বিভিন্ন খালে বাঁশের অস্থায়ী বেড়া দিয়ে রেখেছে সিটি করপোরেশন। সেগুলোও বেশির ভাগ নষ্ট হয়ে গেছে।
Published : 20 Apr 2025, 02:00 AM
চট্টগ্রাম নগরীর ‘অরক্ষিত’ খাল-নালায় পড়ে ৯ বছরে অন্তত ১৩ জনের মৃত্যু হয়েছে, যাদের কারও কারও লাশও খুঁজে পাওয়া যায়নি। সাত মাসের আরেকটি শিশুর মৃত্যুর পর সামনে এসেছে নগরীর জলাবদ্ধতার কারণ হয়ে দাঁড়ানো এসব খাল নিরাপদ হবে কবে।
চার বছর আগে দেওয়া নিরাপত্তা বেষ্টনীর আশ্বাস যথাযথ বাস্তবায়ন হলে এসব মৃত্যু এড়ানো যেত বলে নগরবাসীর পাশাপাশি মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
দাবি উঠেছে প্রাণহানির কারণ হয়ে দাঁড়ানো এসব বিপৎজনক খাল ও নালাকে নিরাপদ করতে বেষ্টনী দেওয়ার।
গত শুক্রবার রাতে নগরীর কাপাসগোলা এলাকায় হিজড়া খালে রিকশা থেকে পড়ে নিখোঁজ হয় সাত মাসের শিশু শেহেরিজ। পরের দিন সকালে চাক্তাই খালের শুটকি পট্টি এলাকায় শেহেরিজের লাশ দেখতে পান স্থানীয়রা। এ খবর সামনে আসার পর এ নিয়ে আবারও আলোচনা শুরু হয় বন্দরনগরীতে।
বছর কয়েক ধরেই বর্ষা এলে খাল-নালাগুলো নগরবাসীর জন্য দুর্ভোগের কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে। সামান্য বৃষ্টিতেই ময়লা আবর্জনায় প্রায় ভরাট হয়ে থাকা এসব খাল-নালা জলাবদ্ধতা তৈরির পাশাপাশি প্রাণঘাতিও হয়ে উঠছে।
২০২১ সালের ২৫ অগাস্ট নগরীর মুরাদপুর মোড়ে জলাবদ্ধতার মধ্যে ‘চশমা খালে’ পা পিছলে পড়ে তলিয়ে যান সবজি বিক্রেতা ছালেহ আহমেদ। তার লাশ আর পাওয়া যায়নি।
ওই ঘটনার পর নগরীর খালের পাড়ে বেড়া ও নালায় স্ল্যাব বসানোর আশ্বাস দিয়েছিল চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন (সিসিসি) এবং নগরীর জলাবদ্ধতা নিরসন প্রকল্পের দায়িত্বে থাকা ব্যক্তিরা।
এরপর চার বছর পেরিয়ে গেছে; খালে পড়ে আরও আটজনের প্রাণও গেছে, কিন্তু এখনো নগরীর সবগুলো খালে বেষ্টনী বসেনি।
প্রাণহানির পর দুর্ঘটনার কারণ হয়ে দাঁড়ানো কিছু খালে দেয়াল দিয়ে খোলা অংশ বন্ধ করা হয়েছে। কিছু খালে বাঁশ দিয়ে অস্থায়ী বেড়া দিয়ে রেখেছে সিটি করপোরেশন। সেগুলোরও বেশির ভাগ নষ্ট হয়ে গেছে।
নয় বছরে যত মৃত্যু
২০১৭ সালের ২ জুলাই এম এম আলী সড়কে রয়েল গার্ডেন কমিউনিটি সেন্টারসংলগ্ন বড় নালায় পড়ে তলিয়ে যান সাবেক সরকারি কর্মকর্তা শীলব্রত বড়ুয়া (৬২)। পরদিন প্রায় ছয় কিলোমিটার দূরে মিয়াখান নগরে চাক্তাই খালে তার লাশ পাওয়া হয়।
২০১৮ সালের ৯ জুন আমিন জুট মিল এলাকায় নালায় পড়ে ৭ বছরের শিশু মো. আল আমীনের মৃত্যু হয়।
২০২১ সালের ৩০ জুন নগরীর মেয়র গলি এলাকায় চশমা খালে পড়ে মারা যান সিএনজিচালিত অটোরিকশার চালক সুলতান (৩৫) ও যাত্রী খাদিজা বেগম (৬৫)।
ওই বছরের ২৫ অগাস্ট নগরীর মুরাদপুর মোড়ে চশমা খালে পা পিছলে তলিয়ে যাওয়া সবজি বিক্রেতা ছালেহ আহমেদের আর খোঁজ মেলেনি।
একই বছরের ২৭ সেপ্টেম্বর নগরীর আগ্রাবাদ মাজার গেট এলাকায় ফুটপাত ধরে হেঁটে যাওয়ার সময় পা পিছলে নাছির ছড়া খালে পড়ে মৃত্যু হয় বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রী শেহেরীন মাহমুদ সাদিয়ার।
এরপর ২০২১ সালের ৬ ডিসেম্বর একই খালে তলিয়ে যায় শিশু মো. কামাল উদ্দিন। তিন দিন পর নগরীর মির্জা খাল থেকে তার লাশ উদ্ধার হয়।
নালায় শিশু মৃত্যুর দায় এড়াতে পারি না: মেয়র শাহাদাত
২০২৩ সালের ৭ অগাস্ট চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের ১ নম্বর পাহাড়তলী ওয়ার্ডের ফতেহপুর ইসলামিয়া হাটসংলগ্ন বাদামতলা এলাকায় বৃষ্টির মধ্যে নালায় পড়ে মৃত্যু হয় কলেজছাত্রী নিপা পালিতের (২০)।
এরপর নগরীর উত্তর আগ্রাবাদের রঙ্গীপাড়ায় নালায় পড়ে নিখোঁজ হয় দেড় বছরের শিশু ইয়াছিন আরাফাত।
২০২৩ সালের ২৭ অগাস্টের ওই ঘটনায় শিশুটির লাশ মেলে ১৬ ঘণ্টা পর; নালার আবর্জনার নিচে।
পরের বছরের ২৭ মে ঘূর্ণিঝড় রেমালের প্রভাবে ভারি বর্ষণ ও জোয়ারের মধ্যে নগরীর আছাদগঞ্জ শুটকিপল্লী এলাকায় কলাবাগিচা খালে পড়ে মারা যান নগরীর ইসলামিয়া কলেজের ইংরেজি দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী আজিজুল হাকিম।
একই বছরের ৯ জুন নগরীর আগ্রাবাদে নাছির খালে পড়ে মারা যায় সাইদুল ইসলাম নামে সাত বছরের এক শিশু।
২০২৪ সালের ১১ জুন চাক্তাই খালের স্লুইস গেট এলাকায় এক শিশু নিখোঁজ হয়, ১৪ ঘণ্টা পর তার লাশ উদ্ধার হয় রাজাখালী খাল থেকে।
হিজড়া খালে বেড়া ছিল
সাত মাসের শেহেরিজ তার মা ও দাদির সঙ্গে নগরীর কাপাসগোলায় ফুফুর বাসায় যাচ্ছিল। গলিতে পানি ওঠায় সিএনজি অটোরিকশা থেকে নেমে ব্যাটারিচালিত রিকশায় করে যাওয়ার সময় সেটি খালে পড়ে গেলে সে নিখোঁজ হয়।
খালে পড়ে যান শেহেরিজে মা-দাদিও। স্থানীয়রা খালে নেমে তাদের উদ্ধার করে।
নিখোঁজ শেহেরিজের লাশ ১৪ ঘণ্টা পর শনিবার সকাল ১০টার দিকে নগরীর কোতয়ালী থানাধীন চাক্তাই খালের শুঁটকিপট্টি অংশ থেকে উদ্ধার করেন স্থানীয়রা।
শুক্রবার রাতে ঘটনাস্থলে যান মেয়র শাহাদাত হোসেন। শনিবার শিশুটির লাশ উদ্ধারের পর চাক্তাই শুটকি পট্টি এলাকায় যান তিনি।
সেখানে সাংবাদিকদের প্রশ্নে মেয়র বলেন, “হিজড়া খাল থেকে ডাইভারশন খাল হয়ে রাজাখালী খালে চলে এসেছে। তিন দিন আগে সেনাবাহিনী খালটি পুরো পরিষ্কার করেছে। স্রোত ছিল বেশি। এটার গভীরতা ছিল ১২ ফুটের বেশি।
“হিজড়া খালে গতকাল (শুক্রবার) দুর্ঘটনা হয়েছে। সেনাবাহিনী যখন কাজ করতে গেছে তিন-চারদিন আগে, সেখানে আমরা যে ব্যারিকেড একটা দিয়েছিলাম, যেহেতু রিটেইনিং ওয়াল এখনো হয়নি, সেটার পরিবর্তে বাঁশের একটা ব্যারিকেড আমরা দিয়েছিলাম সিটি করপোরেশনের পক্ষ থেকে। সেই ব্যরিকেডটা ভেঙে তারা কাজ করেছে। কাজ করার জন্যই সেটা ভেঙেছে।”
চট্টগ্রামে রিকশা পড়ল নালায়, তলিয়ে গেল ৭ মাসের শিশু
চট্টগ্রামে নালায় নিখোঁজ শিশুর লাশ মিলল ১৪ ঘণ্টা পর
চট্টগ্রামে জলাবদ্ধতা নিরসনে ৩৬টি খাল নিয়ে চলমান মেগা প্রকল্পের ভৌত কাজ পরিচালনা করছে সেনাবাহিনীর ৩৪ কনস্ট্রাকশন ব্রিগেড।
সিডিএর জলাবদ্ধতা নিরসন প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালক লেফটেনেন্ট কর্নেল মো. ফেরদৌস আহমেদ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “গতকাল (শুক্রবার) সন্ধ্যায় ভারি বৃষ্টি হয়। এটা প্রাকৃতিক ঘটনা।
“গতকাল যা ঘটেছে, তা দুর্ভাগ্যজনক। হয়ত হিজড়া খালে ঘটনাটি হয়েছে, যেকোনো খালে ঘটতে পারত। এর জন্য কাকে দায়ী করবেন?”
তিনি বলেন, “৩৬টি খালের মধ্যে আমাদের ২৫টি খালের কাজ শেষ। পাঁচটি খালের ৯০ শতাংশের বেশি কাজ হয়ে গেছে। বাকিগুলো আগামী বছরের মধ্যে শেষ হবে। হিজড়া খালে জমি অধিগ্রহণসহ কিছু জটিলতা আছে; তাই কাজ শেষ করতে সময় লাগছে।”
খালের দুই পাড় দখল হয়ে যাওয়ার বিষয়টি তুলে ধরে প্রকল্প পরিচালক বলেন, “খালের জমিতেই স্থাপনা নির্মাণ করা হয়েছে। তাই খালের কাজ করতে হলে আমাদের আংশিক খাল ভরাট করে তারপর কাজ এগিয়ে নিতে হচ্ছে।
“ফলে ১৮-২০ ফুট চওড়া একটি খালের পুরো পানি যখন সরু একটি অংশ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে, তখন আশপাশে গলি ও সড়কে পানি উঠছে। এত ক্ষুদ্র অংশ দিয়ে পুরো খালের পানি যেতে পারে না।”
কর্তৃপক্ষ এখন বলছে, চট্টগ্রামে খালের পাড়ে বেড়া হবে, নালার ওপর স্ল্যাব
চট্টগ্রামে অটোরিকশা ড্রেনে পড়ে চালক ও যাত্রী নিহত
টানা বৃষ্টি না হলে বর্ষা শুরুর আগেই ৩০ এপ্রিলের মধ্যে কাজ শেষ করার আশা তার।
এই প্রকল্পের আগের প্রকল্প পরিচালক মো. শাহ আলী বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেছিলেন, “প্রকল্পে ফেন্সিং নেই। খালের পাশে রাস্তা ও ফুটপাত করা হবে। তবে জনবহুল এলাকায় খালের পাড়ে রেলিং করে দেব, যেন খালে কেউ পড়ে না যায়।
“রেলিংয়ে লাইটিং করা হবে, যেন সবার চোখে পড়ে। সেটা করা হবে খালের ‘রিটেইনিং ওয়ালের’ কাজ শেষ হলে। যেখানে চলাফেরা খুব কম, সেখানে করা হবে না।”
নতুন প্রকল্প প্রয়োজন
ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশন বাংলাদেশ চট্টগ্রাম কেন্দ্রের সাবেক সভাপতি প্রকৌশলী দেলোয়ার মজুমদার বলেন, এক দশক ধরে খালে বেষ্টনীর দাবি জানানো হলেও কেউ তা কর্ণপাত করছে না।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “আমরা বারবার বলেছি, সড়কের পাশের খালগুলোতে যেন ফেন্সিং করে দেওয়া হয়। চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনকে প্রস্তাবও দিয়েছি এ কাজের জন্য পৃথক একটি প্রকল্প করে সরকার থেকে তহবিল নেওয়ার জন্য।
“চট্টগ্রাম নগরী সারাদেশকে সার্ভ করছে। রাষ্ট্রেরও দায়িত্ব আছে এই নগরীর জন্য কিছু খরচ করার। বর্তমান মেয়র উদ্যোগ নিলে আশা করি সফল হতে পারবেন।”
শিশু শেহরিজের মৃত্যু নিয়ে এই প্রকৌশলী বলেন, “একটি প্রাণ অঙ্কুরেই শেষ হয়ে গেল। এ ঘটনায় সবার হৃদয়ে রক্তক্ষরণ হচ্ছে। এসব ক্ষোভ পুঞ্জীভূত হয়ে যেকোনো সময় বিস্ফোরণ হতে পারে; তাই দ্রুত প্রতিকারের ব্যবস্থা করা উচিত।
বিয়ের অনুষ্ঠানে এসে নালায় পড়ে প্রাণ গেল বৃদ্ধের
জলজটের চট্টগ্রামে নালায় পড়ে বৃদ্ধ নিখোঁজ
“অনেক খালে প্রকল্পের কাজ শেষ হওয়ায় এখন প্রচণ্ড গতিতে পানি নামে। বেষ্টনী থাকলে গতকাল ওই রিকশা হয়ত খালে পড়ে যেত না। দ্রুত বেষ্টনীর ব্যবস্থা করা উচিত। শেহরিজের মৃত্যুই যেন শেষ ঘটনা হয়। কর্তৃপক্ষের টনক নড়া উচিত।”
এ বিষয়ে সিটি মেয়র বলেন, “সেনাবাহিনীর ৩৪ ব্রিগেড বিভিন্ন জায়গায় কাজ করার জন্য খালের ভেতরে বাঁধ দিচ্ছে। বিভিন্ন জায়গায় পানি উঠে যাচ্ছে। এটা হয়ত সাময়িক। এটা থেকে ভালো একটা ফল হয়ত আমরা পাব।
“কিন্তু সাময়িক কাজ করতে গিয়ে যদি প্রিভেন্টিভ মেজারসগুলো ভেঙে দেয়া হয়, তাহলে হয় সঙ্গে সঙ্গে তাদের করতে হবে; নয়ত আমাদের একটু ইনফর্ম করতে হবে।”
শুক্রবারের ঘটনার পর শনিবার দুপুরের মধ্যে কাপাসগোলায় হিজড়া খালের ওই অংশে আবার বাঁশ দিয়ে বেড়া তৈরি করে দেয় সিটি করপোরেশন।