“ছেলেরা নানা আসক্তি ও গ্যাংবাজিতেও ঢুকে যাচ্ছে। এখান থেকে ফেরাতে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোকে দায়িত্ব নিতে হবে। শিক্ষকরা যদি দক্ষ হতেন, শিক্ষার্থীবান্ধব হতেন; তাহলে তো পরিস্থিতি এমন হয় না।”
Published : 18 May 2024, 01:35 AM
পড়ালেখা চালিয়ে যেতে পারলে এ বছর অন্য ২০ লাখ শিক্ষার্থীর মত এসএসসি পরীক্ষায় বসার কথা ছিল বরিশালের মেহেন্দিগঞ্জের উলানিয়ার শরীফের। কিন্তু এক সময়ের সহপাঠীরা যখন পরীক্ষার ফলাফল আর উচ্চ মাধ্যমিকে ভর্তি নিয়ে ভাবছে, শরীফ তখন ব্যস্ত ঢাকার মিরপুরের একটি গার্মেন্টসের কাজ নিয়ে।
তার মা গৃহকর্মী সুরমা বেগম বললেন, ছেলেকে তিনি মিরপুরের ক্যাপিটাল মডেল স্কুলে ভর্তি করিয়েছিলেন। কিন্তু ছেলের আগ্রহ ছিল না পড়ায়।
“পোলাপাইন না চাইলে তো পড়ানো যায় না। বাজে পোলাপাইনের লগে ঘোরাফেরা শুরু করছিল। পরে কামে দিয়া দিছি।”
সুরমা বেগমের ভাষ্য, তার আরেক ছেলেও পড়ালেখায় অমনোযোগী। তবে ষষ্ঠ শ্রেণি পড়ুয়া মেয়েকে নিয়ে তিনি আশাবাদী।
“মাইয়ারে পড়ার কথা কওয়া লাগে না। কিন্তু পোলা স্কুলে যাইতে চায় না, প্রাইভেটে যায় না। এদিক-ওদিক ঘুরত, স্কুলে যাইত না। স্কুল থেকে স্যারেরা জানানোর পর আমি মাইরা স্কুলে পাঠাই।”
দেশে ছেলে শিশুর সংখ্যা বেশি হলেও শিক্ষা ব্যবস্থায় মেয়েদের তুলনায় তাদের অংশগ্রহণ কমে যাচ্ছে, পরীক্ষার ফলাফলেও পিছিয়ে থাকছে ছেলেরা।
ছেলেদের এই পিছিয়ে পড়ার প্রবণতা সম্প্রতি প্রকাশিত এসএসসির ফলেও স্পষ্ট। ফল প্রকাশের দিন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও ছেলেদের পিছিয়ে পড়ার কারণ খোঁজার তাগিদ দিয়েছেন। একই কথা সরকারপ্রধান বলেছিলেন গতবছর এইচএসসি পরীক্ষার ফল ঘোষণার সময়।
বিশেষজ্ঞরাও বলছেন, অর্থনৈতিক সংকট ও সামাজিক পরিবর্তন ছেলেদের একটি অংশকে শিক্ষা থেকে দূরে ঠেলে দিচ্ছে। পরিস্থিতি উত্তরণে পরিকল্পনা অনুযায়ী সরকারকে শিক্ষায় বিনিয়োগ করার তাগিদ দিয়েছেন তারা।
পরিসংখ্যান কি দেখাচ্ছে?
বাংলাদেশের জনসংখ্যায় এখন পুরুষের তুলনায় নারীর সংখ্যা বেশি। তবে বয়সভিত্তিক জনসংখ্যা বিন্যাসে দেখা যায়, দেশে মেয়ে শিশুর চেয়ে ছেলে শিশুরা সংখ্যায় এগিয়ে।
২০২২ সালের জনশুমারি অনুযায়ী, দেশে ০-৪, ৫-৯ ও ১০-১৪ বছর বয়সসীমায় ছেলে শিশু বেশি; তবে ১৫-১৯ বছর বয়সসীমায় মেয়ে শিশুরা এগিয়ে রয়েছে।
সংখ্যায় এগিয়ে থাকলেও বিদ্যালয়মুখী হওয়ার ক্ষেত্রে ছেলেরা মেয়েদের তুলনায় অনেকটা পিছিয়ে রয়েছে। পরিসংখ্যান ব্যুরোর জরিপ অনুযায়ী, দেশের ছেলে শিশুদের ৮৪.৩ শতাংশ এবং মেয়ে শিশুদের ৯০.১ শতাংশ বিদ্যালয়ে যায়।
আর বাংলাদেশ শিক্ষাতথ্য ও পরিসংখ্যান ব্যুরোর ২০২৩ সালের শিক্ষা পরিসংখ্যান অনুযায়ী, দেশের মাধ্যমিক বিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষার্থীদের ৫৫ শতাংশ ছাত্রী। মাদ্রাসা শিক্ষার্থীদের মধ্যে প্রায় ৫৪ শতাংশ ছাত্রী। কেবল কারিগরিতে ছাত্রদের তুলনায় ছাত্রীরা (২৯ শতাংশ) পিছিয়ে রয়েছে।
এসএসসি ও সমমান পরীক্ষায় ছাত্রদের অবস্থান
চলতি বছর ২০ লাখ ১৩ হাজার ৫৯৭ জন শিক্ষার্থী মাধ্যমিক পরীক্ষায় অংশ নেয়। এ পরীক্ষায় অংশগ্রহণ, পাসের হার, জিপিএ ৫- সব সূচকেই মেয়েরা এগিয়ে রয়েছে। এ নিয়ে টানা দুই বছর ছাত্ররা ছাত্রীদের পেছনে রয়েছে।
মাধ্যমিক পরীক্ষা- ২০২৪ |
পরীক্ষার্থী |
পাসের হার |
জিপিএ-৫ |
ছাত্র |
৯৮৮৭৯৪ |
৮১.৫৭% |
৮৩৩৫৩ |
ছাত্রী |
১০২৪৮০৩ |
৮৪.৪৭% |
৯৮৭৭৬ |
তবে ২০২০, ২০২১ ও ২০২২ সালে অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে ছাত্রদের সংখ্যা ছিল বেশি। এর আগে ২০১৮, ২০১৯ সালে ছাত্রীদের সংখ্যা ছিল বেশি। ২০১৭ সালেও ছাত্রদের অংশগ্রহণ বেশি ছিল। তবে এই ৮ বছরে প্রতিবারই পাসের হারে ছাত্রীরা এগিয়ে রয়েছে।
মাধ্যমিক পরীক্ষা |
পরীক্ষার্থী |
পাসের হার (%) |
||
ছাত্রী |
ছাত্র |
ছাত্রী |
ছাত্র |
|
২০২৪ |
১০,২৪,৮০৩ |
৯,৮৮,৭৯৪ |
৮৪.৪৭ |
৮১.৫৭ |
২০২৩ |
১০,৩১,৬৪৭ |
১০,০৯,৮০৩ |
৮১.৮৮ |
৭৮.৮৭ |
২০২২ |
৯,৯৫,৯৪৪ |
৯,৯৮,১৯৩ |
৮৭.৭১ |
৮৭.১৬ |
২০২১ |
১০,৯৮,৩০১ |
১১,৪২,০৯৪ |
৯৪.৫০ |
৯২.৬৯ |
২০২০ |
১০,১৮,৫৩৮ |
১০,২১,৪৯০ |
৮৪.১০ |
৮১.৬৩ |
২০১৯ |
৮,৭৩,৬৭২ |
৮,২০,৯৮০ |
৮৮.৮০ |
৮২.০১ |
২০১৮ |
৮,৩২,৩২৬ |
৭,৯২,০৯৭ |
৮০.৩৫ |
৭৮.৪০ |
২০১৭ |
৮,৭১,৫৮৯ |
৯,১০,৩৭৩ |
৮০.৭৮ |
৭৯.৯৩ |
ছেলেরা শিক্ষায় আগ্রহ হারাচ্ছে কেন?
যে বয়সে এসএসসি পরীক্ষা দেওয়ার কথা, সে বয়সে অটোরিকশা চালিয়ে সংসার চালাচ্ছে নরসিংদীর বেলায়েত হোসেন।
বেলায়েতের ভাষ্য, স্কুলের খরচ আর পরিবারের আর্থিক সংকটের কারণে ২০২২ সালে নবম শ্রেণিতে ওঠার পর পড়ালেখা ছাড়তে হয়েছে তাকে।
“করোনার মধ্যে তেমন পড়ালেখা হয় নাই। অনেক গ্যাপ পড়ে গেছিল। আবার নাইনে ওঠার পর প্রাইভেট পড়তে পারছিলাম না, পরিবারেও অভাব। তাই আর স্কুলে যাই নাই। পড়লে হয়ত ভালো হইত, কিন্তু সংসারে টাকা দেওয়াটাও জরুরি। বাবা-মার কষ্ট হচ্ছিল।”
মানিকগঞ্জ সদরের জয়নগর উচ্চ বিদ্যালয়ে এবার এসএসসি পরীক্ষার্থী ছিল ১২২ জন। তাদের ৬৭ জন ছাত্রী, ছাত্র ৫৫ জন। পাসের হারেও এগিয়ে রয়েছে ছাত্রীরা।
এ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক আব্দুর রাজ্জাক জানান, প্রাথমিক স্কুল থেকেই ছাত্ররা বেশি ঝরে পড়ছে। সব শ্রেণিতেই ছাত্রদের উপস্থিতি এখন তুলনামূলক কম।
“পড়াশোনায় ছেলেদের অনীহা রয়েছে। তারা মোবাইল নিয়েই ব্যস্ত থাকে বেশি, স্কুলে আসে না। অনেকে কিশোর গ্যাং, মাদকের সাথে জড়াচ্ছে। আমার স্কুলের ক্লাসগুলোতে দেখি, সেরা ১০ জনের ৮ জনই মেয়ে। ছেলেদের তুলনায় তারা পড়াশোনায় মনোযোগী বেশি।”
একই চিত্র তুলে ধরে সাটুরিয়ার আবদুর রহমান খান উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক আতাউর রহমান বলেন, তার স্কুলে এবার এসএসসি পরীক্ষার্থীদের ৬০ শতাংশই ছিল ছাত্রী।
“আমার স্কুলে মেয়েদের উপস্থিতিও বেশি, রেজাল্টও ভালো তাদের। এখন ছেলেরা কোনো কথাই শুনতে চায় না। মূল সমস্যা মোবাইলে অতিমাত্রায় আসক্তি। মেয়েরা মোবাইল ব্যবহার করে কম। কিন্তু এই বয়সী প্রতিটি ছেলের কাছে মোবাইল রয়েছে। অভিভাবকদের আরও সচেতন হতে হবে। আমরা শিক্ষকরা চেষ্টা করেও তাদের নিয়ন্ত্রণ করতে পারছি না।”
ঢাকার আইডিয়াল স্কুল ও কলেজের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ মোহাম্মদ এমাম হোসাইন জানান, তাদের কোনো শাখায় ছেলেরা ভালো করেছে, কোথাও মেয়েরা ভালো করেছে।
এই শিক্ষকও মনে করেন, মোবাইলে আসক্তির কারণে ছেলেদের মনোযোগ এখন কমছে। এর সঙ্গে করোনাভাইরাস মহামারীর অর্থনৈতিক সংকটের প্রভাবও রয়েছে।
“পরিস্থিতি দেখে মনে হচ্ছে, মেয়েরা ঘরের মধ্যে থাকে, বাবা-মায়ের কথা বেশি শোনে। ছেলেরা হয়ত বাইরে ঘোরাফেরা করে বা অন্য কাজে সময় বেশি ব্যয় করে।”
মিরপুর বাংলা স্কুল ও কলেজে এবার ছাত্রের সংখ্যা বেশি থাকলেও ছাত্রীদের ফলাফল ভালো হয়েছে।
প্রতিষ্ঠানটির অধ্যক্ষ মোহাম্মদ মোস্তফা কামাল খোশনবীশ বলেন, স্কুলে মনোযোগী না হয়ে ক্লাস ফাঁকি দিয়ে বাইরে আড্ডা দেওয়ার কারণে ছেলেরা পিছিয়ে যাচ্ছে।
“মেয়েরা স্কুল ফাঁকি দেয় না। তারা ঘরেও থাকে বেশি, বাসায় পড়ালেখা করে। আর ছেলেরা ঘরে থাকতেই চায় না। স্কুলের নাম করে বাইরে গিয়ে তাদের অনেকে কিশোর গ্যাংয়ে, মাদকে জড়িয়ে পড়ে। তারা অনেক বেশি মোবাইলে আসক্ত হয়ে পড়ছে।”
নারীর ক্ষমতায়ন ও ছাত্রীদের উপবৃত্তিসহ বিভিন্ন সুবিধা মেয়েদের ভালো ফলাফলে ভূমিকা রাখছে বলে মনে করেন এই শিক্ষক।
রাজবাড়ী আদর্শ উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক জাহাঙ্গীর আলম শেখও মনে করেন, ছাত্রীদের পড়াশোনায় আগ্রহ ধরে রাখতে সরকারের উপবৃত্তি কার্যক্রম একটি সুরক্ষা ব্যবস্থা হিসেবে কাজ করছে।
“একসময় স্কুলে ছাত্ররাই বেশি ছিল। পরে সরকার উপবৃত্তি চালু করার কারণে ছাত্রীর সংখ্যা ও উপস্থিতি বাড়তে থাকে। ছাত্রীরা পড়ালেখায় ছেলেদের তুলনায় বেশি মনোযোগী, তাদের ফলাফলও ভালো।”
সিলেটের কানাইঘাটের সড়কের বাজার উচ্চবিদ্যালয়ের সহকারী প্রধান শিক্ষক মতিউর রহমান মনে করেন, পরিবারগুলোর অর্থনৈতিক সংকট ছেলে শিশুদের শিক্ষাবিমুখ করে তুলছে।
তার স্কুলেও এসএসসি পরীক্ষায় ছাত্রীর সংখ্যা বেশি ছিল। সেজন্য তিনি ছেলেদের পড়া বাদ দিয়ে উপার্জন হতে বাধ্য হওয়াকে কারণ হিসেবে দেখছেন।
মতিউর রহমান বলেন, “আমাদের আশপাশের সব স্কুলে ছাত্রের সংখ্যা কম। যে এলাকাগুলোতে অর্থনৈতিক সংকট বেশি, সেখানে বাবা-মায়েরা ছেলেদের কাজে দিয়ে দেয়। বিশেষ করে সিলেটে বিদেশে পাঠিয়ে দেয়। ১৪-২০ বছরেই বিদেশে পাঠিয়ে দেয়। অষ্টম-নবম শ্রেণিতে উঠেই তারা বিদেশে যাওয়ার জন্য আর পড়াশোনাই করে না। আবার যারা ফেল করল, তাদেরও পাঠিয়ে দেয়।”
এই বাস্তবতা ধরা পড়েছে জাতীয় শিশুশ্রম জরিপে। গেল মার্চে প্রকাশিত ২০২২ সালের জরিপ অনুযায়ী, দেশে ছেলে শিশু শ্রমিকের সংখ্যা ১৩ লাখ ৭৪ হাজার ১৫৪ জন, যেখানে মেয়ে শিশু শ্রমিক রয়েছে ৪ লাখ ১ হাজার ৯৪৩ জন।
অথচ ২০১৩ সালে মেয়ে শিশু শ্রমিকের সংখ্যা ছিল ৯ লাখ ৫৩ হাজার জন; আর ছেলে শিশু শ্রমিক ছিল ৭ লাখ ৪৬ হাজার।
ছেলেদের কর্মমুখী হওয়ার ইঙ্গিত রয়েছে এবারের মাধ্যমিক পরীক্ষার পরিসংখ্যানেও। এ বছর কারিগরি শিক্ষাবোর্ডে ছাত্র ছিল ৯২ হাজার ১৬৯ জন, বিপরীতে ছাত্রী ছিল ৩০ হাজার ৩৬৯ জন।
এর বাইরে কেবল রাজশাহী শিক্ষাবোর্ডে ছাত্রীদের তুলনায় ছাত্রের সংখ্যা ৬ হাজার বেশি ছিল। বাকি নয়টি শিক্ষাবোর্ডেই ছাত্ররা সংখ্যায় পিছিয়ে।
এর মধ্যে ঢাকা বোর্ডে পরীক্ষায় অংশ নেয়া ছাত্রের তুলনায় ২৮ হাজার ৩১৭ জন ছাত্রী বেশি ছিল। কুমিল্লা বোর্ডে এই ব্যবধান ছিল সবচেয়ে বেশি। এই বোর্ড থেকে পরীক্ষায় অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে ২৯ হাজার ৮৬৫ জন ছাত্রী বেশি ছিল।
কুমিল্লা শিক্ষা বোর্ডের পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক মো. আসাদুজ্জামান বলেন, গত কয়েক বছর ধরেই ছেলেদের অংশগ্রহণ কম, পাসের হারেও তারা পিছিয়ে।
“এর অনেকগুলো কারণ থাকতে পারে। একটি বড় কারণ হতে পারে, ছেলেরা আর্থসামাজিক কারণে কাজের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ছে। বিশেষ করে কোভিড মহামারীর পরে এটি আরও বেশি হচ্ছে। বিদেশে চলে যাচ্ছে অনেকে। এই অঞ্চলের ছেলেরা বেশিরভাগ বিদেশমুখী হয়। আবার এই বয়সী ছেলেদের মনোযোগ না থাকাটাও বড় কারণ হতে পারে।
“আরেকটি বিষয় হচ্ছে, জনমিতিক পরিসংখ্যানেও এখন মেয়েদের সংখ্যা বেশি। এটাও একটা কারণ হতে পারে।”
আসাদুজ্জামান জানান, সম্প্রতি একটি স্কুল পরিদর্শনে গিয়ে তিনি দেখেন, ক্লাসে ছাত্রের উপস্থিতি অনেক কম। কিন্তু ছাত্রীদের উপস্থিতি ছিল বেশি।
আন্তঃশিক্ষা বোর্ড সমন্বয় কমিটির সভাপতি ও ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান তপন কুমার সরকার বলছেন, ছেলের সংখ্যা কমে যাওয়াটা চিন্তার বিষয়।
“কেন ছেলে শিক্ষার্থী কমে গেল- এটি গবেষণা করে দেখতে হবে, গভীরভাবে বিশ্লেষণ করতে হবে। সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নিতে হবে।”
খুঁজতে হবে সমাধান
মহামারী ও যুদ্ধের মত বৈশ্বিক সংকটের পাশাপাশি দুর্বল অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনা কয়েক বছর ধরেই বাংলাদেশের বহু পরিবারকে চাপে রেখেছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক এস এম হাফিজুর রহমানের পর্যবেক্ষণ, মানুষের আয়ের সঙ্গে দ্রব্যমূল্যের সামঞ্জস্য না থাকার প্রভাব পড়ছে শ্রেণিকক্ষে ছাত্র-ছাত্রীর অনুপাতে। এই ব্যবধান সামনে আরও বাড়বে বলে তার আশঙ্কা।
“১৪-১৫ বছরের বাচ্চাকে বাবা-মা কাজে দিয়ে দিচ্ছে। যে অঞ্চলগুলোতে অর্থনৈতিক অঞ্চল গড়ে উঠেছে, সেখানে সহজেই চাকরি দিয়ে দিতে পারছে। মেয়ে উপবৃত্তি পাচ্ছে, পড়াশোনায় মনোযোগী- এসব কারণে মেয়েদের পড়াচ্ছে।”
সামাজিক বিকাশের সুযোগ কমে যাওয়াকে দায় দিয়ে এই শিক্ষাবিদ বলেন, “এখন অনেকক্ষেত্রেই ছেলেদের দেখা যাচ্ছে, তারা কিশোর গ্যাংয়ে জড়িয়ে পড়ছে। ছেলেরা যেহেতু বাইরে যাচ্ছে, তারা আড্ডা দিচ্ছে, মোবাইল বা অন্য কিছু নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ছে। কেননা তাদের খেলার জায়গা নাই।”
গণসাক্ষরতা অভিযানের নির্বাহী পরিচালক রাশেদা কে চৌধুরী ছেলেদের তুলনায় ছাত্রীদের এগিয়ে থাকার পেছনে তিনটি কারণ দেখছেন।
সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রাথমিক ও গণশিক্ষা উপদেষ্টার দায়িত্ব সামলানো রাশেদা কে চৌধুরীর পরামর্শ- শিক্ষায় ছেলেদের আগ্রহী করতে শুধু মেয়েদের জন্য নয়, রাষ্ট্রীয় বিনিয়োগকে সর্বজনীন করতে হবে।
তিনি বলেন, “চাহিদার ভিত্তিতে বিনিয়োগ করা প্রয়োজন। যেখানে রাষ্ট্রীয় বিনিয়োগ করলে ছেলেরা লেখাপড়ামুখী হবে, সেসব জায়গায় করতে হবে। স্থানীয়ভাবে বিনিয়োগ করা প্রয়োজন। চা বাগান, চরে, হাওড়ে যতটুকু সহযোগিতা প্রয়োজন, ততটুকু তো ঢাকা মহানগরীতে দরকার নেই। এত বড় শিক্ষা ব্যবস্থায় কেন্দ্রীয়ভাবে সিদ্ধান্ত নেয়া হলে যেখানে যতটুকু প্রয়োজন ততটুকু বিনিয়োগ করেও হবে না।”
রাশেদা কে চৌধুরী বলেন, “মেয়েদের এগিয়ে যাওয়া ধারাবাহিকতার একটি অংশ এবং এটি বিশ্বব্যাপী চলে আসছে। মেয়েদের উপবৃত্তি, বিনা পয়সায় লেখাপড়ার ব্যবস্থা আছে। কিন্তু সেটা ছেলেদের ক্ষেত্রে নাই। সেজন্য তাদের শ্রমে জড়িয়ে পড়তে হয়।
“ছেলেরা নানা আসক্তি ও গ্যাংবাজিতেও ঢুকে যাচ্ছে। এখান থেকে ফেরাতে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোকে দায়িত্ব নিতে হবে। শিক্ষকরা যদি দক্ষ হতেন, শিক্ষার্থীবান্ধব হতেন; তাহলে তো পরিস্থিতি এমন হয় না।”
অন্য অনেক বিষয়ের সঙ্গে মানসম্পন্ন শিক্ষা ও কর্মসংস্থানের অভাবও ছেলে শিক্ষার্থীরা পিছিয়ে দিচ্ছে বলে মনে করেন সমাজবিজ্ঞানী অনুপম সেন।
তিনি বলেন, “এখন স্কুলগুলোতে ভালো পড়াশোনা হচ্ছে না। মানসম্পন্ন শিক্ষা নিশ্চিত করতে হবে। মানসম্পন্ন শিক্ষার অভাবেও ছেলেদের অংশগ্রহণ কমছে। পড়াশোনা করেও কর্মসংস্থানের অভাবে অনেক ছেলেরা বেকার থেকে যাচ্ছে। এটাও ছেলেদের পিছিয়ে যাওয়ার অন্যতম কারণ।”
মেয়েদের জন্য প্রাথমিক শিক্ষা অবৈতনিক করার পর মেয়েরা যে ব্যাপকভাবে স্কুলে যাওয়া শুরু করেছিল, সে কথা মনে করিয়ে দিয়ে তিনি বলেন, “এখন মেয়েরা ব্যাপকভাবে কর্মক্ষেত্রে জড়িয়ে পড়ছে। পাইলট থেকে সেনাবাহিনী- সবক্ষেত্রে এখন নারীদের বিচরণ।
“স্বাধীনতার সময় স্কুল-কলেজে মেয়েদের সংখ্যা অনেক কম ছিল। পরে নারী মুক্তি আন্দোলন শুরু হয়। এখন মেয়েরা অনেক বেশি এগিয়ে যাচ্ছে। এখন একান্নবর্তী পরিবার ভেঙে গেছে। একান্নবর্তী পরিবারে ছেলেরাই কিন্তু এগিয়ে ছিল। এখন একান্নবর্তী পরিবার ভেঙে একক পরিবার হয়েছে। এখন মেয়েরা ঘরে থেকে যেভাবে পড়াশোনা করতে পারে, সেটা তাদের জন্য সুযোগ সৃষ্টি করেছে। কিন্তু ছেলেরা তো ঘরে থাকে না। তারা খেলতে চায়, আড্ডা দিতে চায়। তাদের জন্য খেলার মাঠের দরকার ছিল। কিন্তু তারা তা পাচ্ছে না।”
আর খেলাধুলার অভাবে ‘কিশোর গ্যাং’ গড়ে উঠছে মন্তব্য করে অনুপম সেন বলেন, “সভ্যতার আগ্রাসনের ফলে শিশু-কিশোরদের খেলার জায়গা হারিয়ে গেছে। বড় বড় শহরগুলোতে কোন খেলার মাঠ নেই। আগে সেখানে অনেক পুকুর ছিল, খোলা মাঠ ছিল, বিস্তীর্ণ জায়গা ছিল খালি। আমাদের অনেক খেলার মাঠ তৈরি করতে হবে।”
পুরনো খবর
ছাত্র কেন কমছে? কারণ খুঁজতে বললেন প্রধানমন্ত্রী