এসএসসি: পরীক্ষা স্থগিত প্রশ্ন ফাঁসের কারণে, গ্রেপ্তার ৩

এ ঘটনায় চারজনের নাম উল্লেখ করে অজ্ঞাত আরও ১০ থেকে ১২ জনকে আসামি করা হয়েছে।

কুড়িগ্রাম প্রতিনিধিদিনাজপুর প্রতিনিধিবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 21 Sept 2022, 08:40 AM
Updated : 21 Sept 2022, 08:40 AM

কুড়িগ্রামের ভুরুঙ্গামারী উপজেলার একটি স্কুল থেকে চলতি বছর অনুষ্ঠেয় এসএসসি পরীক্ষার চারটি বিষয়ের প্রশ্নপত্র উদ্ধারের পর দিনাজপুর শিক্ষা বোর্ড সেই পরীক্ষাগুলো স্থগিত ঘোষণা করেছে।

মঙ্গলবার দুপুরে ভূরুঙ্গামারী নেহাল উদ্দিন পাইলট বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষকের কক্ষ থেকে প্রশাসনের কর্মকর্তারা প্রশ্নপত্রগুলো উদ্ধার করেন। তারপর রাতে এ ব্যাপারে ভুরুঙ্গামারী থানায় মামলা করা হয়।

রাতেই গ্রেপ্তার করা হয় প্রধান শিক্ষক ও কেন্দ্র সচিব লুৎফর রহমান, ইংরেজির শিক্ষক আমিনুর রহমান রাসেল এবং চুক্তিভিত্তিক নিয়োগপ্রাপ্ত শিক্ষক জুবায়ের হোসাইনকে।

এরপর বুধবার সকালে দিনাজপুর শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান অধ্যাপক কামরুল ইমলাম চারটি পরীক্ষা স্থগিতের নির্দেশের তথ্য জানান।

পরে এক সংবাদ সম্মেলনে চেয়ারম্যান বলেন, “প্রশ্নপত্র ফাঁসের ঘটনায় কুড়িগ্রাম জেলা প্রশাসক ও পুলিশ সুপারের পরামর্শে মামলা হয়েছে। স্থগিত করা গণিত, পদার্থ বিজ্ঞান, কৃষি বিজ্ঞান ও রসায়ন এই চারটি বিষয়ের পরীক্ষার রুটিন শিগগির জানিয়ে দেওয়া হবে।

“প্রশ্নপত্র ফাঁসের বিষয়ে বোর্ডের পক্ষ থেকে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হবে। কমিটির প্রতিবেদন পাওয়ার পর পরবর্তীতে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।”

ভুরুঙ্গামারী থানার ওসি আলমগীর হোসেন বলেন, “মঙ্গলবার রাতে চলতি এসএসসি পরীক্ষার ট্যাগ অফিসার ও উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা মো. আদম মালিক চৌধুরী বাদী হয়ে চারজন শিক্ষকের নাম উল্লেখ করে এবং অজ্ঞাত আরও ১০ থেকে ১২ জনকে আসামি করে মামলাটি করেন। মামলায় এরই মধ্যে তিনজনকে গ্রেপ্তার দেখানো হয়েছে।”

বুধবার ভোরে নেহাল উদ্দিন পাইলট বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষক হামিদুল ইসলাম ও সোহেল আল মামুন জিজ্ঞাসাবাদের জন্য থানায় নিয়ে আসা হয়েছে। এ ছাড়া মামলার অপর আসামি বিদ্যালয়ের কেরানি আবু হানিফ পলাতক রয়েছে বলে জানিয়েছে পুলিশ।

স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ১৫ সেপ্টেম্বর থেকে এসএসসি পরীক্ষা শুরু হয়। ইংরেজি প্রথম এবং মঙ্গলবার অনুষ্ঠিত দ্বিতীয় পত্র পরীক্ষার পর প্রশ্নপত্র ফাঁসের বিষয়টি নিয়ে সামাজিক যোগযোগমাধ্যমে আলোচনা হয়। অভিযোগ আসে, শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের কাছ থেকেও। স্থানীয় সাংবাদিকরাও বিষয়টি সম্পর্কে অবগত হন। পরে উপজেলা প্রশাসনও এ নিয়ে নজরদারি শুরু করে।   

পুলিশ ও উপজেলা প্রশাসন একপর্যায়ে নিশ্চিত হয়, অনুষ্ঠিত কোনো বিষয়ের প্রশ্নপত্রের প্যাকেটের মধ্যে করেই সামনের পরীক্ষার প্রশ্নপত্র সরানো হয়েছে। তারপরই ভুরুঙ্গামারী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) দীপক কুমার দেব শর্মা, সহকারী পুলিশ সুপার (এএসপি) মোর্শেদুল হাসান, ভুরুঙ্গামারী থানার ওসি আলমগীর হোসেনের নেতৃত্বে একটি দল নেহাল উদ্দিন পাইলট বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক লুৎফর রহমানের কক্ষে তল্লাশি চালায়।

সেখান থেকে তখন চলতি বছরের এসএসসি পরীক্ষার গণিত, কৃষি বিজ্ঞান, পদার্থ বিজ্ঞান ও রসায়নের প্রশ্নপত্র উদ্ধার করা হয়; যে বিষয়গুলোর পরীক্ষা এখনও হয়নি।

বিকালে পুলিশ উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা আব্দুর রহমান ও প্রধান শিক্ষক লুৎফর রহমানকে থানায় এনে জিজ্ঞাসাবাদ শুরু করে। পরে রাতে প্রধান শিক্ষককে আটক করা হলেও মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তাকে ছেড়ে দেওয়া হয়।

মঙ্গলবার রাত সাড়ে ৯টার দিকে কুড়িগ্রাম জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ রেজাউল করিম, পুলিশ সুপার আল আসাদ মো. মাহফুজুল ইসলাম, দিনাজপুর মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান অধ্যাপক কামরুল ইসলাম ও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) দীপক কুমার দেব শর্মা বৈঠকে বসেন। ইউএনওর কার্যালয়ে প্রায় তিন ঘণ্টাব্যাপী রুদ্ধদ্বার বৈঠক করেন তারা।

পরে তারা উপজেলা পরিষদে কেন্দ্র সচিব লুৎফর রহমান, সহকারী শিক্ষক আমিনুর রহমান রাসেল এবং শিক্ষক জুবায়ের হোসাইনের সঙ্গেও কথা বলেন। রাত সাড়ে ১২টার দিকে দিনাজপুর শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান, সচিব অধ্যাপক জহির উদ্দিন,জেলা প্রশাসক, পুলিশ সুপার, জেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা শামছুল আলমসহ অন্যান্য কর্মকর্তারা উপজেলা পরিষদ ত্যাগ করেন। তবে এ সময় কেউ সংবাদকর্মীদের সঙ্গে কোনো কথা বলেননি।

পরে এ ব্যাপারে জানতে চাইলে কুড়িগ্রামের পুলিশ সুপার আল আসাদ মো. মাহফুজুল ইসলাম বলেন, “পরীক্ষার এ কার্যক্রমে পুলিশের নিরাপত্তা দেওয়া ছাড়া অন্য কাজ নেই। আমরা সেটি নিশ্চিত করেছি। প্রশ্নপত্র ফাঁস কিংবা জালিয়াতির ঘটনা ঘটালে তার দায় পরীক্ষা ব্যবস্থাপনার সংশ্লিষ্টদের।

“মামলা হয়েছে। আমরা তদন্ত করছি। সংশ্লিষ্ট সবাইকে আইনের আওতায় আনা হবে। মূলহোতাকেও শনাক্ত করে আইনের আওতায় আনতে আমি নিজে বিষয়টি মনিটরিং করছি।”

উপজেলা প্রশাসনের একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ধারণা করা হচ্ছে, প্রশ্ন বাছাইয়ের (সর্টিং) সময়ে কোনো একটি পরীক্ষার প্রশ্নপত্রের প্যাকেটের মধ্যে অন্য পরীক্ষাগুলোর প্রশ্নপত্রও ঢুকিয়ে দেওয়া হয়। কেন্দ্রের দায়িত্বরত ট্যাগ অফিসার বোর্ডের দেওয়া তালিকা অনুযায়ী পাঠানো প্রশ্নেপত্রের খাম গণনা করে থাকেন। প্যাকেট সিলগালা করে তার ওপর স্বাক্ষর করেন উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা আব্দুর রহমান। থানা থেকে কেন্দ্রে প্রশ্নপত্রের প্যাকেট আনার পর কৌশলে অন্য প্রশ্নগুলো সরিয়ে ফেলা হয়।

হতে পারে, এখানে কোথাও হয়তো দায়িত্বে অবহেলা হয়েছে। কিন্তু সেটি তদন্ত না করে বলা যাচ্ছে না বলেও জানান ওই কর্মকর্তা।

তবে স্থানীয় কয়েকজন অভিভাবক ও শিক্ষার্থী অভিযোগ করেন, অনেক অভিভাবককে ইংরেজি প্রথম ও দ্বিতীয় পত্রের প্রশ্নের জন্য দৌড়াদৌড়ি করতে দেখা গেছে।

ভুরুঙ্গামারী নেহাল উদ্দিন পাইলট বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় কেন্দ্রের এক পরীক্ষার্থী নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, “আমি এই কেন্দ্র থেকে এসএসসি পরীক্ষা দিচ্ছি। হল রুমে অনেক শিক্ষার্থী আলোচনা করে তারা প্রশ্নের উত্তরপত্র পেয়েছে। আমাকেও নিতে বলেছে। আমি সত্য-মিথ্যা জানি না। তবে এটা হলে তো খুব ক্ষতি।”

নেহাল উদ্দিন পাইলট বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় কেন্দ্রের সামনের চানাচুর বিক্রেতা মিঠু মিয়া বলেন, অভিভাবকদের প্রশ্নপত্র ফাঁস নিয়ে গল্প করতে তিনি শুনেছেন। তবে তিনি নিজে এ ধরনের কিছু দেখেননি।

ইংরেজির একজন শিক্ষক জানান, তিনি ব্যাচে উচ্চ মাধ্যমিকের শিক্ষার্থী পড়ান। তার কাছেও একটি প্রশ্ন আসে সমাধানের জন্য। সেটি হাতে লেখা ছিল। যে এটি নিয়ে এসেছিল সে তার এক বড় ভাইয়ের কাছ থেকে এটি পেয়েছে বলে জানায়।

তবে এ বিষয়ে উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা আব্দুর রহমান বলেন, “আমি দায়িত্ব নিয়ে বলতে পারি, ভূরুঙ্গামারী থেকে কোনো প্রশ্নপত্র ফাঁস হয়নি।”

পরীক্ষা শুরুর আগে হাতে লেখা উত্তরপত্রের সঙ্গে পরীক্ষার প্রশ্নের হুবহু মিল থাকার বিষয়ে তিনি বলেন, “মিল-অমিল আছে কি-না আমার দেখার বিষয় না। এটা সরকারের অনেক বিভাগ আছে, পুলিশ আছে, তাদের দায়িত্ব।” 

আরও পড়ুন:

Also Read: প্রশ্ন নিয়ে ‘জটিলতা’: দিনাজপুর বোর্ডে এসএসসির ৪ পরীক্ষা স্থগিত