‘কলকাতার ইছাপুর ফ্যাক্টরি থেকে গুলি তৈরি করিয়ে এনেছিলাম’

“আমার মা, স্ত্রী-পুত্রের কোনো সন্ধান না পেয়ে আমি বনগাঁয় চলে যাই।”

আসাদুজ্জামান আসাদবেনাপোল প্রতিনিধিবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 25 March 2023, 05:11 PM
Updated : 25 March 2023, 05:11 PM

একাত্তরের যুদ্ধের কথা স্মরণ করতে গিয়ে এখনও আবেগপ্রবণ হয়ে পড়েন যশোরের শার্শা উপজেলার বীর মুক্তিযোদ্ধা দ্বীন ইসলাম মল্লিক (৮২)। সহায়-সম্পদহীন এই মানুষটি এখন বসবাস করছেন বেনাপোলের বীর নিবাসে। 

বেনাপোলের সীমান্তবর্তী রঘুনাথপুর গ্রামে তার জন্ম। মাত্র ২৯ বছর বয়সে ১৯৭১ সালের ৩০ জুন তিনি মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেন। সেসময় তিনি ছিলেন দিনমজুর। 

মুক্তিযুদ্ধে যশোর ছিল ৮ নম্বর সেক্টরের আওতায়। এই সেক্টর আবার সাতটি সাব-সেক্টরে ভাগ করা ছিল। শার্শা উপজেলায় ছিল দুটি সাব-সেক্টর। একটি বেনাপোল সাব-সেক্টর; অপরটি শিকারপুর সাব-সেক্টর। এই দুটি সাব-সেক্টরের অধীনে দ্বীন ইসলাম মল্লিক বেশ কয়েকটি সন্মুখ যুদ্ধ করেছেন। 

দ্বীন ইসলাম মল্লিক বলেন, বেনাপোল সাব-সেক্টরের দায়িত্বে ছিলেন ক্যাপ্টেন তৌফিক-ই এলাহী। পরে তার সঙ্গে যোগ দেন লেফটেন্যান্ট জাহাঙ্গীর। 

স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে এই বীর মুক্তিযোদ্ধা বলেন, “মুক্তিযুদ্ধের শুরুর দিকে রঘুনাথপুর গ্রামে পাঞ্জাবিরা আমাদের বাড়িঘরে আগুন ধরিয়ে দেয়। এ সময় আমার মা, স্ত্রী-পুত্রের কোনো সন্ধান না পেয়ে আমি বনগাঁয় চলে যাই। বনগাঁর যশোর রোডের ব্রিজ পার হয়ে বসতপুরের তাবারক খানের সঙ্গে দেখা হয়। তিনি আমাকে চাঁপাবেড়িয়া যুব ক্যাম্পে নিয়ে যান। 

“সেখানে গিয়ে যশোরের মোশারফ বিশ্বাস এমপি, তবিবর রহমান সর্দার এমপি, বেনাপোলের আব্দুল হক, আনিছুর রহমান, আলী কদর, সাদীপুরের আয়ুব মেম্বারসহ অনেকের সঙ্গে দেখা হয়। যুব ক্যাম্পে তারা শরণার্থী ও মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারীদের দেখভাল করতেন। 

“আমি তাদের বললাম, আমাকে একটি টিকিট দিন। আমি প্রশিক্ষণ নিতে চাই। সঙ্গে সঙ্গে তারা আমাকে একটি স্লিপ ধরিয়ে দিলেন। ক্যাম্পে আমরা দুই মাস অনাহারে-অর্ধাহারে দিন কাটালাম। হঠাৎ একদিন টালীখোলা ক্যাম্পের ক্যাপ্টেন মুখার্জি, লেফটেন্যান্ট মতিয়ার রহমান আমাদের সঙ্গে দেখা করতে এলেন। কিছুসময় সেখানে অবস্থান করে তারা চলে গেলেন। 

“এর কয়েকদিন পর ক্যাপ্টেন হাফিজ ও একজন ডাক্তার এসে বললেন, উচ্চতর প্রশিক্ষণের জন্য লোক ভর্তি করা হবে। ইচ্ছুক হলে তোমরা লাইনে দাঁড়াও। লাইন থেকে যারা সুস্বাস্থ্যের অধিকারী তাদেরকে বাছাই করে তারা নিয়ে গেলেন। 

“আমিসহ অবশিষ্ট যারা রইলাম, তাদের সবাইকে বললেন, পরে এসে নিয়ে যাবে। ইয়ুথ ক্যাম্পে আর থাকব না বলায় তৃতীয় ব্যাচে আমাকে উচ্চতর প্রশিক্ষণের জন্য বাছাই করা হল।

“আমাকে বিহার চাকুলিয়া ক্যান্টনমেন্টে নেওয়া হল। আমি ছিলাম ৪ নম্বর উইংয়ে। উইং কমান্ডার ছিলেন উৎপল সিং এবং সেকশন কমান্ডার ছিলেন বাঙালি ইপিআর ল্যান্সনায়েক মুজিবর রহমান। ওখান থেকে ২৮ দিনের প্রশিক্ষণ নিয়ে আমি বনগাঁ পেট্রাপোলে আবারও ফিরে আসি।” 

ভারতে যাওয়ার পরও বিভিন্ন সময়ে গোপনে দেশে এসেছেন দ্বীন ইসলাম মল্লিক। কাজ শেষ করে আবার ফিরে গেছেন। এ সময় বেনাপোল সীমান্তে বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলনের সঙ্গেও জড়িত ছিলেন তিনি। 

বেনাপোলের গয়ড়া যুদ্ধের স্মৃতিচারণ করে এই বীর মুক্তিযোদ্ধা বলেন, রাজাকারদের দেওয়া ছক অনুযায়ী খান সেনারা গয়ড়া গ্রামে আক্রমণ করে। তখন প্রতিরোধ গড়ার চেষ্টা করেও স্বল্পসংখ্যক মুক্তিযোদ্ধা ও ইপিআর বাহিনীর সদস্যরা সম্মুখযুদ্ধে টিকে থাকতে পারেননি। এ সময় ওদের পথে বাধা সৃষ্টির জন্য ইপিআর বাহিনী কন্যাদহ খালের উপরের ব্রিজটি উড়িয়ে দেয়; কিন্তু তাতেও শেষ রক্ষা হয়নি। 

“গ্রামের সাধারণ মানুষকে রক্ষার জন্য ইপিআরের কেউ কেউ এ সময় গ্রামে ঢুকে তাদেরকে পালিয়ে যেতে বলেন। তখন মুহুর্মুহু গুলি চলছে। অনেকে পালানোর সুযোগও পাননি।” 

তিনি বলেন, পাকসেনারা গয়ড়া গ্রামে ঢুকেই কিতাব আলির বাড়িতে প্রথম হত্যাযজ্ঞ চালায়। ওই সময় কিতাব আলি, তার ছেলে কেরামত আলি ও আব্দুর রহমান, দুই ভাই লুৎফর রহমান, ওসমান আলি ও তার মেয়েকে ওরা গুলি করে মারে।   

“এই যুদ্ধে সুবেদার মুজিবুল হক, হাবিলদার আতিকুর রহমান, নায়েক পিয়ার আলী, নায়েক আব্বাস আলী, নায়েক লিয়াকত আলী, সিপাহী নুরুল ইসলাম মুজাহিদ ও জাকারিয়া শহীদ হন। এখানে মোট ৬৩ জনকে হত্যা করে হানাদর বাহিনী।

“এদিন আমরা পিছিয়ে বড়আঁচড়া, কাস্টমস কলোনি, নামাজগ্রাম, সাদীপুরে পজিশনে থাকি। এরপর যুদ্ধ শুরু হলো। 

দ্বীন ইসলাম মল্লিক বলেন, ২৪ অক্টোবর আমরা গোড়পাড়া, নিজামপুর ও সোনানদীয়া সম্মুখসমরে যুদ্ধ করতে থাকি। ওইদিন নিজামপুর ও গোড়পাড়ায় তিনজন শহীদ হন। 

“এরপর ৫ ডিসেম্বর হানাদাররা রঘুনাথপুর ও বেনাপোল থেকে চলে যায়। তখন আমরা কেউ বেনাপোল, কেউ নাভারনের দিকে ছুটতে থাকি। এ সময় পাকিস্তানিদের পুতে রাখা মাইন বিস্ফোরণে শহীদ হন আমার সাথী পোড়াবাড়ি নারানপুর গ্রামের মোজাম্মেল হক এবং আহত হন আমিন উদ্দিন। 

এই বীর মুক্তিযোদ্ধা বলেন, হঠাৎ একদিন যশোর ক্যান্টনমেন্ট থেকে ক্যাপ্টেন হাফিজ ২০০ জন সেনা সদস্য নিয়ে বেনাপোল কাস্টমস কলোনিতে এলেন। এতে আমাদের বুকে সাহস জেগে উঠল। আমাদের কাছে ভারি অস্ত্র ছিল না। 

“সেনা সদস্যদের কাছে ছিল চাইনিজ রাইফেল, এলএমজি ও টুইন্স মর্টার ও সীমিত গুলি। সেনা সদস্যরা আমাদের সাথে যোগ দেওয়ায় ইপিআর, মুজাহিদ ও আনছার মিলে সৈনিক ছিল ৪৫০ জন। 

“একদিন যশোর থেকে খবর এলো, তাদের গুলি ফুরিয়ে গেছে। তখন ইপিআরের ল্যান্স নায়েক শাহাবুদ্দিন আহমেদ আমাকে একটি চিঠি দিয়ে বিএসএফ ক্যাপ্টেন কেপি সেনের কাছে পাঠালেন।

“আমি পেট্রাপোল বিএসএফ ক্যাম্পে গিয়ে চিঠি দেখাই এবং মুখে বিষয়টি বলি। বিএসএফ ক্যাপ্টেন আমার কাছে ১২ বাক্স গুলি দিলেন। কিন্তু ওই গুলি আমাদের হাতিয়ারে খাটল না। 

দ্বীন ইসলাম মল্লিক বলেন, “এরপর আবারও আমাকে ভারতে পাঠানো হল। পরে কলকাতা ইছাপুর গান ফ্যাক্টরি থেকে গুলি তৈরি করিয়ে এনেছিলাম। এটা আমার জীবনের একটা উল্লেখযোগ্য ঘটনা।” 

তিনি আরও বলেন, “আমরা জীবন বাজি রেখে যুদ্ধ করেছিলাম বলেই আজকের এই স্বাধীন বাংলাদেশ। যেখানে নতুন প্রজন্ম স্বাধীনভাবে সবকিছু করতে পারছে। নতুন প্রজন্মকে অবশ্যই বঙ্গবন্ধু, বাংলাদেশ ও মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে জানতে হবে। মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ বুকে ধারণ করতে হবে।”