পাপিয়া এক হাজতিকে নির্যাতন করে তার কাছ থেকে টাকা লুট করে নেন বলে অভিযোগ উঠে।
Published : 04 Jul 2023, 12:22 AM
গাজীপুরের কাশিমপুর কেন্দ্রীয় মহিলা কারাগারে এক হাজতিকে নির্যাতনের অভিযোগ ওঠার পর যুব মহিলা লীগের সাবেক নেত্রী শামীমা নূর পাপিয়াকে কুমিল্লা কেন্দ্রীয় কারাগারে পাঠানো হয়েছে।
সোমবার বিকাল সাড়ে ৫টার দিকে তাকে একটি প্রিজন ভ্যানে করে কুমিল্লায় পাঠানো হয় বলে জানিয়েছেন কাশিমপুর কারাগারের (ভারপ্রাপ্ত) জেল সুপার মো. ওবায়দুর রহমান।
সম্প্রতি রুনা লায়লা নামের এক হাজতিকে নির্যাতনের অভিযোগ ওঠে পাপিয়ার বিরুদ্ধে। নির্যাতনের শিকার ওই হাজতি বর্তমানে গাজীপুরের শহীদ তাজ উদ্দীন আহমদ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন।
প্রায় ৪০ মাস ধরে কাশিমপুর কারাগারে বন্দি ছিলেন পাপিয়া। ২৭ বছরের সাজাপ্রাপ্ত কয়েদি হিসেবে জেল বিধি অনুযায়ী পাপিয়াকে ‘রাইটার’ হিসেবে নিযুক্ত করা হয়।
সম্প্রতি পাপিয়া রুনা লায়লা নামে হাজতিকে নির্যাতন করে তার কাছ থেকে টাকা লুট করে নেন বলে জেলা প্রশাসক বরাবর অভিযোগ করেন নির্যাতিতের ছোট ভাই আব্দুল করিম। এ ঘটনা তদন্তে দুটি কমিটিও গঠন করা হয়েছে।
এরপরই পাপিয়ার কারাগার স্থানান্তরের খবর এল।
এই স্থানান্তরের কারণ জানতে চাইলে ভারপ্রাপ্ত জেল সুপার মো. ওবায়দুর রহমান বলেন, “ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নির্দেশে তাকে স্থানান্তর করা হয়েছে।”
পাপিয়ার হাতে মারধর ও নির্যাতনের শিকার রুনা লায়লা শহীদ তাজ উদ্দীন আহমদ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সার্জারি বিভাগে চিকিৎসা নিচ্ছেন।
রুনা লায়লা গাজীপুরের কাপাসিয়া উপজেলার কড়িহাতা গ্রামের আব্দুল হাইয়ের মেয়ে। ঢাকার কোতোয়ালী থানার একটি মামলায় তাকে কারাগারে পাঠানো হয়।
তার বোন রওশন আরা জানান, রুনার শরীর তেমন ভালো মনে হচ্ছে না। নির্যাতনের কথা উঠলেই শিউরে উঠছে, অসংলগ্ন কথা বলছে। তার গোটা শরীরে নির্যাতনের চিহ্ন রয়েছে।
হাসপাতালের বিছানায় শুয়েই সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেন রুনা লায়লা।
তিনি বলেন, “১৭ জুন ভোর ৫টায় মাইকিং করে আমাকে কারাগারের বিচার বৈঠকে যেতে বলে। সকাল ৯টায় বিচার বৈঠকের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, আমি ময়লা পরিষ্কার করতে যাই। বিকাল ৪টায় থালা-বাসন পরিষ্কার করি। বিকালে আমাকে কক্ষ বদলে পাপিয়ার অধীনে ৪০১ নম্বর কক্ষে দেওয়া হয়।”
পরদিন ভোর ৫টায় মাইকিং করে তাকে আবারও বিচার বৈঠকে যেতে বলা হয় বলে জানান রুনা। তবে টয়লেটে যাওয়ার কারণে সেখানে পৌঁছতে তার কিছুটা দেরি হয়।
রুনা লায়লা বলেন, “এটাই ছিল আমার অপরাধ। সকাল ৭টার দিকে ফাতেমা নামে একজন আমাকে ডেকে নেয়। ফাতেমা লাঠি দিয়ে আমাকে আঘাত করে। আমি আত্মরক্ষার্থে হাত দিয়ে লাঠি ফেরানোর চেষ্টা করি। এতে সে ক্ষিপ্ত হয়ে যায়। আরও মারধর শুরু করে। কিছুক্ষণ পড়ে একটা হাতুড়ি নিয়ে এসে আমাকে হাতুড়ি দিয়ে আঘাত করলে আমি পড়ে যাই। পড়ে যাওয়ার পর লাথি মারে।
“এসময় হঠাৎ ছালমা এসে হাজির হয়। ছালমা এসে আমার পোশাক ছিঁড়ে ফেলে। এমন অবস্থায় আমি পালানোর চেষ্টা করতে গিয়ে পড়ে যাই। আমাকে ওরা ধরে নিয়ে আসে। নাজমা ও মিনা নামে দুজন হাতকড়া পরতে বলে। আমি ভয়ে হাতকড়া পরতে চাইনি, কিন্তু জোর করে পরানো হয়। হাতকড়া পরিয়ে আমাকে একটা নির্জন স্থানে নিয়ে গিয়ে নির্যাতন করে।”
এরপর তাকে আবার বিচার বৈঠকে নিয়ে যাওয়া হয় জানিয়ে রুনা বলেন, “সেখানে দুই হাত দুদিকে তুলে শিকল দিয়ে বাঁধে। পাপিয়া এসে পায়ে লাঠি দিয়ে আঘাত করে। তখন কারাগারের সবাই আমাকে উঁকি দিয়ে দেখছিল। আমি শরীর ঢাকতে চেষ্টা করি। পাপিয়ার পিটানিতে আমি প্রস্রাব-পায়খানা আটকে রাখতে পারিনি। আমি তখন বার বার পানি পানি বলে কাঁদতে থাকি। আমাকে ময়লা পানি খাওয়ার কথা বলে। আমাকে পানি দেওয়া হয়নি। উল্টো মাথায় পানি ঢেলে দেওয়া হয়।”
মারধরের চোটে জ্ঞান হারিয়ে পড়ে যান জানিয়ে তিনি বলেন, চেতনা ফিরে এলে ওড়না দিয়ে বেঁধে গাছে ঝুলিয়ে রাখা হয়। সেসময় আমি অসুস্থ হয়ে পড়ি। সন্ধ্যায় জেল সুপার ওবায়দুর আমার হাতকড়া খুলে দেন।
রুনা লায়লার ভাই আব্দুল করিম বলেন, “এ ঘটনায় গাজীপুরের জেলা প্রশাসক (ডিসি) কাছে নির্যাতনের লিখিত অভিযোগ করেছি। এরপর দুটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে বলে জানতে পেরেছি।”
গাজীপুর শহীদ তাজ উদ্দীন আহমদ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সার্জারি বিভাগে সহযোগী অধ্যাপক শামসুল হুদা বলেন, “রোগীর শরীরে রক্তশূন্যতা দেখা গেছে। বেশ কিছু পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে দেওয়া হয়েছে, সেগুলোর রিপোর্ট আসেনি। রিপোর্টগুলো হাতে এলে রোগীর প্রকৃত অবস্থা বোঝা যাবে।”
এ ঘটনা সম্পর্কে জানতে চাইলে কাশিমপুর মহিলা কেন্দ্রীয় কারাগারের সিনিয়র জেল সুপার (ভারপ্রাপ্ত) ওবায়দুর রহমান বলেন, “রুনা গোপনে ৭ হাজার ৪০০ টাকা নিয়ে কারাগারে আসেন। বিষয়টি পরদিন তদন্ত করে পাওয়া যায়। টাকার বিষয়ে কারাগারের হাবিলদার ফাতেমা বেগম জানতে চাইলে তার সঙ্গে খারাপ আচরণ করেন তিনি।”
তবে রুনার পরিবারের অভিযোগ, ওই টাকা ছিনিয়ে নেওয়ার জন্য পাপিয়া ও তার সহযোগী কয়েদিরা রুনার ওপর অমানবিক নির্যাতন করেন। এক পর্যায়ে পিটিয়ে রক্তাক্ত অবস্থায় রুনাকে মেঝেতে ফেলে রাখা হয়। ঘটনার পরে আহত রুনাকে শহীদ তাজউদ্দীন আহমদ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হয়।
ওবায়দুর রহমান জানিয়েছেন, এ ঘটনায় কারা কর্তৃপক্ষ ও জেলা প্রশাসন দুইটি তদন্ত কমিটি গঠন করেছে। এ ছাড়া ২৬ জুন জেলার ফারহানা আক্তার, ডেপুটি জেলার জান্নাতুল তায়েবা এবং কারাগারের মেট্রনকে কারণ দর্শানোর নোটিসও দেওয়া হয়েছে। তবে এখনও কারো জবাব পাওয়া যায়নি।