যশোরের আরআরএফ প্রশিক্ষণ ও রিসোর্স সেন্টারের একজন নারী পরিচ্ছন্নতাকর্মী সুলেতা মণ্ডল। বাড়ি সাতক্ষীরা জেলার আশাশুনি উপজেলার বড় দালান এলাকায়।
সকাল সকাল পায়ে চটি আর গায়ে লাল জামার উপর বিশেষ কটি পরে সেন্টারে ঝাড়ু ও পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার কাজে ব্যস্ত।
সাংবাদিক পরিচয় দিয়ে তার সঙ্গে কথা বলতে চাইলে কাজ করতে করতেই আলাপ করতে পারবেন বলে জানালেন।
হাসতে হাসতে কথা শুরু করলেও জীবনের গল্প বলতে গিয়ে ক্রমে চোখ ভিজে ওঠে তার।
সেন্টারের বারান্দা ঝাড়ু দিতে দিতে সুলেতা মণ্ডল জানালেন, বাবা-মা আর সাত ভাই-বোন নিয়ে বড় সংসার ছিল তাদের। হঠাৎ বাবার মৃত্যুতে এলোমেলো হয় সংসার-জীবনের গতি।
তিনি বলেন, “ছোট বেলাতেই আমরা বাবাকে হারাই। বাবার মৃত্যু ও বড় বোনের বিয়ের পর বড় ও মেজো দাদাও বিয়ে করে আলাদা হয়ে যান। ছোট দুই ভা্ই ও বোনের দায়িত্ব পরে আম্মার কাঁধে। কাঁথা সেলাই করে মা সংসার চালাতে হিমশিম খাচ্ছিল। আমি তখন স্কুলের ছাত্রী; বয়স তেরো কী চৌদ্দ। একদিন স্কুল থেকে বাড়ি ফেরার পরে মা বলল- ‘খেতে চাও, না পড়তে চাও?”
সেই যে বন্ধ হলো আর স্কুলমুখী ফেরা হলো না সুলেতা মণ্ডলের।
পরিবারে বৃদ্ধা মা আর ছোট ভাই-বোনদের পাশে দাঁড়াতে গিয়ে শেষ পর্যন্ত বিয়েটাও করা হলো না।
সুলেতা বলেন, “ভাই-বোনের পড়ালেখা ও মায়ের দেখা-শোনা করতে গিয়ে কোন দিক দিয়ে যে সময় চলে গেছে, বুঝতে পারিনি। নিজের বিয়ের কথা ওইভাবে কোনোদিন ভাবিনি, কারণ ছোট ভাই-বোনেরা ছিল।“
পারিবারিক ও অর্থনৈতিক সংকটের মধ্যে বড় বোন ও দুইভাই বিয়ে করে দূরে সরে যায়। তখন ভাঙা সংসারের হাল ধরে ছোটদের বড় করছে সুলেতা, যত্ন করেছেন মায়ের। ছোট ভাই-বোনদের বিয়ে দিলেও নিজে বিয়ে করার অবসর হয়ে ওঠেনি।
কিভাবে সংসারের হাল ধরলেন? জানতে চাইলে সুলেতা বলেন, “১৯৯৮ সালে আমার এক বোনের মাধ্যমে আরিফপুরে ‘বাঁচতে শেখাও’ নামে একটি এনজিওতে মাসে ১৫শ টাকা বেতনে রান্নার কাজের সুযোগ হয়। তখন ওরা খাওয়াটা ফ্রি দিতো। হাত খরচ ও রুম ভাড়া ৫০০ টাকা রেখে ১ হাজার টাকা বাড়ি পাঠাতাম মা ও ছোট ভাই-বোনদের জন্য। সংসার চালাতে মা তখনও কাঁথা-চট সেলাই করতেন।“
১৩ বছর ওই প্রতিষ্ঠানে কাজ করেও বেতন তেমন না বাড়ায় ২০১১ সালে যশোরের আরআরএফ প্রশিক্ষণ ও রিসোর্স সেন্টারের বাবুর্চি পদে ৪ হাজার টাকা বেতনে যোগ দেন সুলেতা।
তিনি বলেন, “আরআরএফে ১২ বছর ধরে কাজ করে এখন প্রতিমাসে ১৬ হাজার টাকা আয় ছাড়াও বোনাস ও ঋণের সুবিধা পাচ্ছি। থাকা ও খাওয়ার জন্যেও পয়সা লাগছে না।
“রাঁধুনী হিসেবে এখানে এলেও কোমড়ে ব্যথার কারণে বেশিদিন রান্নার কাজ করতে পারিনি। এক-দেড় বছর পর থেকেই পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার কাজ শুরু করি্। তবে, রান্নার কাজেও মাঝে মাঝে সহযোগিতা করতাম।“
এখন সেন্টারে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার কাজেই করছেন সুলেতা। কাজের অবসরে সিরিয়াল দেখতে টিভির সামনে বসে পড়েন।
আরআরএফ প্রশিক্ষণ সেন্টারের রিসিপশনিস্ট চয়ন বিশ্বাস বলেন, “উনি (সুলেতা মণ্ডল) অনেক নিরিবিলি প্রকৃতির মানুষ। কারও সাথে খুব বেশি কথা বলেন না, চুপচাপ থাকেন। ভাই-বোনেরা বড় হয়েছে, মা বৃদ্ধ হয়েছেন, এখনও বিয়ে করেননি তিনি। উনিতো স্বাভাবিক জীবনে নেই, কিন্তু এটা কাউকে বুঝতে দেন না তিনি।”
এখানে দীর্ঘ দিন কাজের ক্ষেত্রে তেমন তিক্ততার মুখোমুখি হতে হয়নি ৪৫ ঊর্ধ্ব সুলেতার।
তার ভাষ্য, “সবাই ভালো আচার-আচরণ না করলে এত দূর পর্যন্ত আমি আসতে পারতাম না। আমি একাতো, তাই সবাই আমাকে খুব ভালোবাসে।“
এই বয়সে এসে আর বিয়ে-সাদীর ইচ্ছে নেই জানিয়ে তিনি বলেন,” বাবা নেই, বড় ভাইয়েরা চলে গেছে, তাই বিয়ে করার কথা আর ভাবছিও না।
“এখন ছুটি পেলেই বাড়িতে যাই; সবার সাথে দেখা হলে খুব ভালো লাগে।”
তবে শেষ বয়সে কে দেখাশোনা করবে, এ কথাও মাঝে মাঝে ভাবনায় আসে তার।
“বাড়িতে গেলে সবাই বলে, তুই কেন বিয়ে করলি না? এভাবে কি জীবন চলে? এখন একটা চিন্তা আসে, শেষ সময়ে আমাকে কে দেখবে? তাই টাকা জমাচ্ছি, ঘর-বাড়ি করার জন্য। কিছু অর্থ-সম্পদ থাকলে কেউ না কেউ তো দেখবে।“