কেনেডি স্পেস সেন্টার থেকে সোমবার সকালে রওনা হওয়ার কথা ছিল নাসার পরবর্তী প্রজন্মের রকেটের। কিন্তু কারিগরি ত্রুটির কারণে শেষ মুহূর্তে এদিনের যাত্রা স্থগিত ঘোষণা করেন নাসার পরিচালক চার্লি ব্ল্যাকওয়েল-টম্পসন।
রকেট উৎক্ষেপণের ক্ষেত্রে এরকম কারিগরি ত্রুটি অবশ্য নতুন কিছু নয়। সেজন্য বিকল্প উৎক্ষেপণ দিন হিসেবে আগেই ২ ও ৫ সেপ্টেম্বর দুটো স্লট ভেবে রেখেছে নাসা।
অ্যাপোলো মিশনে চন্দ্রপিঠে অবতরণের ৫০ বছর পর আবারও মানুষকে চাঁদে নিয়ে যেতেই নাসার এই অভিযান, যার নাম দেওয়া হয়েছে মিশন আর্টেমিস। এ অভিযানকে নাসার মঙ্গল গ্রহে মানবযাত্রার পূর্ব প্রস্তুতি হিসেবে দেখা হচ্ছে।
এই মিশনের মূল চালিকাশক্তি হচ্ছে স্পেস লঞ্চ সিসটেম, যাকে সংক্ষেপে এসএলএস বলা হচ্ছে। এটাই এখন পর্যন্ত নাসার সবচেয়ে আধুনিক মহাকাশ যান।
কথা ছিল, কেনেডি স্পেস সেন্টার থেকে স্থানীয় সময় ৮টা ৩৩ মিনিট, অর্থ্যাৎ বাংলাদেশ সময় সোমবার সন্ধ্যা ৬টা ৩৩ মিনিটে রকেটটি উৎক্ষেপণ করা হবে। পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলের বাইরে পৌঁছে রকেটটি একটি টেস্ট ক্যাপসুল ছুড়ে দেবে। এই টেস্ট ক্যাপসুলের নাম ওরিয়ন।
পরিকল্পনা অনুযায়ী, স্পেস লঞ্চ সিসটেমে করে ওরিয়ন লঞ্চ প্যাডে বসানো হয়। শুরু হয় জ্বালানি ভরাসহ অন্যান্য রুটিন কাজ। কিন্তু নির্ধারিত সময়ের ঘণ্টা দেড়েক আগে দেখা দেয় গড়বড়।
বিবিসি জানিয়েছে, রকেটের যে অংশ তরল হাইড্রোজেন ও তরল অক্সিজেন ট্যাংকের সঙ্গে যুক্ত, সেখানেই ফাটল ধরা পড়ে। নাসার প্রকৌশলীরা তখন বলেছিলেন, তারা ক্রুটি পরীক্ষা করে দেখছেন।
রকেটের চারটি বড় এরএস-২৫ ইঞ্জিনের একটিতেও সমস্যা দেখা দেয়। এক পর্যায়ে উৎক্ষেপণের নির্ধারিত সময়ের ৪০ মিনিট আগে থেমে যায় কাউন্টডাউন। পরে জানানো হয়, সময়মতো ত্রুটি সারানো সম্ভব না হওয়ায় সোমবারের মত উৎক্ষেপণ স্থগিত করা হচ্ছে।
যাত্রা স্থগিত হলেও নাসা জানিয়েছে, তাদের স্পেস লঞ্চ সিস্টেম (এসএলএস) ‘স্থিতিশীল অবস্থায়’ আছে এবং কোথায় গড়বড় হয়েছে তা জানতে প্রকৌশলীরা এখন তথ্য সংগ্রহ করছেন।
১৯৬৯ সালে চাঁদের মাটিতে প্রথম পা রাখেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রয়াত নভোচারী নেইল আর্মস্ট্রং এবং কিছুক্ষণের মধ্যে বাজ অলড্রিন চাঁদের পিঠে নেমে আর্মস্ট্রংয়ের সঙ্গে যোগ দেন। মহাশূন্যে মানব সভ্যতার চিহ্ন পৌঁছে দিয়ে মহাকাশ অভিযানের স্বর্ণযুগের সূচনা করে ওই মুহূর্ত।
৫০ বছর পর চাঁদকে আবারও নতুন করে ছুঁয়ে দেখতে চাইছে মানব জাতি। আর যারা অ্যাপোলো মিশনের সাক্ষী হতে পারেননি, আর্টেমিস মিশন তাদের প্রবলভাবে অনুপ্রাণিত করবে।
নতুন এই মিশন আগের তুলনায় একটু ভিন্ন হবে। নাসা আগামীতে প্রথম নারী ও প্রথম ভিন্ন বর্ণের কাউকে চাঁদে পাঠাবে। এর পেছনে কারণ একটাই- মহাকাশ সবার জন্যই উন্মুক্ত।
চাঁদের পিঠে অবতরণ দিয়ে নাসা নতুন এক যুগের সূচনা করতে চাইছে আসলে। আগামীতে মঙ্গলের বুকে মানুষকে নিয়ে যেতে চায় নাসা। আর ওই অভিযান নিশ্চিতভাবে মানবজাতির ইতিহাসে আরেক বিরাট মাইলফলক হবে।
অ্যাপোলোর জমজ বোন আর্টেমিস
নাসার প্রথম চন্দ্রাভিযান ছিল গ্রিক দেবতা অ্যাপোলোর নামে। আর অর্ধশতক পর নাসার চাঁদে ফেরার মিশনের নাম রাখা হয়েছে অ্যাপোলোর জমজ বোন আর্টেমিনের নামে।
২০২৫ সালের মধ্যে চাঁদে নভোচারী পাঠানো ও সেখানে মানব বসতি স্থাপন করার লক্ষ্যে এই প্রকল্প নিয়ে কাজ করছে নাসা। ভবিষ্যতে মঙ্গল গ্রহেও মানুষ পাঠানোর পরিকল্পনা করছে মার্কিন এই মহাকাশ সংস্থাটি।
চাঁদে অভিযান পরিচালনা করতে এক দশকের বেশি সময় ধরে কোটি কোটি ডলার খরচ করেছে নাসা। এসএলএস-ওরিয়ন নভোযানের নকশা, নির্মাণ ও পরীক্ষার পেছনে এখন পর্যন্ত নাসা খরচ করেছে অন্তত তিন হাজার সাতশ কোটি ডলার।
আর্টেমিস প্রকল্পকে মহাকাশ অনুসন্ধানের মাধ্যম ও একটি ‘অর্থনৈতিক ইঞ্জিন’ আখ্যা দিয়েছেন নাসা প্রধান বিল নেলসন।
তার ভাষ্য, কেবল ২০১৯ সালেই এক হাজার চারশ কোটি ডলার আয়ের পাশাপাশি ৭০ হাজার মার্কিন নাগরিকের কর্মসংস্থান তৈরি করেছে এই প্রকল্প।
যেভাবে চাঁদে যাবে নাসার মেগা রকেট
৭০ দশকে অ্যাপলো অভিযানের পর এই প্রথমবার চাঁদে রকেট পাঠাচ্ছে মার্কিন মহাকাশ সংস্থা, যার প্রথম অভিযান ‘আর্টেমিস ১’ শুরু হওয়ার কথা ছিল সোমবার।
এটা হবে ছয় সপ্তাহের জন্য মানবহীন একটি পরীক্ষামূলক অভিযান। তাতে ব্যবহৃত হচ্ছে ৩২ তলা ভবনের সমান উঁচু ও দুটি আলাদা ভাগে বিভক্ত ‘স্পেস লঞ্চ সিস্টেম (এসএলএস)’ রকেট।
কেনেডি স্পেস সেন্টার থেকে এই রকেটে করে ওরিয়ন ক্যাপসুল উৎক্ষেপণ করা হবে। রকেটটির ভর প্রায় সাড়ে ৫৭ লাখ পাউন্ড।
নভোচারীদের জন্য রকেটটি শতভাগ নির্ভরযোগ্য কি না, সেটি যাচাই করতেই নাসা এই পরীক্ষামূলক অভিযান পরিচালনা করছে।
নাসার নভোচারী রেন্ডি ব্রেসনিক বলেন, “আর্টেমিস এক মিশনে আমরা যা কিছুই করছি, তা আসলে আতস কাচে নিজেদের প্রমাণ করে নেওয়া। আর তাতে আর্টেমিস দুই মিশনের ঝুঁকি কমে আসবে।”
১৯৬০ ও ৭০ এর দশকে অ্যাপোলো প্রকল্প চলাকালে পাঠানো ‘স্যাটার্ন ৫’-এর পর ‘এসএলএস’ নাসার তৈরি সবচেয়ে বড় উচ্চতার ‘লঞ্চ সিস্টেম’। পাশাপাশি এটি বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী এবং জটিল রকেটও।
এ মাসের শুরুতে রকেটটির চূড়ান্ত প্রস্তুতি ও স্থল পরীক্ষা করতে এটিকে ধীরে ধীরে ঐতিহাসিক ‘৩৯বি’ লঞ্চ প্যাডে নিয়েছিল নাসা।
গত সপ্তাহে এই পরীক্ষাগুলো শেষ হওয়ার পরপরই রকেটটি উৎক্ষেপণের সবুজ সংকেত দেন নাসা কর্মকর্তারা। তবে রকেটে জ্বালানি ভরার সময় নতুন করে মেরামত করা হাইড্রোজেন লাইনের ফিটিং ব্যর্থতাকে এই উৎক্ষেপণের সম্ভাব্য বাধা হিসেবে তারা চিহ্নিত করেছেন।
উৎক্ষেপণে রকেটের চারটি মূল ‘আর-২৫’ ইঞ্জিন ও রকেট বুস্টার দুটি ৮৮ লাখ পাউন্ডের ধাক্কা বা থ্রাস্ট তৈরি করতে পারে, যা ‘স্যাটার্ন ৫’ রকেটের চেয়ে ১৫ শতাংশ বেশি। এই থ্রাস্টারের সহায়তা নিয়েই রকেটটির মহাকাশের দিকে ছুটে যাবে।
উৎক্ষেপণের প্রায় ৯০ মিনিট পর রকেটের ওপরের অংশ ওরিয়ন ক্যাপসুলকে ঠেলে নিয়ে যাবে পৃথিবীর কক্ষপথের বাইরে। ৪২ দিনের এই যাত্রায় প্রথমে চন্দ্রপৃষ্ঠের ৬০ মাইলের মধ্যে পৌঁছাবে এই ক্যাপসুল। এর পর চাঁদ ছাড়িয়ে আরও ৪০ হাজার মাইল পথ পেরোনোর পর পৃথিবীর দিকে ফিরে আসবে এটি। সেটি নামবে প্রশান্ত মহাসাগরে।
প্রথম অভিযানে মানুষ না গেলেও দুজন নারী এবং একজন পুরুষের ডামি বহন করবে ওরিয়ন। এদের সঙ্গে যুক্ত কয়েকটি সেন্সর পরিমাপ করবে বিকিরণের মাত্রা এবং অন্যান্য পরিস্থিতি। এর ফলে বোঝা যাবে, ঠিক কী অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হবেন মানব নভোচারীরা।
ওরিয়ন ক্যাপসুলে ‘হিট শিল্ডের’ স্থায়িত্ব যাচাই করা এই অভিযানের মূল লক্ষ্য। কারণ, চাঁদের কক্ষপথ থেকে ফেরার সময় প্রতি ঘণ্টায় সাড়ে ২৪ হাজার মাইল বেগে বা শব্দের গতির চেয়ে ৩২ গুণ দ্রুতগতিতে পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলকে আঘাত করবে এটি।
অভিযানের প্রধান পরিচালক রিক লাব্রোডে বলেন, “এটা আমাদের সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার।”
তিনি জানান, ক্যাপসুলের বাইরের পৃষ্ঠে দুই ২৭৬০ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত তাপ সহ্য করার সক্ষমতা আছে এই হিট শিল্ডের। এটিই ক্যাপসুলকে অখণ্ড রাখবে এবং নভোচারীদের সুরক্ষা দেবে।