ভূমিকা রায় ও বৃষ্টি রায় দুই বোন মায়ের সঙ্গে মহালয়ার উৎসবে অংশ নিতে যাচ্ছিল পঞ্চগড়ের বোদা উপজেলার বরদেশ্বীর মন্দিরে। নৌকা ডুবিতে জীবনের কলরব থেমে গেছে দুই বোনের। দুই মেয়েকে হারিয়ে বাবা দীপক চন্দ্র রায় আর মা ছন্দা রানী রায় এখন নির্বাক। শারদীয় উৎসবের রং মুছে পরিবারে চলছে শোকের মাতম।
ভূমিকা পঞ্চগড় সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ে নবম শ্রেণিতে এবং বৃষ্টি স্থানীয় সানন্দা কিন্ডারগার্টেনে দ্বিতীয় শ্রেণিতে পড়ত। তাদের বাবা দীপক চন্দ্র বোদা উপজেলার ধনিপাড়া-গাইঘাটা বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের বিজ্ঞানের শিক্ষক আর ছন্দা রাণী গৃহিণী। তারা থাকেন বোদা উপজেলা সদরের কলেজ পাড়ায়।
দুর্ঘটনার একদিন পর সোমবার বৃষ্টির মরদেহ এবং মঙ্গলবার ভূমিকার মরদেহ উদ্ধার করেছে ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের সদস্যরা।
রোববার মহালয়া উপলক্ষে জেলার বিভিন্ন এলাকা থেকে আসা সনাতন ধর্মাবলম্বীরা নৌকায় করে বোদা উপজেলার বরদেশ্বরী মন্দিরে যাচ্ছিলেন উৎসবে যোগ দিতে। দুপুরের দিকে মাড়েয়া বামনহাট ইউনিয়নের আউলিয়া ঘাট এলাকায় একটি নৌকা উল্টে যায়।
প্রত্যক্ষদর্শীরা বলছেন, নৌকাটিতে দেড় শতাধিক যাত্রী ছিল। কিছু মানুষ সাঁতরে নদীর তীরে ফিরতে পারলেও অনেকে নিখোঁজ থাকেন। নৌকাডুবির পরপরই স্থানীয়রা নৌকা নিয়ে উদ্ধার কাজ শুরু করেন। পরে পুলিশ ও ফায়ার সার্ভিস কর্মীরা নামেন তল্লাশিতে।
মঙ্গলবার রাত পর্যন্ত মোট ৬৮ জনের লাশ উদ্ধার করা হয়েছে বলে জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে।
ভূমিকা ও বৃষ্টির বাড়ি গিয়ে দেখা যায়, মা ছন্দা বেগম নির্বাক হয়ে বসে আছেন। মাঝে মাঝেই দুই মেয়ের নাম করে প্রলাপ বকছেন। প্রতিবেশী যারা সান্ত্বনা দিতে এসেছেন তাদের চোখেও জল।
দীপক চন্দ্র বলেন, “রোববার সকালে ভূমিকা মন্দিরে যাওয়ার আগে আমাকে বলেছিল, বাবা আমরা মায়ের সাথে মহালয়ার উৎসবে যাচ্ছি। তাড়াতাড়ি ফিরে আসবো। আমাদের ফিরতে দেরি হলে তুমি এসে খেয়ে নিও, মা তোমার জন্য রেঁধে রেখেছে। আমি বলেছিলাম, সাবধানে যাবি, তাড়াতাড়ি ফিরে আসবি।”
আর কিছু বলতে পারেননি দীপক। নির্বাক তাকিয়ে ছিলেন।
পাশে বসে এ সময় প্রলাপ বকছিলেন ছন্দা, ভগবান কেন তাকে না নিয়ে মেয়ে দুটোকে নিলেন। মেয়ে দুটো ছাড়া তিনি কীভাবে বাঁচবেন। ভগবান যেন তাকে তুলে নেন।
প্রতিবেশী একজন বলেন, বাবা তো চাকরিতে থাকতেন। মা তাদের দেখাশোনা করতেন। দুই বোনের মধ্যে সারাদিন খুনসুটি লেগেই থাকত। দুই বোন সারা বাড়ি মুখর করে রাখত।
“এখন সেই ঘর শূন্য হয়ে গেল। বাবা-মা যে কীভাবে বাঁচবেন? ভগবানের লীলা।”
লাশ উদ্ধারের খবর পেয়ে বাড়ি এসেছিলেন ভূমিকার স্কুলের শিক্ষক শহিদুল ইসলাম। তিনি বলছিলেন, ভূমিকা বেশ মেধাবী ছিল। এভাবে হারিয়ে যাবে ভাবতেই পারছি না।
তাদের পড়শি অবসরপ্রাপ্ত কলেজ শিক্ষক আব্দুর রশিদ বলেন, “সকাল হলেই মেয়ে দুটোর সঙ্গে দেখা হতো, বড় মেয়েটা খুব সম্মান করে আঙ্কেল ডাকত। আমার কোলে বড় হয়েছে।
“ওদের বাবা-মাকে সান্ত্বনা দেওয়ার ভাষা আমাদের কারো জানা নেই। আউলিয়ার ঘাটে হয়তো একদিন সেতু ঠিকই হবে কিন্তু এই সম্ভাবনাময় জীবনগুলো আর ফিরে পাওয়া যাবে না।”
প্রতিবেশী বীপিন চন্দ্র বলেন, “দুর্গা দেবী তো এবার সব নিয়ে গেলেন। আমাদের পূজা হয়তো কোনোমতে হবে। উ্ৎসব থাকবে তবে সেটা হবে সবার শোকের উৎসব। হারানোর উৎসব।”
আরও পড়ুন: