আরসার সেকেন্ড-ইন-কমান্ড খালেদের নির্দেশনা অনুযায়ী বিভিন্ন রোহিঙ্গা ক্যাম্পে আরসার সদস্যদের কাছে সরঞ্জাম পাঠাতেন রহমত উল্লাহ।
Published : 31 Dec 2023, 04:30 PM
কক্সবাজার শহরের পর্যটন জোন কলাতলী এলাকায় মিয়ানমারের সন্ত্রাসী গোষ্ঠী আরকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মির (আরসা) একটি আস্তানায় অভিযান চালিয়েছে র্যাব।
র্যাব বলছে, এই আস্তানায় বিভিন্ন স্থান সংগ্রহ করা বিস্ফোরকসহ বোমা ও মাইন তৈরির নানা ধরনের সরঞ্জাম মজুদ করত আরসা। পরে নাশকতার উদ্দেশ্যে সেগুলো পাঠানো হত উখিয়া-টেকনাফের বিভিন্ন রোহিঙ্গা ক্যাম্পে।
রোববার দুপুরে এক সংবাদ সম্মেলনে র্যাব কক্সবাজার ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল এইচ এ সাজ্জাদ হোসেন জানান, আস্তানাটি থেকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে আরসার লজিস্টিক শাখার প্রধান হাফেজ রহমত উল্লাহসহ তিন সন্ত্রাসীকে।
উদ্ধার করা হয়েছে- ৪.৯ কেজি বিস্ফোরক দ্রব্য, ১৫টি হাতবোমা, আইইডি তৈরির সরঞ্জাম, ১.৫ কেজি মারকারী, ১টি ওয়াকি-টকি, ৫৩টি সার্কিট, ৯ বান্ডিল সামরিক বাহিনীর মতো পোশাক তৈরির কাপড়, ৭০টি গেঞ্জি, ১২টি টুপি, ১৩০টি হ্যান্ড গ্লাভস, ১টি ল্যাপটপ।
র্যাব-১৫ এর কার্যালয়ে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে র্যাব জানিয়েছে, মূলত আরসা রোহিঙ্গা ক্যাম্পে নাশকতার পরিকল্পনা নিয়ে কাজ করত। ইতিমধ্যে আরসা প্রধান আতাউল্লাহর একটি অডিও বার্তাও র্যাবের হাতে এসেছে। যেখানে ক্যাম্পে নাশকতা ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের ওপর হামলার নির্দেশ দিয়েছে সন্ত্রাসী গোষ্ঠীটির প্রধান।
সংবাদ সম্মেলনে লেফটেন্যান্ট কর্নেল সাজ্জাদ বলেন, “রাষ্ট্রীয় একটি বিশেষ গোয়েন্দা সংস্থার তথ্যের ভিত্তিতে রোববার ভোররাত থেকে সকাল ৯টা পর্যন্ত কক্সবাজার শহরের কলাতলী আদর্শগ্রামের ডিসি পাহাড় সংলগ্ন ভাড়া বাড়িটিতে অভিযান চালানো হয়। ”
অভিযানে গ্রেপ্তাররা হলেন, আরসার লজিস্টিক শাখার প্রধান হাফেজ রহমত উল্লাহ (৩৫), ১০ জনের একটি উপদলের নেতা মঞ্জুর আলম (২৩) ও ব্লক জিম্মাদার নুরুল ইসলাম (২৫)।
রহমত উল্লাহ উখিয়া উপজেলার কুতুপালং ৩ নম্বর রোহিঙ্গা ক্যাম্পের মৃত আবুল কাশেমের ছেলে, মঞ্জুর আলম কুতুপালং ৫ নম্বর রোহিঙ্গা ক্যাম্পের মো. নুরুল ইসলামের ছেলে এবং নুরুল ইসলাম একই ক্যাম্পের কামাল হোসেনের ছেলে।
সাজ্জাদ হোসেন বলেন, রোহিঙ্গা রহমত উল্লাহ ২০০০ সালে বাংলাদেশে অনুপ্রবেশের পর শাহপরীর দ্বীপে অবস্থান করেন। যেখানে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে বিভিন্ন মেয়াদে হাফেজ, দাওরায়ে হাদিস পর্যন্ত পড়াশুনা করে এবং বার্মিজ, রোহিঙ্গা, বাংলা, ইংরেজি, উর্দু, আরবি ভাষায় পারদর্শী হয়ে উঠেন।
পড়াশুনা শেষে তিনি ২০১৪ সালে মিয়ানমার চলে যান। পরে সেখান থেকে নিজ জমিজমা বিক্রি করে থাইল্যান্ড হয়ে মালয়েশিয়া চলে যান। পরবর্তীতে ২০১৮ সালে মালয়েশিয়া থেকে বাংলাদেশে ফিরে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে বসবাস শুরু করেন।
২০১৯ সালে আরসার গান গ্রুপ কমান্ডার মাস্টার ইউনুছের সেকেন্ড-ইন-কমান্ড মৌলভি রফিকের মাধ্যমে হাফেজ রহমত উল্লাহ আরসায় যোগদান করে। এরপর তাকে মিয়ানমারে ট্রেনিং এ পাঠানো হয় এবং সেখানে ৪ মাস অবস্থান করে ট্রেনিং সম্পন্ন করেন।
র্যাব কক্সবাজার ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক জানান, যোগদান করার পর প্রথমে আরসার ওলামা বডির সদস্য হন রহমত উল্লাহ এবং বিভিন্ন মসজিদে সাধারণ রোহিঙ্গাদের আরসায় যোগদানের দাওয়াত দিতেন। এছাড়াও সে আরসার ওলামা বডির সদস্যদের দাওয়াতি ট্রেনিং প্রদান করতেন।
এর মধ্যে দিয়ে বিভিন্ন মাধ্যমে আরসা প্রধান আতাউল্লাহ এবং সেকেন্ড-ইন-কমান্ড ওস্তাদ খালেদের সঙ্গে সুসম্পর্ক গড়ে ওঠে এবং সিগন্যাল অ্যাপসের মাধ্যমে নিয়মিত যোগাযোগ রাখতেন।
পরে তিনি ওস্তাদ খালেদের নির্দেশে আরসার জন্য লজিস্টিক সাপোর্ট, বোমা ও মাইন বানানোর জন্য বিভিন্ন মালামাল সংগ্রহ এবং সরবরাহ করার সুবিধার্থে কক্সবাজার শহরে ভাড়ায় বাসা নিয়ে বসবাস শুরু করেন।
এ সুবাদে রহমত উল্লাহ আরসার লজিস্টিক শাখার প্রধান হিসেবে নিয়োগ পান এবং লজিস্টিক সাপোর্ট, বোমা ও মাইন বানানোর জন্য বিভিন্ন মালামাল সরবরাহের দায়িত্ব পান।
র্যাব অধিনায়ক আরও বলেন, প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে রহমত উল্লাহ জানিয়েছেন- আরসা প্রধান এবং সামরিক শাখার প্রধানের ডিমান্ড অনুযায়ী বিভিন্ন উৎস থেকে বোমা ও মাইন বানানোর জন্য হাইড্রোজেন পার অক্সাইড, মারকারী (পারদ), ফোম, টর্চ লাইট, ব্যাটারি, ব্যাটারির ক্যাপ, ইলেকট্রিক তার, ইলেকট্রিক ক্লিপ, ছোট টেবিল ঘড়ি, ছোট লাইট, লোহার রড, সিমেন্ট, ছোট লোহার টুকরা, পাইপ, কাচসহ নানান সরঞ্জাম সংগ্রহ করতেন। এছাড়া তিনি আরসার ইউনিফর্মের কাপড়, শীত বস্ত্র, রেইন কোট, বুট জুতা, মোজা, বেল্ট, ক্যাপ, ব্যাগও সংগ্রহ করতেন।
এসব তিনি কক্সবাজারের বিভিন্ন স্থানে তা জমা রাখতেন এবং পরবর্তীতে আরসার সেকেন্ড-ইন-কমান্ড খালেদের নির্দেশনা অনুযায়ী উখিয়া এবং টেকনাফের বিভিন্ন রোহিঙ্গা ক্যাম্পে আরসার সদস্যদের কাছে পাঠাতেন।
এএইচ সাজ্জাদ হোসেন বলেন, “আটক নুরুল ইসলাম এবং মঞ্জুর আলম রোহিঙ্গা ক্যাম্পে আরসার ব্লক জিম্মাদার, তারা সরঞ্জামাদি রহমত উল্লাহর কাছ থেকে নিয়ে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে নিয়ে যেত।”
এ ব্যাপারে মামলা করে ৩ জনকে কক্সবাজার সদর থানায় হস্তান্তর করা হয়েছে।
সংবাদ সম্মেলনে আরও জানানো হয়, র্যাব-১৫ গত এক বছরে কক্সবাজারের বিভিন্ন এলাকায় অভিযান পরিচালনা করে আরসা’র শীর্ষ সন্ত্রাসী ও সামরিক কমান্ডার, গান গ্রুপ কমান্ডার, অর্থ সম্পাদক, আরসা প্রধান আতাউল্লাহ’র একান্ত সহকারী ও অর্থ সমন্বয়ক, মোস্ট ওয়ান্টেড কিলার গ্রুপের প্রধান, ক্যাম্প কমান্ডার, ওলামা বডি ও টর্চার সেলের প্রধান, স্লিপার সেল ও ওলামা বডির অন্যতম শীর্ষ কমান্ডার, অর্থ সমন্বয়ক, ইন্টেলিজেন্স সেলের কমান্ডারসহ সর্বমোট ৮৩ জন সক্রিয় সদস্যকে গ্রেপ্তার করেছে।