শিল্পী আক্তার কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেন, “কারও কাছে আমাদের কিছু বলার নেই৷ কথা বলে বিপদ আর বাড়াতে চাই না৷”
Published : 08 Nov 2023, 12:15 PM
নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁ উপজেলার ‘পুলিশের মারধরের পর’ এক ব্যবসায়ীর মৃত্যুর অভিযোগ ওঠায় তিন পুলিশ সদস্যকে কর্মস্থল থেকে প্রত্যাহার করা হয়েছে।
জেলা পুলিশের মুখপাত্র অতিরিক্ত পুলিশ সুপার চাইলাউ মারমা মঙ্গলবার রাতে জানান, এএসআই ইলিয়াস আহমেদ ও দুই কনস্টেবলকে তাদের কর্মস্থল থেকে প্রত্যাহার করে পুলিশ লাইনসে সংযুক্ত করা হয়েছে৷ তাদের বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগ তদন্ত করে দেখা হবে৷
সোমবার বিকালে সোনারগাঁয়ের বুরুমদী মধ্যপাড়া গ্রামে পোল্ট্রি ব্যবসায়ী নুরুল ইসলামের বাড়িতে পুলিশের অভিযানের পর তার মৃত্যু হয়৷ পরে নুরুলের দুই মেয়ে ও স্বজনরা সাংবাদিকদের কাছে অভিযোগ করেন, ‘চাঁদার দাবিতে পুলিশের মারধরে’ অসুস্থ হয়ে তিনি মারা যান।
মারধরের অভিযোগ অস্বীকার করে পুলিশের পক্ষ থেকে তখন বলা হয়েছিল, ‘পুলিশ দেখে ভয়ে হার্ট অ্যাটাক’ হয়েছিল ৫৫ বছর বয়সী নুরুলের।
মঙ্গলবার দুপুরে নুরুলের বাড়িতে গেলে বাবার মৃত্যু নিয়ে কথা বলতে চাইছিলেন না তার মেয়েরা৷ দৃশ্যত তারা ছিলেন আতঙ্কিত।
উপজেলার শেষ সীমানা বুরুমদী মধ্যপাড়া গ্রামে একতলা পাকা দালান পোল্ট্রি ব্যবসায়ী নুরুল ইসলামের৷ পাঁচ মেয়ের বিয়ে হওয়ার পর ওই বাড়িতে স্ত্রীকে নিয়ে থাকতেন তিনি।
মঙ্গলবার দুপুরে গ্রামের ইট বিছানো সড়কের পাশে বাড়িটির উঠানে গেলে নুরুলের মেয়ের জামাই মোহাম্মদ হোসেন ও মেয়ে শিল্পী আক্তারের সঙ্গে দেখা হয়৷ তবে সংবাদকর্মী পরিচয় পেয়ে তারা সোমবারের ঘটনা নিয়ে কথা বলতে অসম্মতি জানান৷
শিল্পী আক্তার কান্নাজড়িত কণ্ঠে মিনতি করে বলেন, “কারও বিরুদ্ধে আমাদের কোনো অভিযোগ নেই৷ আমরা মীমাংসা করে ফেলছি৷ আমার বাবার স্বাভাবিক মৃত্যু হয়েছে৷ আমরা আর কোনো ঝামেলা চাই না৷ আপনারা এখান থেকে চলে যান৷
“কারও কাছে আমাদের কিছু বলার নেই৷ কথা বলে বিপদ আর বাড়াতে চাই না৷”
তবে ওই বাড়িতে পুলিশি অভিযান, তারপর নুরুল ইসলামের মৃত্যু এবং পরে মীমাংসার বিষয়গুলো আশেপাশের গ্রামের মানুষও জানে।
জামপুর ইউনিয়নের ৬ নম্বর ওয়ার্ডে নুরুলের বাড়ি থেকে অন্তত তিন কিলোমিটার দূরত্বে প্রভাকরদী বাজারে এক রিকশাচালককে ঘটনার কথা বলতেই তিনিই প্রতিবেদককে বাড়ির সামনে নিয়ে এসেছিলেন।
এ ছাড়া মঙ্গলবার স্থানীয় অন্তত ১২ জনের সঙ্গে কথা হয় এ প্রতিবেদকের৷ তাদের মধ্যে নুরুলের দুই সহোদর, এক ভাবী, এক মামাতো ভাই এবং প্রতিবেশী আরও চারজন সোমবার বিকালের ঘটনা থেকে মঙ্গলবার সকালে নুরুল ইসলাম দাফন পর্যন্ত বিস্তারিত জানান৷
তারা জোর দিয়ে বলছিলেন, ‘চাঁদা না পেয়েই’ নুরুলের ওপর নির্যাতন করা হয়। তিন বছর আগে ওপেন-হার্ট সার্জারি হয়েছিল নুরুলের। অসুস্থ শরীরে তিনি সেটা সহ্য করতে পারেননি৷
গ্রামের পরিচিত মুখ নুরুল ইসলাম জাতীয় পার্টির সমর্থক এবং সভা-সমাবেশেও তিনি উপস্থিত থাকতেন বলে স্থানীয়রা জানান৷
নুরুলের বাড়ির পাশে একটি দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে কথা হয় তার ছোটভাই শামসুল ইসলামের সঙ্গে৷ দুই ভাইয়ের পাশাপাশি ঘর৷ ঘটনার সময় ঘরেই ছিলেন শামসুল৷
তিনি বলেন, ‘চেঁচামেচি শুনে ঘর থেকে বেরিয়ে দেখি দারোগা ইলিয়াস রে৷ তারে এ গ্রামের প্রায় সকলেই চেনে৷ আমার ভাইয়ের হাতে তখন হ্যান্ডকাফ৷ তার শ্বাস নিতে কষ্ট হইতেছিল৷
“আমি ইলিয়াস দারোগারে কইলাম ভাইয়ে হার্টের রোগী, তার সার্জারি হইছে৷ আপনে চেনা-পরিচিত লোক, এমনে মারধর কইরেন না৷ এই কথা বলায় ইলিয়াস আমার উপরে চেইতা যায়৷ আমি আর কথা না বাড়াইয়া সেখান থেকে বাজারের দিকে চলে যাই৷
হাতের উল্টোপিঠে চোখ মুছতে মুছতে শামসুল বলেন, “কিছুক্ষণ পরে জানতে পারি পুলিশের মাইরে অসুস্থ হইয়া আমার বড়ভাই মারা গেছে৷”
পাশে দাঁড়ানো নুরুলের মামাতো ভাই দেলোয়ার হোসেন তখন বলে ওঠেন, “প্রজারা অন্যায় করলে বিচার করে রাজায়, আর রাজায় অন্যায় করলে বিচার করে খোদায়৷ আমাগো বিচারডাও খোদার কাছে দিয়া রাখলাম৷”
ঘটনার দিন বিকালে বাজারে যাওয়ার পথে চেচামেচি শুনতে পেয়ে নুরুলের বাড়িতে ঢোকেন প্রতিবেশী কৃষক এসএম ইমরান ওরফে টিপু৷
ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী টিপু বলেন, “কেউ উচিত কথা কইলেই কইবো হ্যায় মাদক ব্যবসায়ী, হ্যায় পুলিশ মারছে, অমুক করছে তমুক করছে৷ কিন্তু সত্য হইছে ওয়ারেন্ট ছাড়াই অভিযান চালাইয়া, কোনো কিছু না পাইয়া হ্যান্ডকাফ লাগাইয়া রাখব ক্যান?
“সত্যি কোনো অপরাধ থাকলে আইন অনুযায়ী ধইরা নিব, টর্চার করার অধিকার তো পুলিশের নাই৷ কোনো মাদক বা মামলা না, টাকা নিতে আইছিল, টাকা নিয়াই ওরা গেছে৷ নুরুলের বউ দারোগারে টাকা দিছে৷”
এর আগে সোমবার রাতে নুরুলের মেয়ে মিথিলা আক্তার সাংবাদিকদের বলেন, সোমবার বিকালে সোনারগাঁ থানাধীন তালতলা পুলিশ তদন্ত কেন্দ্রের এএসআই ইলিয়াস আহমেদ এক কনস্টেবলকে নিয়ে তাদের বাড়িতে আসেন৷ দুজনেই সাদা পোশাকে ছিলেন৷ তারা ‘এক লাখ টাকা দাবি করেন’, না দিলে ওই এএসআই তাকে চলমান ‘রাজনৈতিক মামলায় ফাঁসানোর’ হুমকি দেন৷
“আমরা ৫০ হাজার টাকা দিতে রাজি হয়েছিলাম, কিন্তু প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে এএসআই ইলিয়াস আমার বাবাকে হাতকড়া পরিয়ে বাড়ি থেকে বের করে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে।
“আমার বাবা বাধা দিলে পুলিশের সঙ্গে হাতাহাতি হয়। এরপর তারা আমার বাবাকে কিলঘুষি ও লাঠি দিয়ে মারধর করে। একপর্যায়ে বাবা মাটিতে লুটিয়ে পড়লে পুলিশ সদস্যরা সেখান থেকে চলে যায়।”
নুরুল ইসলামকে পরিবারের সদস্যরা আড়াইহাজার উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে গেলে সেখানে চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন। জরুরি বিভাগের রেজিস্ট্রারে লেখা আছে, বিকাল পৌনে ৫টার দিকে তাকে হাসপাতালে নেওয়া হয়।
এ হাসপাতালের আবাসিক চিকিৎসক আশরাফুল আমিন বলেন, “হাসপাতালে তাকে মৃত অবস্থায় আনা হয়৷ ইসিজি করার পর তার মৃত্যুর ব্যাপারটি নিশ্চিত হওয়া যায়৷”
তবে নুরুলের মৃত্যুর কারণ সম্পর্কে কিছু জানাতে পারেননি এ চিকিৎসক৷
এদিকে নুরুলের মৃত্যুর খবর পেয়ে পুনরায় ওই বাড়িতে যায় সেই দুই পুলিশ সদস্য৷ ক্ষুব্ধ স্বজনরা তখন তাদের একটি ঘরে অন্তত দুই ঘণ্টা অবরুদ্ধ করে রাখে বলে স্থানীয়দের ভাষ্য।
সন্ধ্যার পর অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (‘খ’ সার্কেল) শেখ বিল্লাল হোসেন ও সোনারগাঁ থানার ওসি মাহবুব আলম ঘটনাস্থলে গিয়ে দুই পুলিশ সদস্যকে উদ্ধার করেন।
খবর পেয়ে ঘটনাস্থলে যান নারায়ণগঞ্জ-৩ আসনের সংসদ সদস্য ও জাতীয় পার্টির প্রেসিডিয়াম সদস্য লিয়াকত হোসেন খোকা৷
একাধিক প্রত্যক্ষদর্শী বলেছেন, নুরুলের পরিবারের সদস্য ও পুলিশকে নিয়ে একটি কক্ষে দীর্ঘক্ষণ আলাপ করেন লিয়াকত৷ আলাপ শেষে বের হওয়ার পরপরই বদলে যায় সবকিছু৷ সংসদ সদস্য নিজে এ পরিবারের দায়িত্ব নেবেন জানিয়ে বিনা ময়নাতদন্তে লাশ দাফন করার কথা বলেন৷
পরে পুলিশও সেখান থেকে চলে যায়৷ বিনা ময়নাতদন্তেই নুরুলের মরদেহ দাফন করা হয়৷ পরিবারের সদস্যরা থানায় আর কোনো লিখিত অভিযোগ করেননি।
এ বিষয়ে কথা বলতে সংসদ সদস্যের মোবাইলে একাধিকবার ফোন করা হলেও তিনি ধরেননি।
অভিযোগের বিষয়ে এএসআই ইলিয়াস আহমেদের বক্তব্যও বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম জানতে পারেনি।
তবে তালতলা পুলিশ তদন্ত কেন্দ্রের ইনচার্জ পরিদর্শক সাইফুল ইসলাম মঙ্গলবার বলেছিলেন, মাদক সংক্রান্ত গোপন সংবাদের ভিত্তিতে পুলিশ নুরুলের বাড়িতে অভিযানে গিয়েছিল।
“পুলিশ মাদক উদ্ধারের জন্য তার বাড়িতে গিয়েছিল। কিছুই না পেয়ে তারা স্থান ত্যাগ করে। হৃদরোগী হওয়ায় পুলিশের ভয়ে তার মৃত্যু হতে পারে।”
‘সাদা পোশাকে’ অভিযানের বিষয়ে জানতে চাইলে এ পুলিশ কর্মকর্তা বলেছিলেন, “কখনও কখনও প্রয়োজনে সাদা পোশাকে পুলিশ অভিযান চালায়।”=
নুরুলের ব্যক্তির বিরুদ্ধে মাদক সংক্রান্ত কোনো মামলা আছে কিনা এবং এর আগে কখনো তাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে কিনা জানতে চাইলে নিশ্চিত করে কিছু বলতে পারেননি এ পুলিশ কর্মকর্তা।
পুরানো খবর:
‘নির্যাতনে’ ব্যবসায়ীর মৃত্যুর অভিযোগ, পুলিশ বলছে ‘ভয়ে হার্ট অ্যাটাক’