন, “সম্মেলন করার জন্য আমাদের সব ধরনের প্রস্তুতি আছে। কিন্তু সম্মেলন কেন হচ্ছে না, সেটা আমি জানি না।”
২০১১ সালে মো. জসীম উদ্দিনকে সভাপতি, অসীম দেওয়ানকে সাধারণ সম্পাদক এবং তৌসিক আহমেদ রাহাতকে সাংগঠনিক সম্পাদক করে বরিশাল মহানগর ছাত্রলীগের কমিটি গঠন করা হয়। নিয়ম অনুযায়ী, সেই কমিটি দ্রুতই পূর্ণাঙ্গ করার কথা।
কিন্তু তিনজনের কমিটি টানা ১০ বছর দায়িত্ব পালন করলেও অন্য কেউ আর সেই কমিটিতে অন্তর্ভুক্ত হওয়ার সুযোগ পাননি। প্রায় এক দশক পর ২০২১ সালের ২৫ মে সেই কমিটি বিলুপ্ত করে দেয় কেন্দ্রীয় সংসদ।
এরপর ২০২২ সালের জুলাই মাসে রইজ আহম্মেদ মান্নার নেতৃত্বে ২৯ সদস্যবিশিষ্ট আহ্বায়ক কমিটি গঠন করা হয়। তিন মাসের জন্য করা কমিটি ১১ মাস পর ২০২৩ সালের ১৫ মে ‘বিশেষ পরিস্থিতির কারণে’ সিটি করপোরেশন নির্বাচনের প্রচার চলাকালে বিলুপ্ত করা হয়।
২০২৩ সালের মে মাসে বরিশাল সিটি করপোরেশনের নির্বাচনের প্রচার চলছিল। তখন মেয়র পদে আওয়ামী লীগের মনোনীত প্রার্থী আবুল খায়ের আব্দুল্লাহ খোকন সেরনিয়াবাতের পক্ষে নৌকার প্রচারে থাকা দুই কর্মীকে অস্ত্র ঠেকিয়ে হত্যার হুমকি দেওয়ার অভিযোগ ওঠে।
ওই ঘটনায় ৭ মে বরিশাল মহানগর পুলিশের কাউনিয়া থানায় মহানগর ছাত্রলীগের আহ্বায়ক রইজ আহম্মেদ মান্নাসহ তার সহযোগীদের বিরুদ্ধে জিডি হয়। এর এক সপ্তাহ পর ১৪ মে সন্ধ্যায় নগরীর কাউনিয়া এলাকায় নৌকার পক্ষে প্রচারে থাকা চার কর্মীকে অস্ত্রের বাঁট দিয়ে মাথায় আঘাত করাসহ হকিস্টিক ও রড দিয়ে পিটিয়ে জখমের ঘটনায় একই থানায় আরেকটি মামলা হয়।
ওই মামলার আসামি সাদিক আব্দুল্লাহর অনুসারী হিসেবে পরিচিত মহানগর ছাত্রলীগের আহ্বায়ক রইজ আহম্মেদ মান্নাসহ ১৩ সহযোগীকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ কারাগারে পাঠায়।
পরদিন ১৫ মে ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় সভাপতি সাদ্দাম হোসেন ও সাধারণ সম্পাদক শেখ ওয়ালী আসিফ ইনান স্বাক্ষরিত এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বরিশাল মহানগর কমিটি বিলুপ্ত ঘোষণা করা হয়।
কমিটি বিলুপ্তির কারণ হিসেবে তখন ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক শেখ ওয়ালী আসিফ ইনান সাংবাদিকদের বলেছিলেন, “মহানগর ছাত্রলীগের সম্মেলন প্রস্তুত করার জন্য তিন মাসের জন্য কমিটি করা হয়েছিলো। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশনা অনুযায়ী সংগঠনের কার্যক্রম ত্বরান্বিত করতে কমিটি বিলুপ্ত করা হয়।”
এরপর ১৩ মাস কেটে গেলেও বরিশাল মহানগরে আর কোনো কমিটি গঠন করা হয়নি। কবে নাগাদ নতুন করে কমিটি হবে, সেই ধারণাও দিতে পারেননি ছাত্রলীগ ও আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা।
এক বছরের বেশি সময় ধরে কমিটি না থাকাকে ‘চলন্ত ট্রেন থামিয়ে দেওয়ার মত’ বলে বর্ণনা করেছেন বরিশাল মহানগর ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি মো. জসিম উদ্দিন। ছাত্র রাজনীতি থেকে ওঠে আসা জসিম কয়েকদিন আগেই বরিশাল সদর উপজেলার ভাইস চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছেন।
আমির হোসেন আমু, তোফায়েল আহমেদ, জাহাঙ্গীর কবির নানক, বলরাম পোদ্দার, শাম্মী আহম্মেদসহ কেন্দ্রীয় কমিটি অনেক নেতা বরিশাল ছাত্রলীগের মাধ্যমে রাজনীতি শুরু করেন। ছাত্রলীগের রাজনীতির মাধ্যমে তারা এখন মন্ত্রীসহ দলের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করছেন।
এখন সেই জায়গায় দিনে দিনে ঘাটতি তৈরি হচ্ছে বলে মনে করেন জসিম। তিনি বলছিলেন, “ছাত্রলীগ হচ্ছে একটি চলন্ত ট্রেন। এ ট্রেন থামিয়ে দেওয়ার পর সেটা কাভার করা কষ্টকর হয়ে পড়ে। নেতা তৈরি হয় না। নেতৃত্বে দেওয়ার মত কর্মী আসে না। এটার প্রভাব এখন হয়ত বোঝা যাবে না। কিন্তু ভবিষ্যতে ঠিকই পড়বে।”
সাবেক এই ছাত্রনেতা বলেন, “দ্রুতই সম্মেলন হোক এটা সব কর্মীই চায়। কিন্তু অছাত্র ও অসাংগঠনিক নেতা দিয়ে কোনো কমিটি গঠন করা যাবে না। কেন্দ্রীয় নেতাদের উচিত বিষয়টি নিয়ে দ্রুত সিদ্ধান্ত নেওয়া।”
ছাত্রলীগের রাজনীতি থেকেই উঠে এসেছেন বরিশাল জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান ও মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি এ কে এম জাহাঙ্গীর। তিনি বলছিলেন, “ছাত্রলীগের বিলুপ্ত হওয়া কমিটি নগরীর ৩০টি ওয়ার্ড কমিটি করেছে। তাদের কার্যক্রম চলমান রয়েছে। ছাত্রলীগের কার্যক্রম সক্রিয় রাখতে তারা কাজ করছে।
“তবু কমিটি না থাকলে তো একটু সমস্যা হয়। সমস্যা থেকে বের হওয়ার জন্য আমরা চেষ্টা করছি।”
বরিশাল মহানগর ছাত্রলীগের কমিটিতে পদপ্রত্যাশী রেজওয়ানুর রহমান নিয়ন বলেন, “আমরাও চাই দ্রুত সময়ের মধ্যে কমিটি হোক। সংগঠনের কার্যক্রমে গতিশীলতা আসুক।”
তিনি বলেন, “এরই মধ্যে কেন্দ্রীয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক শেখ ওয়ালী আসিফ ইনান ভাই বলেছেন, দ্রুত সময়ের মধ্যে কমিটি দেবেন। তার ওপর আমাদের আস্থা রয়েছে। তিনি দ্রুত কমিটি করে দেবেন।”
তবে ছাত্রলীগের একজন নেতা বলেন, “কমিটি গঠন করতে হলে কে কার অনুসারী সেই বিবেচনা করা হয়। স্থানীয় রাজনীতিতে যে প্রভাবশালী তার ঘনিষ্ঠ অনুসারীদের নিয়ে কমিটি গঠনের তোড়জোড় শুরু হয়।
“বর্তমানে বরিশালের রাজনীতিতে নেতার সংখ্যা বেড়েছে। তেমনি অনুসারীরা সংখ্যাও বেড়েছে। একেক নেতা নিজেদের অনুসারীদের কমিটিতে রাখার জন্য ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির নেতাদের কাছে সুপারিশ করেন। ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির নেতারা তখন বিপাকে পড়েন। কারো বিরাগভাজন তারা হতে চান না। এ কারণে হয়তো চুপ হয়ে গেছেন।”
এ ধরনের অবস্থানকে ‘দুঃখজনক’ বলে মন্তব্য করেছেন বরিশাল মহানগর আওয়ামী লীগের জ্যেষ্ঠ সহসভাপতি আফজালুল করিম। তিনি বলেন, “ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সাবেক সভাপতি আল নাহিয়ান খান জয়, বর্তমান সাধারণ সম্পাদক শেখ ওয়ালী আসিফ ইনানের মত নেতা থাকতেও এখানে কমিটি-শূন্য, এটা দুঃখজনক।”
“মহানগর ছাত্রলীগের কমিটি শূন্য কেন রাখা হয়েছে- সেটা কেন্দ্রীয় নেতারা ভালো বলতে পারবেন”, বলেন আফজালুল করিম।
তিনি বলেন, “বরিশাল আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে একটি চক্র রয়েছে। যারা সিটি ও সংসদ নির্বাচনে নৌকা প্রতীকের বিরোধিতা করেছেন। তারাই নতুন নেতৃত্ব তৈরি হোক সেটা চায় না। দ্রুত এ থেকে বেরিয়ে কেন্দ্রীয় নেতাদের কমিটি দেওয়া উচিত।
এসব বিষয়ে জানতে চাইলে ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক শেখ ওয়ালী আসিফ ইনান নিজের শহরে ছাত্রলীগের কমিটি না থাকা ‘দৃষ্টিকটু ও বিব্রতকর’ বলে স্বীকার করেন। তিনি বলেন, “আমরা দ্রুত সময়ের মধ্যে কমিটি দেওয়ার চেষ্টা করব।”
পুরনো খবর