চাষি ও ব্যবসায়ীরা বলছেন, পাটের আঁশের রং এবার ভাল আসেনি বলে দাম কম
Published : 20 Aug 2022, 04:08 PM
পর্যাপ্ত পানির অভাবে জাগ দিতে না পারায় পাটের গুণগত মান কমেছে, জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধির কারণে বেড়েছে উৎপাদন খরচ; এরপর বাজারে এসে যে দাম পাচ্ছেন তাতে খরচ তোলাই কঠিন হয়ে পড়েছে বলে জানিয়েছেন ফরিদপুরের চাষিরা।
দেশের সোনালী আঁশের বড় বাজার ফরিদপুরের বিভিন্ন মোকামে পাট তোলতে শুরু করায় সেখানে ভিড় করেছেন সরকারি-বেসরকারি পাটকলের এজেন্টরা। তারা জানাচ্ছেন, এবারের পাটের রং ভাল আসেনি, তাই দাম কম।
ফরিদপুরের সবচেয়ে বড় পাটের বাজার সদর উপজেলার কানাইপুরে পাট বেচতে আসা কৃষক সত্তার মাতুব্বর বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “গত বছর যে পাট সাড়ে তিন হাজার থেকে চার হাজার টাকায় বিক্রি হয়েছে; এবার সেই পাটের দাম ২২০০ টাকা থেকে ২৮০০ টাকা পর্যন্ত।”
“এবার তো বৃষ্টি হয়নি। ডিজেল দিয়ে স্যালো মেশিন চালিয়ে খাদে পানি তুলতে হয়েছে। জ্বালানি তেলের দাম বেড়েছে। শ্রমিকের খরচও আগের চেয়ে বেশি। এবার তো খরচই উঠছে না। লাভ তো দূরের কথা।”
কানাইপুর বাজারের পাট ব্যবসায়ী ও কানাইপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ফকির বেলায়েত হোসেন বলেন, “এবার পাটের জাগ দেওয়ার সমস্যা হয়েছে। এ কারণে পাটের আঁশের রং ভাল আসেনি। রং ভাল না থাকায় চাষি কাঙ্ক্ষিত দর পাচ্ছেন না।”
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক ড. হযরত আলী (সম্প্রতি বদলি হয়েছেন) বলেন, জেলায় মোট আবাদী জমির পরিমাণ এক লাখ ৪৫ হাজার হেক্টর। এর মধ্যে এবার ৮৭ হাজার ৬০০ হেক্টর জমিতে পাট করেছেন প্রায় দেড় লাখ চাষি। উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে আড়াই লাখ মেট্রিক টন।
এবার যে পাট বাজারে আসছে তার মধ্যে ১৫ থেকে ২০ শতাংশ উৎকৃষ্ট মানের; বাকি ৮০ থেকে ৮৫ শতাংশ সাধারণ বা গড়পড়তা মানের। উৎকৃষ্ট মানের পাটটিই এখন বাজারে ২৮০০ টাকা মণ দরে বিক্রি হচ্ছে বলে জানালেন চাষি ও ব্যবসায়ীরা।
কানাইপুর বাজার ছাড়াও বোয়ালমারী উপজেলার সাতৈর, কাদিরদি, সালথা বাজার, নগরকান্দা বাজার ও তালমা, সদরপুরের কেষ্টপুরে বড় বড় চাষিরা পাট নিয়ে আসেন। সব হাটেই পাট আসতে শুরু করেছে।
কানাইপুর বাজার বসে সপ্তাহে প্রতি শুক্র ও মঙ্গলবার। সেখানে সরজমিনে গিয়ে দেখা যায়, শত শত চাষি রিকশা, ভ্যানে করে পাট নিয়ে মোকামে আসছেন। পাটগুলোর এজেন্টরা গুদামের সামনে বসে পাট কিনছেন। বাজারের ব্যবসায়ীরাও ব্যস্ততার মধ্যে সময় কাটাচ্ছেন।
ব্যবসায়ী ও চাষিরা জানান, এই বাজারে মৌসুমে প্রতি হাটে ২০ হাজার থেকে ২৫ হাজার মণ পাট কেনাবেচা হয়। কিন্তু এবার দাম না পেয়ে হতাশ চাষিরা।
চাষি কালাম মোল্লা বলেন, গত বছর তার প্রতি মণ পাটের উৎপাদন খরচ ছিল ১২০০ থেকে ১৪০০ টাকা। কিন্তু এবার তা দুই হাজারের উপরে চলে গেছে।
কেন খরচ বাড়লো- প্রশ্নের জবাবে এই চাষি বলেন, এবার তো বৃষ্টি হয়নি। পাট জাগ দিতে খুব সমস্যা হয়েছে। স্যালো মেশিন দিয়ে গর্তে পানি তোলে পাট জাগ দিতে হয়েছে। যখন এটা করতে হয়েছে তখন ডিজেলের দাম বেড়ে গেছে। এ কারণে খরচ অনেক বেড়েছে।
চাষি জিতেন সরকার বলেন, আগের বছর একজন শ্রমিককে গড়ে দৈনিক ৫০০ থেকে ৬০০ টাকা দিতে হয়েছে। কিন্তু এবার ৭০০-৮০০ টাকায় শ্রমিক নিতে হয়েছে। জাগের সমস্যার কারণে শ্রমিক খরচ অনেক বেড়েছে। এসব মিলে এবার খরচ মণপ্রতি ২১০০ টাকার উপরে চলে গেছে। তারপরও রং ভাল আসেনি।
“এখন বাজারে এসে ২২০০ থেকে ২৩০০ টাকা দাম পাচ্ছি। নিজের পরিশ্রম, কষ্টের কথা তো বাদই দিলাম।”
বাজারে পাট নিয়ে আসা অনেক চাষিই বললেন, তারা এই পাটের ওপরই নির্ভরশীল। সারা বছরের সংসার খরচ, ছেলেমেয়েদের লেখাপড়া, অসুখ-বিসুখ সবকিছুই তাদের পাট চাষকে কেন্দ্র করে। ভাল দাম না পাওয়ায় তারা হতাশা প্রকাশ করেন।
কানাইপুর ইউপির চেয়ারম্যান ফকির বেলায়েত হোসেন আরও বলেন, “পাটের বাজারের জন্য কানাইপুরের বেশ সুনাম রয়েছে। এখানে প্রতি হাটেই প্রান্তিক চাষিরা তাদের উৎপাদিত পাট সরাসরি নিয়ে আসেন বিক্রয়ের জন্য। কিন্তু এবার পানি সংকটে পাটের সোনালি রং আসেনি, এতে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন চাষিরা।”
ফরিদপুর চেম্বার অব কমার্সের প্রেসিডেন্ট নজরুল ইসলাম বলেন, “পাট উৎপাদনে সারা দেশের মধ্যে ফরিদপুর সেরা। গোল্ডেন ফাইবারটি এ জেলাতে হয়। চাষিরা আবাদ ভাল করেছে, উৎপাদনও ভাল।”
“কিন্তু পাটের জাগ দেওয়ার সমস্যার কারণে রং আসেনি। যে কারণে চাষি দর ভাল পাচ্ছেন না। এতে শুধু চাষি নয়, পাটের সঙ্গে সম্পৃক্ত ব্যবসায়ী, পাটকল মালিক সবাই আর্থিক ক্ষতির মুখে পড়লো।”