“এখানে অনেক যান্ত্রিক বিষয় থাকে, সঞ্চালন লাইনের দুর্বলতা রয়েছে। এসব কারণে কিছু লোডশেডিং হয়তো হতে পারে,” বলেন পিডিবি চেয়ারম্যান।
Published : 26 Apr 2025, 02:04 AM
তাপপ্রবাহ নিয়ে শুরু হওয়া এপ্রিল জুড়ে কেবল মৃদু নয়, মাঝারি ও তীব্র তাপপ্রবাহ বয়ে যাওয়ার পূর্বাভাস আবহাওয়া অফিস দিলেও গরমের তীব্রতা এখনো অসহনীয় হয়ে ওঠেনি, যেমনটা হয়েছিল গত বছর।
এবার বৈশাখী উৎসব কিংবা তার আগে রোজার মাসেও বিদ্যুৎ বিভ্রাটে খুব একটা ভোগান্তি পোহাতে হয়নি।
রোজার আগেই ফেব্রুয়ারি মাসে গ্রীষ্ম ও সেচ মওসুমে বিদ্যুৎ পরিস্থিতি কেমন হতে পারে, ঘাটতি মোকাবিলায় কী করা যায়, সে সব নিয়ে আন্তমন্ত্রণালয় সভা করেছিলেন বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান।
চাহিদা ও উৎপাদন ঘাটতির ফারাকে আসন্ন গরমের মওসুমে সর্বোচ্চ ১৪০০ মেগাওয়াট বিদ্যুতের লোডশেডিং হতে পারে বলে আভাস দিয়েছিলেন তিনি।
গরমের সময়ে বিদ্যুতের বাড়তি চাহিদা থাকে, যা পূরণে যথেষ্ট উৎপাদনের প্রস্তুতিও রয়েছে বলে দাবি করছে সরকার।
এ সময় শোডশেডিং হলে আগে শহরেই হবে বলে আশ্বস্ত করেছেন জ্বালানি উপদেষ্টা।
উপদেষ্টা বলেছিলেন, “গ্রীষ্ম ও সেচ মওসুমে বিদ্যুতের চাহিদা প্রাক্কলন করা হয়েছে ১৮ হাজার মেগাওয়াট। এর মধ্যে কুলিং (এসি) লোড রয়েছে ৬ হাজার মেগাওয়াট। বিভিন্ন কারণে ৭০০-১৪০০ মেগাওয়াট লোডশেডিং করতে হতে পারে।”
সামনে মে-জুন মাসে তীব্র গরমের সম্ভাবনা থাকলেও তা ভোগান্তিহীনভাবে পার করা সম্ভব বলে আশ্বস্ত করছে কর্তৃপক্ষ।
বিদ্যুৎ বিভাগের কর্মকর্তারা বলছেন, লোডশেডিং যাতে না হয়, সে অনুযায়ী কাজ করছেন তারা। তবুও যান্ত্রিক ত্রুটি বা অন্য কোনো সমস্যার কারণে বাড়তি চাহিদার সময় হয়তো শোডশেডিং এক হাজার মেগাওয়াটের কাছাকাছি পৌঁছে যেতে পারে।
গত বছর ২০ এপ্রিল দেশের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াসে পৌঁছে গিয়েছিল। আর চলতি বছর এপ্রিলে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা এখনো ৪০ ডিগ্রিতে পৌঁছায়নি।
যদিও এপ্রিলে কয়েক বার দেশের বিভিন্ন এলাকায় মৃদু দাবদাহ বয়ে গেছে। আবার বৃষ্টিও হয়েছে কয়েক দফা।
তাপমাত্রা বেড়ে গেলে বিদ্যুতের চাহিদাও বেড়ে যায়। গত বছর তীব্র দাবদাহের সময় বিদ্যুতের চাহিদা ১৮ হাজার মেগাওয়াটে পৌঁছে গিয়েছিল। চলতি বছরেও ১৮ হাজার ৫০০ মেগাওয়াট বা তার চেয়ে কিছুটা বেশি চাহিদা হতে পারে বলে ধারণা করছে বিদ্যুৎ বিভাগ।
বিদ্যুৎখাতে সরকারের সর্বোচ্চ পরিচালন কোম্পানি বাংলাদেশ পাওয়ার ডেভেলপমেন্ট বোর্ড–পিডিবি চেয়ারম্যান মো. রেজাউল করিম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “চাহিদা যতই হোক, তা পূরণ করার সক্ষমতা আমাদের রয়েছে। সুতরাং তীব্র গরমে লোডশেডিং দিতে হবে বলে আমরা মনে করি না।
“তবে এখানে অনেক যান্ত্রিক বিষয় থাকে, সঞ্চালন লাইনের দুর্বলতা রয়েছে। এসব কারণে কিছু লোডশেডিং হয়ত হতে পারে। আমাদের চেষ্টা থাকবে লোডশেডিং মুক্তভাবে এবারের গরমের মওসুম পার করা।”
২০২০ সালের ৩০ এপ্রিল রেকর্ড ১৬ হাজার ৪৭৭ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে পেরেছিল বাংলাদেশ। তখন সর্বোচ্চ চাহিদা ছিল ১৭ হাজার মেগাওয়াট। ফলে ওই মুহূর্তেও প্রায় ৫০০ মেগাওয়াট লোডশেডিং ছিল।
গত বছর বাড়তি চাহিদার সময়ে দুই হাজার থেকে তিন হাজার মেগাওয়াট পর্যন্ত লোডশেডিং হয়েছিল বিদ্যুতের। ফলে গ্রাম থেকে শহর, সব জায়গায় সর্বোচ্চ সময় বিদ্যুতবিহীন অবস্থায় থাকতে হয়েছিল গ্রাহকদের।
সরকারের সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, দেশে এখন ক্যাপটিভ ও নবায়নযোগ্যসহ বিদ্যুতের মোট উৎপাদন সক্ষমতা ৩০ হাজার ৯৯৯ মেগাওয়াট। গ্রাহক সংখ্যা ৪ কোটি ৮১ লাখ। দেশের শতভাগ মানুষ বিদ্যুৎ সুবিধার আওতায় আছে। এর মধ্যে ৬০ লাখ পরিবার সৌর বিদ্যুৎ ব্যবহার করছে।
পরিস্থিতি কতটা স্বস্তিকর?
সরকারি প্রস্তুতির দিক থেকে এবং পরিবেশ পরিস্থিতিগত দিক থেকে এবার বিদ্যুৎ পরিস্থিতি অনেকটা স্বস্তিকর বলেই মনে করছেন ঢাকার বাসিন্দারা। তবে গ্রামাঞ্চলের চিত্র ভিন্ন। দিনের বেশির ভাগ সময় বিদ্যুৎ থাকে না, এমন ভোগান্তিও আছে কোনো কোনো এলাকায়।
ঢাকা শহরের কিছু কিছু এলাকায় গত কয়েক সপ্তাহে দিনে দুই-একবার করে বিদ্যুৎ গেছে, আবার আধা ঘণ্টা কিংবা এক ঘণ্টার মধ্যে ফিরে এসেছে। যদিও গত বছর দিনে তিন-চার বার করেও বিদ্যুৎ চলে যেত।
উত্তরাঞ্চলের জেলা জয়পুরহাট শহরের বাসিন্দা রেহেনা বেগম মনে করেন, গত বছরের তুলনায় চলতি বছর এখন পর্যন্ত বিদ্যুৎ পরিস্থিতি যথেষ্ট ভালো।
তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডট্কমকে বলেন, “দিনে একবারের জন্যও বিদ্যুৎ যাচ্ছে না। আর গত বছর গরমের সময় সন্ধ্যা থেকে রাত ১১টা পর্যন্ত বিদ্যুৎ থাকত না। অনেক সময় দিনের বেলায়ও বিদ্যুৎ চলে যেত।”
তবে নরসিংদী জেলার বেলাব এলাকার বাসিন্দা নাজমুন নাহার তাদের এলাকায় বিদ্যুৎ পরিস্থিতি গতবছরের চেয়েও খারাপ বলে জানালেন।
তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডট্কম বলেন, “বিদ্যুৎ চলে গেলে এক ঘণ্টায়ও ফিরে না আর।”
নোয়াখালী শহরতলীর একটি ইউনিয়নের বাসিন্দা জাকির হোসেন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, গত এক সপ্তাহ ধরে বিদ্যুৎ যাওয়া আসার মাত্রাটা বেড়েছে। তবে পরিস্থিতি গত বছরের মত ‘ভয়াবহ নয়’। দিনে দুই-একবার বিদ্যুৎ যাচ্ছে, আবার ঘণ্টাখানেক পর ফিরে আসছে।
“গত বছর ২৪ ঘন্টার মধ্যে ১২ ঘন্টাই বিদ্যুৎ থাকত না।”
টাঙ্গাইলের ধনবাড়ী উপজেলার বাসিন্দা আব্দুর রশীদ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, এবার গরমের মৌসুমে এখন পর্যন্ত লোডশেডিংয়ের ভোগান্তি অতটা পোহাতে হয়নি।
“গত বছর গরম বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে লোডশেডিং অনেক বেড়ে গিয়েছিল। দিনে ৪/৫ বার করে বিদ্যুৎ চলে যেত, ফিরত কয়েক ঘণ্টা পর। এবার মাঝে মধ্যে বিদ্যুৎ গেলে এক ঘণ্টারও কম সময়ের মধ্যে ফিরে আসে।”
তুলনামূলক চিত্র
পাওয়ার গ্রিড বাংলাদেশ এর তথ্য বলছে, ২০২৪ সালের ২১ এপ্রিল রাত ১টায় ১৪ হাজার ২৮৮ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে হয়েছিল। ওই সময় চাহিদা ছিল ১৫ হাজার ৩০০ মেগাওয়াট। ফলে ৯৬৬ মেগাওয়াটের লোডশেডিং দেখা গিয়েছিল।
ওই সময় গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে ৭ হাজার ৮২১ মেগাওয়াট, তরল জ্বালানি থেকে ১ হাজার ৬৫৫ মেগাওয়াট, কয়লাভিত্তিক কেন্দ্র থেকে ৩ হাজার ৭২৯ মেগাওয়াট, জলবিদ্যুৎ থেকে ৩০ মেগাওয়াট, বায়ু কেন্দ্র থেকে ১৬ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ এসেছিল।
সেই সময় ভারতের আদানি পাওয়ার থেকে কোনো বিদ্যুৎ আসছিল না। তাপমাত্রা ছিল উত্তপ্ত, গ্রাম কিংবা শহরে কিছুক্ষণ পর পর বিদ্যুৎ আসা-যাওয়ার ফলে অস্বস্তিকর পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছিল তখন।
পাওয়ার গ্রিড বাংলাদেশ এর তথ্য অনুযায়ী, এক বছর পর ২০২৫ সালের একই দিন রাত ১টায় বিদ্যুৎ উৎপাদন হয়েছে ১৪ হাজার ৪২০ মেগাওয়াট। এই সময়ে চাহিদা ছিল ১৪ হাজার ৬৫০ মেগাওয়াট।
অর্থাৎ আগের বছরের চেয়ে এ বছর এই দিনে লোডশেডিং হয়েছে ২২০ মেগাওয়াট। লোডশেডিং কমেছে ৭৬ শতাংশ।
গত বছরের মার্চ ও এপ্রিল মাসে লোডশেডিংয়ে অতিষ্ঠ ছিল মানুষ। এ বছর এ সময়ে গরমের তীব্রতা যেমন কম, তেমনি বিদ্যুতের যোগানও ভালো।
শুক্রবার রাজশাহীতে দেশের সর্বোচ্চ ৩৯ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা রেকর্ড করেছে আবহাওয়া অফিস। ঢাকায় সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ছিল ৩৪. ৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস।
আর একবছর আগে এই দিনে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ছিল ৪১ দশমিক ৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস, ঢাকার সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ছিল ৩৯ দশমিক ২ ডিগ্রি সেলসিয়াস।
সপ্তাহের শেষ কর্মদিবস বৃহস্পতিবার রাত ৯টার (সন্ধ্যার পিক আওয়ার) হিসাব অনুযায়ী, ওই সময় সারাদেশে বিদ্যুতের চাহিদা ছিল ১৬ হাজার ৫০ মেগাওয়াট, যার বিপরীতে যোগান দেওয়া গেছে ১৫ হাজার ৮৬৭ মেগাওয়াট। ফলে ওই সময়ে ১৭৫ মেগাওয়াটের ঘাটতি ছিল, যা লোডশেডিংয়ের মাধ্যমে সমন্বয় করা হয়েছে।
ওই সময় মোট উৎপাদনের ক্ষেত্রে গ্যাসভিত্তিক উৎস থেকে ৫ হাজার ৯৮৯ মেগাওয়াট, তরল জ্বালানিভিত্তিক উৎস থেকে তিন হাজার ৬২৬ মেগাওয়াট, কয়লাভিত্তিক উৎস থেকে তিন হাজার ৮৭৩ মেগাওয়াট, জলবিদ্যুৎ থেকে ৪০ মেগাওয়াট, বায়ু বিদ্যুৎ থেকে ২০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ পাওয়া গেছে।
এছাড়া ভারতীয় উৎসের মধ্যে কুষ্টিয়ার ভেড়ামারা লাইন হয়ে ৯১৫ মেগাওয়াট, ত্রিপুরা-কুমিল্লা লাইন হয়ে ৩৮ মেগাওয়াট এবং আদানির ঝারখণ্ড বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে ১৩৬৬ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ মিলেছে।
পিডিবির সদস্য (উৎপাদন) মো. জহুরুল ইসলাম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “এ বছর বিদ্যুতের চাহিদা ১৮ হাজার মেগাওয়াট হয়ে যেতে পারে বলে পূর্বাভাস রয়েছে। পুরো চাহিদা মোকাবেলা করার সক্ষমতা এবং প্রস্তুতিও আছে।
“গ্যাসভিত্তিক কেন্দ্রগুলোতে বিদ্যুৎ উৎপাদন খরচ সবচেয়ে কম। সেজন্য আমরা গ্যাসভিত্তিক কেন্দ্র থেকে উৎপাদন বাড়ানোর পরিকল্পনায় করেছি। চাহিদা পূরণে এবার গ্যাস থেকে ৬ হাজার মেগাওয়াটেরও বেশি বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হবে। ক্রমান্বয়ে কয়লাভিত্তিক ও তরল জ্বালানিভিত্তিক বিদ্যুতের ওপর গুরুত্ব দেওয়া হবে।”
এবার লোডশেডিংয়ের পূর্বাভাস সম্পর্কে তিনি বলেন, “পরিকল্পনা যাই থাকুক বিদ্যুতের চাপ বেড়ে গেলে যান্ত্রিক ত্রুটি দেখা দিতে পারে। ত্রুটির কারণে হয়তো এক হাজার বা তার চেয়েও কিছুটা বেশি লোডশেডিং হতে পারে। তবে এগুলো পূর্বানুমানের সুযোগ নেই। আমরা চেষ্টা করবো যাতে কোনো লোডশেডিং না হয়।”
পুরনো খবর:
লোড শেডিং হলে ঢাকায় আগে হবে: জ্বালানি উপদেষ্টা
গ্রীষ্মে দেড় হাজার মেগাওয়াট লোডশেডিংয়ের আভাস বিদ্যুৎ উপদেষ্টার