৪৪২ বছর আগে এটিকে ‘সন্ন্যাসী মেলা’ বললেও সময়ের ব্যবধানে সেই মেলা এখন ‘জামাই মেলা’ হিসেবে পরিচিত হয়ে উঠেছে।
Published : 14 Feb 2024, 08:13 PM
বগুড়া শহর থেকে ১১ কিলোমিটার দূরে গাবতলী উপজেলার মহিষাবান ইউনিয়নের পোড়াদহ গ্রাম। যেখানে মাঘের শেষ বুধবার বসে ‘জামাই মেলা’। আর মাঘের শেষ সপ্তাহে যদি বুধবার না পড়ে তাহলে ফাগুনের প্রথম বুধবারে অনুষ্ঠিত হয় এ মেলা।
৪৪২ বছর আগে এটিকে ‘সন্ন্যাসী মেলা’ বললেও সময়ের ব্যবধানে সেই মেলা এখন ‘জামাই মেলা’ হিসেবে পরিচিত হয়ে ওঠেছে। মেলাটি উত্তরাঞ্চলের সবচেয়ে বড় মাছ ও মিষ্টির মেলা। বুধবার সকাল থেকেই শুরু হয় মেলা। চলবে রাত গভীর পর্যন্ত।
সরজমিনে গিয়ে দেখা যায়, মাছ ও মিষ্টির দোকানে হাজার হাজার ক্রেতা-বিক্রেতা এবং শত শত মাছ-মিষ্টির দোকান, সার্কাস, নাগরদোলা, মোটরসাইকেল খেলাসহ আরও অনেক দোকানের সমাহার।
আশপাশের জেলা-উপজেলা থেকেও এসেছেন ক্রেতারা। তবে সকালেই মেলায় গাবতলীর বিভিন্ন এলাকার জামাই-শ্বশুর একসঙ্গে মাছ ও মিষ্টি কিনতে ভিড় জমিয়েছেন।
মেলায় ছোট-বড় কয়েকশ মাছ ও মিষ্টির দোকান নিয়ে বসেছেন বিক্রেতারা। এবার মেলার সবচেয়ে বড় মাছ হল সমুদ্রের ‘পাখি মাছ’। ওজন ৪০ কেজি।
এ ছাড়া ১০, ১৫ এবং ৩০ কেজির রুই, কাতলা, বোয়াইল, কার্প, আইড়, চিতল ইত্যাদি উঠেছে।
তবে আগের মত সামুদ্রিক ও বড় বড় মাছের আমদানি এবার কম। বাঘাইর বিক্রি নিষিদ্ধ থাকায় তা মেলায় চোখে পড়েনি। অথচ বাঘাইর মাছ ছিল ওই মেলার প্রসিদ্ধ মাছ।
মেলাটি আগে শুধু পোড়াদহেই বসত। কিন্তু জায়গা স্বল্পতা ও দলাদলির কারণে এখন ‘পোড়াদহ মেলা’ নামেই মূল জায়গার বাইরেও প্রায় ১২টি জায়গায় এ মেলা বসে থাকে।
কথিত আছে, বহুবছর আগে পোড়াদহের ইছামতী তীরে বট-পাকুড় গাছের নিচে এক সন্ন্যাসী এসে ধ্যান-পূজা করতেন। সন্ন্যাসী মারা যাওয়ার পর স্থানীয় লোকজন মূর্তি বানিয়ে পূজা শুরু করেন।
পরে ধীরে ধীরে সেই পূজার দিনে হাজার হাজার মানুষের সমাগম ঘটলে তা মেলায় পরিণত হয়ে ওঠে।
আগের সেই বট-পাকুড় গাছ মারা গেলে সেখানে আরও দুটি গাছ লাগানো হয়। সেখানেই মেলা বসে এখন। মেলা উপলক্ষে পূজার আয়োজনও করা হয়।
গাবতলীর দূর্গাহাটার সৌরভ আহাম্মেদ বলেন, “বাড়িতে বোন-জামাই এবং আত্মীয়-স্বজন এসেছে তাই মাছ কিনলাম। তাছাড়া মেলায় বড় মাছ এবং মিষ্টি কেনা আমাদের এলাকার ঐতিহ্য। ঈদে খরচ কম করলেও এলাকার ধনী-গরিব মেলা উপলক্ষে বড় বাজেট রাখে এবং জামাই, আত্মীয়দের দাওয়াত করে।”
বগুড়া শহরের সেউজগাড়ী এলাকার শিপন মণ্ডল বিয়ে করেছেন মেলার পাশের গ্রাম দূর্গাহাটায়। শ্বশুরের সঙ্গে মেলায় এসেছেন।
তিনি বলেন, “প্রথা অনুযায়ী মেলার আগে জামাইদের আমন্ত্রণ করা হয়। তারপর জামাইরা শ্বশুরবাড়িতে এসে শ্বশুর-শাশুড়ি ও স্বজনদের সালাম করবে এবং তারা টাকা দেবে।
“সেই টাকার সঙ্গে নিজের টাকা যোগ দিয়ে মেলা থেকে মাছ-মিষ্টি কিনে ধুমধাম করে আনন্দ উৎসব করা হয়।”
কলাকোপা গ্রামের স্কুলশিক্ষক তাসলিমা আক্তার বলেন, “আজ ছুটির দিন। তাই প্রাণের মেলায় ছুটে এলাম। মাছের সঙ্গে মিষ্টিও কিনেছি।”
এদিকে টাঙ্গাইল থেকে মেলায় আসা মাছ বিক্রেতা ফয়সল জানান, তিনি কুয়াকাটা থেকে সামুদ্রিক মাছ মেলায় এনেছেন। এবার বিরল প্রজাতির পাখি মাছসহ অন্যন্যা মাছ এনেছেন। ৪০ কেজি ওজনের মাছটি দেখতে লোকজন ভিড় জমিয়েছেন। মাছের দাম চাওয়া হচ্ছে ৫৫ হাজার টাকা।
বগুড়ার শেরপুরের ব্যাপারী মনু মন্ডল সিরাজগঞ্জ থেকে ২৫ কেজি ওজনের কাতলা মাছ এনেছেন। দাম চাচ্ছেন ৪২ হাজার ৫০০ টাকা। বিক্রি করলেন ৪০ হাজার টাকা। এ ছাড়া আরও বিভিন্ন মাছ এনেছেন।
এবার মেলায় পাঁচ লাখ টাকার মাছ বিক্রির টার্গেট রয়েছে বলে জানান তিনি।
শাহজাহানপুর উপজেলার মাঝিরার মিষ্টি বিক্রেতা মুন্জুরুল ইসলাম বলেন, মেলায় মাছের আকৃতির পাঁচ থেকে ১২ কেজি ওজন পর্যন্ত মিষ্টি নিয়ে এসেছি। প্রতি কেজি পাঁচশ টাকা করে বিক্রি করছি।
বছর ঘুরে পোড়াদহে ফের মাছের মেলা
“এ ছাড়া স্পঞ্জ মিষ্টি, রাঘো বশাই, রসগোল্লা, কালোজাম, হাসিখুশি মিষ্টিসহ অনেক ধরনের মিষ্টি এনেছি। রাতের মধ্যেই সব বিক্রি হবে। গতবার সাত লাখ টাকার মিষ্টি বিক্রি করেছিলাম। আশা করি, এবার আরও বেশি হবে।”
এদিকে মেলার মাঠে বট-পাকুড় গাছের নিচে আয়োজন করা হয়েছে সন্ন্যাস পূজার। পূজা মণ্ডপের পুরোহিত মহিষাবানের দেবেন্দ্রনাথ পাল জানান, মেলার আগের দিন মঙ্গলবার পূজার মাধ্যমে মেলার আনুষ্ঠানিকতা শুরু হয়। বুধবারে মেলা বসে এবং বৃহস্পতিবার সন্ন্যাস পূজা শেষে মূর্তি ইছামতী নদীতে ভাসান দেওয়া হয়।
পূজা মণ্ডপের সাধারণ সম্পাদক শংকর কুমার রায় জানান, ৪৪২ বছর আগের মেলাটি। মেলাটি বসে মাঘ মাসের শেষ বুধবার। যদি মাঘের শেষ সপ্তাহে বুধবার না পড়ে তাহলে ফাগুনের প্রথম বুধবারে অনুষ্ঠিত হয়। এটা প্রথম থেকেই চালু হয়ে আসছে। আগের বট-পাকুড় গাছ মারা গেলে সেখানে আবারও নতুন করে গাছ লাগানো হয়েছে। গাছের গোড়ায় প্রাচীর দিয়ে ঘিরে সন্ন্যাস পূজা করা হয়।
উপজেলার ভাইস চেয়ারম্যান আমিনুল ইসলাম মুক্তা বলেন, আগে পোড়াদহ মেলা শুধু ইছামতীর তীরে গোলাবাড়ীতে হত। সেখানে আবাদি জমি, বাড়িঘর, ব্যাবসা প্রতিষ্ঠান হওয়ায় মেলার জায়গা কমে গেছে। তাই মেলা ছড়িয়ে পড়েছে সারা উপজেলা এমনকি বগুড়া শহর পর্যন্ত। একই দিনে বগুড়ার চেলোপাড়া চাষি বাজার, দাঁড়াইল বাজার, উদ্দিরখোলা, সুবোধ বাজার, দূর্গাহাটাসহ ১২টি জায়গায় মেলা বসছে।
মেলা কমিটির ইজারাদার মহিষাবাথান ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মো. আব্দুল মজিদ বলেন, মেলায় মূলত মাছ ও মিষ্টি কিনতে আসে লোকজন। এরা আগে সন্ন্যাসী মেলা হলেও কালের বিবর্তনে এখন কেউ বলে জামাই মেলা, কেউবা বলে মাছ-মিষ্টির মেলা।
এ মেলায় ১০ কোটি টাকার ব্যাবসা হবে। এ ছাড়া আরও অন্য দোকানেও বিক্রি এবং সার্কাস, মোটরসাইকেল খেলা, নাগর দোলাসহ আরও পাঁচ কোটি টাকার ব্যাবসা হবে বলে জানান আব্দুল মজিদ।
এ বিষয়ে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) নুসরাত জাহান বন্যা বলেন, সুষ্ঠু, সুন্দর পরিবেশ মেলা অনুষ্ঠিত হচ্ছে। মেলাটি এই এলাকার প্রাণের স্পন্দন। আশা করি, যুগ যুগ ধরে পোড়াদহ মেলার ঐতিহ্য থাকবে।